অ্যাই ছেলে! কতো পেয়েছ অঙ্কে?

Anirban & Arijit, Childhood, Humor, Nostalgia, School, Series, Story, তোতন, বাংলা

ক্লাস এইট ~

কাগজের প্লেন টা সোঁ সোঁ করে হাওয়া কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো, একটুও টাল না খেয়ে, গর্বে তোতনের বুকটা ফুলে উঠল, অরিগামির স্যার এটা দেখলে নির্ঘাত কোলে তুলে নিতেন। একটাই দুঃখ,বাবা ওর প্রতিভা টা চিনতে পারলো না।

সময়ের অপচয় করা ঠিক নয়, এটা তো বাবা ই শিখিয়েছিল। তাই হাফ্‌ ইয়ার্লির অঙ্কের পেপার টা পেয়ে যখন বুঝল জ্যামিতির এক্সট্রা গুলো আজকে একটাও মাথায়ে ঢুকছেনা আর স্বয়ং রজনিকান্ত ও ওকে আর পাস করাতে পারবে না তখন ওর বাবাকে মনে পড়ল। এক্সাম শেষ হওয়ার তিরিশ মিনিট আগে দৃপ্ত ভঙ্গী তে এগিয়ে গিয়ে খাতা টা জমা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, আড়চোখে দেখে নিল ফার্স্ট বয় অর্ণব চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে, ব্যাটাকে আজকে হেব্বি ফ্রাসটু খাওয়ানো গেছে।

ক্লাসের বাইরের বারান্দাতে বেরিয়েই বুদ্ধি টা খেলল, মনে হল কোয়েস্‌চেন পেপার টার একটা সদ্গতি করা দরকার, তাই না পারা অঙ্ক গুলো কে নিয়েই প্লেন টা উড়ল।

 

এক মাস পর ~

খুব জলদি তোতন কে কিছু একটা ভাবতে হবে, বাড়ি পৌছনোর আগেই, ভেবেছিল গতবারের মত এবারেও হাফ ইয়ার্লির মার্ক শিট দেবে না , কিন্তু এবারে হেড স্যার বিট্রে করল, এখন বাবা কে দিয়ে এতে সাইন করানোটাই চাপের।

এক্সামের পরে বাবা যখন জিগ্যেস করেছিল –

– কত পেয়েছিস রে অঙ্কে?

– ৫০ এ ৪১ বাবা।

– হায়েস্ট কত?

– ৪২।

– বলিস কিরে! ওটা তোর খাতাই ছিল তো ?

– আমার ওপর তোমার তো কোন ভরসাই নেই, এবারে মার্ক শিটটা দিলে দেখিয়ে দিতুম।

এখন সেই মার্ক শিট নিয়েই ও বাড়ি ফিরছে, কাল কে একটা ম্যাচ ছিল ও পাড়ার সাথে, সেটা মনে হয় আর খেলা হল না।

– বাবা

– বল।

– একটা কথা ছিল।

– ফের পেন হারিয়েছিস তো?

– না সেটা নয়।

– তালে কি?

– এই মার্ক শিট টা তে একটু সাইন করে দিতে হবে।

– ও, দে দেখি…

কয়েক মুহূর্তের বুক ধুকপুকুনির পরে –

-এ কিরে অঙ্কে ১৫! তুই যে বলেছিলিস ৪১!

– ইয়ে, মানে…..

– মানে টা কি?

– মানে মনে হচ্ছে এটা আমার রেজাল্ট নয় বুঝলে, অন্য কারো সাথে গুলিয়ে গেছে।

এর থেকে বাজে অজুহাত আর হতে পারতো না, তোতন এখন সেটা বুঝছে। মাথার একটা জায়গা তে মনে হয় টাক পরে গেছে, কোমরে খুব ব্যথা, ডান দিকের গাল টা টোম্যাটোর মত লাল হয়ে আছে, নেহাত মা এসে বাঁচাল , না হলে কালকে স্কুলে ছুটি থাকত।

 

ক্লাস নাইন ~

এক্সাম দিতে যাওয়ার সময় রিক্সা তে পরার জন্য তোতন কিছু জিনিস তুলে রাখে, বাংলা র জন্য যেমন রচনা গুলো , স্বামিজি,নেতাজি, খুদিরাম, রবিঠাকুর, সুকান্ত আর ভগিনী নিবেদিতা, কিচ্ছু বাদ রাখেনি। এগুলো লেখার ছক এক, প্রথম লাইন- ‘মনিষীর নাম, এ এক বিশাল আধার’, ব্যাস এর পরে জন্মদিন, বাবা মা কাকার নাম, কি কি করেছেন, মারা গিয়ে কি ক্ষতি হল, মোটামুটি দু পাতা লিখে দিলেই ফেটে যাবে, এ ছাড়া আছে শীতের সকাল, শরতের বিকাল আর বর্ষা র সন্ধ্যা, আজকে ওকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।

এল ”ছাত্র জীবনের দায়িত্য ও কর্তব্য”। ব্যাডলাক টাই খারাপ আজকে,ভাগ্যিস পিকলু পাশে বসেছে!

পিকলুর বাংলার হাত টা ঘ্যামা, স্কুলের ম্যাগাজিন এ লেখে, এরকম একটা বেস্ট ফ্রেন্ড পাওয়া শীতকালে রোদে বসে কমলালেবু খাওয়ার মতই আনন্দের।

ভালোই এগোচ্ছিল রচনা টা, পিকলু চাপা গলা তে পাঁচালির মত পরে যাচ্ছিল আর ও লিখছিল, শুনে শুনে টোকাটা ডাবলসে ব্যাডমিন্টন খেলার মত, আন্ডারস্টান্ডিং টাই আসল।

কিন্তু বাদ সাধল বিরেন বাবু, দেড় খানা চোখে ছানি পড়লেও শ্রবন শক্তি তুখর, দুম করে বেঞ্চের সামনে এসে দাড়ালেন এবং ড্রেন থেকে যে ভাবে কুকুর ছানা তোলে সে ভাবেই পিকলুর কলার টা ধরে ক্লাসের বাইরে বার করে দিলেন।

এর কয়েক মিনিট বাদেই পিকলু দেখল তোতন ও বেরিয়ে আসছে।

– কিরে তুই বেরিয়ে এলি! লেখা শেষ?

– আরে ধুর, নিকুচি করেছে লেখার, তোকে আমার জন্যই বার করল, আমি দোস্তের জন্য এটা করতে পারব না?

সেবারে বাংলা তে ১৫ পেয়েছিল তোতন, তবে বাবা অব্দি খবর টা পৌঁছয় নি, পিকলু ই সাইন করে দিয়েছিল মার্ক শীট টা।

 

মাধ্যমিক প্রিটেস্ট ~

ইংরেজ দের ওপর খুব রাগ তোতনের, ওই ব্যাটাদের জন্যই ইতিহাস বই এ ১৫২ টা পাতা বেড়েছে, গুনে দেখেছে ও। ওই মোটা বই টা দিয়ে একটা কাজই ভাল হয়, সেটা হল বুক ক্রিকেট।

পরীক্ষার সময় সাল গুলো খুব জ্বালায়, বাবা বলেছে অপ্রয়োজনীয় জিনিস মাথার মধ্যে না রাখতে। ব্রেনে এখন আবার যখের ধনের ম্যাপ, তুবড়ির মসলার ফরমুলা, ঘুড়ির প্যাঁচ, সুপারহিট মুকাবিলার কাউন্ট-ডাউন, আরও কত কি জমে আছে। ওই সব সাল ফাল মনে রাখার মত স্পেস নেই, অতঃপর চোতা ই ভরসা।

ভাল চোতা বানানো টা একটা বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। বই এর ৮০ পারসেন্ট জরুরি তথ্য যেগুলোর ব্যবহারিক জীবনে কোন প্রয়োগ নেই অথচ পরীক্ষার সময় না লিখতে পারলে ফেল অনিবার্য সেগুলোর স্থান হয় এখানে। একটা ৩ ইঞ্চি বাই ২ ইঞ্চির কাগজে ছোট ছোট হরফ এ লেখা, এত ছোট যে কখন কখন নিজেরই পড়তে চাপ হয়ে যায়।

মুস্কিল টা হল স্কুলের বিড়াল স্যার কে নিয়ে, সারনেম বড়াল, কিন্তু নিজ গুনে সেটা বিড়াল হয়ে গেছে। ছেলেরা বলে উনি নাকি গন্ধ শুঁকে চোতা ধরে ফেলেন, তা সে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, জ্যামিতি বক্স, মোজা, জাঙ্গিয়া, বগলের তলা, হাতঘড়ি, কোনো জায়গাই সেফ নয়। স্কেলের সপাসপ্‌ মার আর নাচের তালে পর্ণমোচী বৃক্ষের পাতার মতো সর্বাঙ্গ দিয়ে চোতা ঝরে।

তবে এবারে একটা মোক্ষম বুদ্ধি বার করেছে তোতন , ধরা পরার কোনো চান্স ই নেই!

পরীক্ষার মাঝ পথে বড়াল স্যার দেখলেন তোতন হাতে একটা গোল কিছু নিয়ে বেশ মনযোগ দিয়ে দেখছে। ছেলেটাকে হাতে নাতে ধরব, এই ভেবে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন, তোতনের কাছে গিয়ে দ্যাখেন হাতে একটা মারি বিস্কুট, স্যার কে দেখেই গপ করে গোটা বিস্কুট টা মুখে পুরে দিল ও।

– এটা কি তোর টিফিন খাওয়ার সময়?

– না স্যার, মানে খুব খিদে পেয়ে গেছিল, তাই একটা খেলুম, আর খাব না।

– আর একটাও খেতে দেখলে কান টা ধরে বার করে দেব।

স্যার যেটা জানতে পারলেন না সেটা হল বিস্কুটের গায়ে কম্পাস দিয়ে লেখাছিল গোটা সাতেক সাল আর তারিখ, তার মধ্যে দুটো কমন এসেছিল!

তোতনের আরও কীর্তি ->

এতেই শেষ নয়, আরও আছে তোতনের গালগল্প ! বাকিগুলো অন্য আরেকদিন বলবো না হয়। জানিও কেমন লাগলো!

 

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদ চিত্রঃ cpc.edu.bd.jpg

15 comments

Comments are closed.