
রঙ্গিন গোধূলি
সাদা শাল জড়িয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে কুয়াশা ঠেলে রক্তিম বাবু হনহন করে “রঙ্গিন গোধূলি” -এর দিকে এগিয়ে আসছেন। ভোরের আলো এখনো পুরো ফোটে নি, শীতের ভোর যেন শেষ ঘুমের আমেজে মগ্ন। পলাশের চা – এর দোকানে কিছু চাষী চা এর সাথে উনুনের তাপে হাত পেতে কিছুটা উষ্ণতা নিতে ব্যস্ত। চা এর দোকানের পাশে দিয়ে যাবার সময় আবছা শুনতে পেলেন – পলাশ কাউকে বলছে –
“এই এক লোক! আজ প্রায় ১০ বছর দেখছি এই বৃদ্ধাশ্রমে,শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা যাই হোক, ভোর বেলা হাঁটতে বেরোবেন ই। কে বলবে ওনার বয়স ৭০, এখনো একদম ফিট।”
রক্তিম বাবুর ঠোঁটে একটু অহংকার মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠলো।
আশ্রমের গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখতে পেলেন একটা সাদা সুমো দাঁড়িয়ে ,নতুন কোনো আশ্রমের বোর্ডার হবে হয়তো। আশ্রমের অফিসে একবার দেখা করে ভাবলেন সকালের চা টা এই আশ্রমের ম্যানেজার মনোজের সঙ্গেই খাবেন। অফিসে ঢুকে চমকে উঠলেন, মনোজের সামনের চেয়ার এ যে বসে আছে তাকে তো রক্তিম বাবুর খুব ই চেনা, হৃদয় এর ঘড়ির কাঁটা টাইম মেশিন এ অতীতের দিকে ছুটতে শুরু করলো, প্রতিটা সময় ফলকের মোড়ে তো তার ই ঠিকানা লেখা, যদিও সময়ের সাথে মুখে বলিরেখা পড়েছে, মরে যাওয়া সময়ের ক্ষত মুখে ছড়িয়ে, কিন্তু রক্তিম বাবু নিশ্চিত, এ নীলিমা ই।
কলেজে রক্তিম বাবুর থেকে এক ক্লাস নিচে পড়তো নীলিমা, অপরূপ সুন্দরী, লাল শাড়ি , লাল টিপ্ আর পিঠ ছাপানো একপিঠ চুলের বিনুনি দুলিয়ে যখন সে কলেজ এর ক্লাস এ যেত অনেকের মনে উঠতো হিল্লোল| অনেকের মতো রক্তিম বাবু ও ঘায়েল ছিলেন। ওকে ইমপ্রেস করার জন্য কি ই না করেছেন। একবার তো বাজারে গিয়ে ওর ফেভারিট কালার লাল রঙের একটা পাঞ্জাবি কিনে ফেললেন পকেট মানি র টাকা বাঁচিয়ে| ওদের সম্পর্ক যখন বন্ধুত্বের বেড়া টপকে এক কদম বাড়ানোর জায়গায় এসেছে , সেই সময় ই নীলিমার বাবার জামশেদপুর এ বদলি হয়ে গেল। সময়ের স্রোতে রক্তিম বাবু বাবার ব্যবসা তে যোগ দিলেন, ব্যবসা কে বড় করতে গিয়ে নিজের বিয়ে থা করার আর সময় পান নি।তার পর ৪৫ – ৫০ টা বসন্ত পেরিয়ে গেছে, ৬০ বছরের পর নিজেই সমস্ত সম্পত্তি একটি ট্রাস্ট কে দান করে এখন এই বৃদ্ধাশ্রমের আবাসি|
কিছুক্ষন পর অফিসিয়াল কাগজপত্রের কাজ সম্পূর্ণ করে নীলিমার বাড়ির লোকজন চলে গেল ।
“আপনার ঘর উপরের বাম দিকের ঘরটা! আমি জিনিস পত্র পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। আপনি উপরে যান আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি একটু পর”- মনোজ বললো নীলিমা কে।
নীলিমা চিন্তাগ্রস্ত ,ভীতু মুখে ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে উপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো।
মনোজের সাথে এক কাপ চা খেয়ে রক্তিম বাবু নিজের ঘরের দিকে যাবার আগে একবার উপরে চোখ তুলে দেখলেন যদি নীলিমা কে দেখতে পান। দেখতে পেলেন না। হঠাৎ নজর পড়লো বাগানের মাঝখানে রাখা চেয়ার এর উপর। স্নান করে নীলিমা চুল খুলে বাগানের রোদে বসে আছে। আবার সেই ৫০ বছর আগের ভয় মিশ্রিত ভালোলাগার অনুভব টা বুকে চিনচিন করে উঠছে, নিজের স্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছেন। ধীরে ধীরে গিয়ে পাশের চেয়ারে বসে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন।
“ইয়ে _ কিছু মনে করবেন না … আপনি কি নীলিমা ?…. আশুতোষ কলেজ।।১৯৬৫ ব্যাচ।”
“হ্যাঁ ! কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
রক্তিম বাবু একটু আশাহত হলেন। নীলিমা তো ওকে চিনতেই পারছে না। তবু আর একবার মনে করানোর জন্য বললেন – “রক্তিম কে মনে আছে?? রক্তিম দত্তকে?”
নীলিমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো । যেন স্মৃতির খাতার প্রতিটা পাতা পড়ছে ।
“ফিজিক্স অনার্স ?আমাদের সিনিয়র ব্যাচ ?”
“যাক চিনতে পেরেছেন ..মানে পেরেছো। তবে সিনিয়র আর ছিলাম না। আমি ও .১৯৬৫ এই পাস করেছিলাম।” – রক্তিম বাবু হাসতে হাসতে বললেন।
নীলিমার মুখেও এতক্ষন পর বড় হাসির রেখা দেখা গেল।
হাসিটা এখনো একই রকম আছে নীলিমার। তার পর কত কথা…ধীরে ধীরে সময়ের খোলস ছিড়ে যেন দুই বৃদ্ধ বৃদ্ধা তারুণ্যের আলোতে ভোরে উঠেছে। ওদের মশগুল হয়ে হাসি মস্করা করা দেখে বৃদ্ধাশ্রমের ছোকরা চাকর, চাকরানীগুলোর হাসি আর ধরে না।
“দ্যাখ। ..দ্যাখ। .দাদু কেমন ঠাকুমা কে লাইন মারছে।”–রক্তিম বাবু শুনেও আনশুনা করে দিলেন।
কথায় কথায় কখন সূর্য মাথার উপর চলে এসেছে খেয়াল ই নেই । মনোজের ডাকে সম্বিৎ ফিরলো –
“আপনাদের স্নান হয়েছে ? ঠাকুর কে খাবার দিতে বলি ?”
“তুমি খাবার ঠিক করতে বলো আমি স্নান করে ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি ।”- বলে রক্তিম বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন ।
“নীলিমা।.খাবার ঘর টা তোমাকে মনোজ দেখিয়ে দেবে ,ওখানে এগিয়ে যাও , আমি আসছি।”
নিজের ঘরে ঢুকে স্নানের পর পড়ার জন্য পাট করা ধুতি বার করে বিছানার উপরের রাখলেন। আর ট্রাঙ্ক থেকে বার করে রাখলেন, অতি যত্নে পাট পাট করে রাখা একটা লাল পাঞ্জাবি।
লেখক পরিচিতি ~ আনন্দ-র জন্ম 1st April 1984, বীরভূম জেলার চৌহট্টে। এম.সি.এ এবং এম.বি.এ পাশ করে বর্তমানে কলকাতায় তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র কগনিজ্যান্ট-এ কর্মরত। প্রযুক্তিবিদ্যায় পারদর্শীতার পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও অতুলনীয়! একটি স্বরচিত কবিতা সংকলনের বই প্রকাশ আনন্দর স্বপ্ন। সেই তিলে তিলে গড়ে ওঠা স্বপ্নের স্বাদ পেতে পারেন Whispering Mirror -এ। দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা ওনার মুখ থেকে শোনার আনন্দই আলাদা। অশেষ ধন্যবাদ আনন্দ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ ওনার ছোটগল্প পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গল্পমালা।
প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ upload.wikimedia.org
প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds
17 comments
sundor somapti r tar cheye o sundor aboho …
Khub bhalo likheco ananda da..chaliye jao..☺
Thank you Goutam….Anarir annyo golpo gulo o enjoy koro…
Khub Bhalo Ananda Da 🙂
Thank you Kangkana
kub subdor golpo laglo…..ektu onno rokom 🙂
thanks
Bikela vorer ful ki futlo? Na ki Godhuli ratri holo.
Valo…
Bikele vorer kuri to futeche….ebar ful fotnar jonyo ektu mehonot korte hobe….:)…Thanks for reading…:)
Ananda… bridhho boyosh e purono prem ke fire paba ekta achievement 😛
kub bhalo lekha.
Aapnader ashirbaad
Besh bhalo laglo pore 🙂
Paid comment? 😛
Paid and threatened….:P
dhanyabad
Thanks Supurna
Khub sundor.. specially ‘title’..👍
Comments are closed.