অস্তিত্ব

Childhood, Diwali, Freedom, Friends, Marriage, Story, Supernatural, বাংলা

সময়টা বড় ভালো কাটছে। এতো ভালো অনেক দিন লাগেনি। ভালো সময় কাটানোটা একটা নেশার মতো। আবার এক বুক ভালোলাগার মধ্যেও কেমন যেন লুকানো চিনচিনে ব‍্যথা আছে। কোনো পুরানো সুখের শরিকদের হারানোর কষ্ট, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। ভালো সময়ের বাতি নিভলেই আবার সেই অজানা অন্ধকার।

একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল রাগিণী। এই মুহূর্তটাকে বন্দি করতে বাজি রাখা যায় সব। কিন্তু বাজি রাখার মত আর বাকি কিইবা আছে?

জানালার পর্দা টানা নেই, কাঁচের এপার থেকে বসার ঘরের ভিতর তাকাল সে। আসর জমেছে অনেক দিন পরে। চার বছর পর দাদা-বৌদি ফিরেছে দেশে, সাথে পুঁচকেটাকে নিয়ে। এতদিন ফেসবুকে দেখা ফটো আর ভিডিও কলের দূরত্ব কাটিয়ে সশরীরে একটা বছর আড়াই এর জ্যান্ত পুতুল পেয়ে বাবা মা যেন জীবন ফিরে পেয়েছে আবার। ঘরময় টলোমলো পায়ে দৌড়ে বেরাচ্ছে সে। আর পিছনে পিছনে মা দীপাবলীর আলো আর টুনি বাল্বের তার নিরাপদ দূরত্বে সরাতে শশব্যস্ত হয়ে ঘুরছে। দাদা, বিতান, হাসছে বাবার সাথে গলা মিলিয়ে। “আরে! তেলের প্রদীপ তো আর নয়, কিছু হবেনা, নিজের মত খেলতে দাও ওকে।”

বৌদিকে নীল সিল্কে দারুণ সুন্দরী লাগছে, ছিপছিপে শরীরে এইকয়েক বছরে একটা সুখী মেদের হালকা পরত্ লেগেছে। পুঁচকেটাকে মনে হচ্ছে বৌদির মতোই দেখতে হবে। কি সুন্দর এক মাথা চুল, টানা চোখ। মনে হয় ছুট্টে গিয়ে কোলে তুলে নেয়।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা থেকে রাত নামছে। পাড়ার কালীপুজোর প‍্যান্ডেলের মাইকে নব্বই-এর উদিত নারায়ণ, কুমার শানু সারা সন্ধ্যা মনোরঞ্জন করে এবার রফি সাব, কিশোর কুমার-কে সসম্মানে জায়গা ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছেন।

এক-একটা গান মনের কোণে লুকিয়ে থাকে, এক-একটা সময়ের স্মৃতি হয়ে। বাবা গলা মিলিয়েছেন মহম্মদ রফি-র সাথে, মায়ের দিকে হাসি হাসি চোখে তাকালেন।

“তুমনে মুঝে দেখা, হো কর্ মেহেরবান্ …
রুক্ গয়ে ইয়ে জমিন্, থম্ গয়ে আশমান্…”

কপট রাগী চোখে মা কট্-মট্ করে তাকাচ্ছে বাবার দিকে। দাদা-বৌদি হেসে কুটোপাটি, হাততালি দিচ্ছে মজা পেয়ে।

ভালো সময়ের আবেশের মধ্যে মনখারাপের চিনচিনে ব্যাথাটা আস্তে আস্তে মাথা চাড়া দিচ্ছে। ভুলে যাবার জন্য দুটো বছর অনেক লম্বা সময়। রাগিণী খুব খুশি যে বাবা-মা সব ভুলে আবার হেসে উঠেছে। কিন্তু প্রিয়জনের সুখের শরিক্ হতে না পারার কষ্টযে এতোটা, আগে কোনোদিন বোঝেনি সে। মরে গেলে সত্যিই জীবন শেষ হয়ে যায়, এই সরল সত্যিকথাটা এত কষ্টকর কেন?

দুবছর আগে এক পথদূর্ঘটনা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রাগিণীর, আজ এই দীপাবলীর রাত বুঝি অস্তিত্বটুকুও মিটিয়ে দিচ্ছে তার। এই ঘরে ফোটোফ্রেম ছাড়া আর কোনো জায়গা তার জন্য নয়।

আড়াই বছরের বাচ্চাটা ঘুম-ঘুম চোখে দেখল দেওয়ালে টাঙানো বড় ফটোর পিপি উদাস মুখে জানালার ওপার থেকে সরে কেমন ছায়া হয়ে বয়ে চলেছে বাগানের ল্যাম্পপোষ্টের ওপর দিয়ে। ছোট্ট একটা হাই তুলে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ল সে। পাড়ার প্যান্ডেলে মাইক তখন চিরন্তন রবীন্দ্রসঙ্গীতের আশ্রয় নিয়েছে – “তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে..
তারার পানে চেয়ে চেয়ে…”।

সামনে রাখা প্লেট থেকে একটা সন্দেশ মুখে পুরে টিভিতে ক্রিকেট ম‍্যাচের ভলিয়‍্যুম বাড়াল বিতান – “কালীপুজায় এই দুঃখ দুঃখ রবীন্দ্রসঙ্গীত কে বাজায়? নন্-সেন্স”।

লেখিকা ~ অরুন্ধতি রায়

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ GoodFon.su

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

5 comments

Comments are closed.