
চার্নকদার গল্পগুচ্ছ- পঞ্চম কাহিনী- লেজ
সাত নম্বরে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে।সকলের মিলিত অনুরোধে চার্নকদা রাজী হয়েছেন পাকাপাকি ভাবে থাকতে।কাঠখড় অবশ্য কম পোড়াতে হয়নি আমাদের।প্রথমেই প্রস্তাবটা বাতিল করে দিয়েছিলেন এই বলে যে -“ধুস কদিনই বা ভারতবর্ষে থাকি! সারাটা জীবন তো বাইরে বাইরেই কেটে গেল।কি লাভ এখানে ঘাঁটি গেড়ে”। আমরা কিন্তু দমে যাইনি।বিস্তর অনুরোধ,উপরোধে কাজ না হওয়ায় দিপু মাস্টারসট্রোক দিয়েছিল-“আহা যে কদিন আছেন এই পোড়া দেশে, সেকদিন অন্তত আমাদের সুযোগ দিন আপনার মতো ক্ষণজন্মা পুরুষকে সেবা করার”।
“সেবা”? -ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছিলেন তিনি।
-“না মানে যতটুকু আমাদের সাধ্যি আর কি ! ব্রেকফাস্ট রোজ নাহয় অগা দেবে। লাঞ্চ টা মিতু আর সিটু, আর ডিনার পুরো আমার দায়িত্ব” -দিপু চটপট জবাব দিয়েছিল। যাক বাবা! আমার নাম নেয়নি। আমি বেশ খুশি হয়ে উঠেছিলাম।
“আর থাকার ব্যবস্থা কিরকম হবে”?- চার্কনদা একটু যেন কৌতূহলী হয়েছিলেন। -“সেটাও ভেবেছি। আপনি সিটুর বিছানায় থাকবেন।আর আমি, অগা আর সিটু তিনজনে দুটো বিছানা জুড়ে ম্যানেজ করে নেব”- দিপু সমাধান করছিলো।-“ব্যবস্থা মন্দ নয়। তবে ওই যে ও রুমের মধ্যে এক কোনে মুখ গোমড়া করে বসে আছে ও, আমার গপ্পো গুলো তো ওই লিখছে কষ্ট করে। ওকেতো তোরা সুযোগ দিলিনা কিছু করার। বেচারা মন খারাপ করছে বোধহয়”- চার্কনদার ইঙ্গিতের লক্ষ্যবস্তু আমি। সত্যি বলতে কি মন খারাপ করার বদলে আমি মনে মনে বেশ খুশিই হয়ে উঠেছিলাম । কিন্তু চার্নকদা খলিফা লোক। ঠিক আক্রমণ করেছিলেন আমায়। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমার বেডটাকে। রুমের মধ্যে একমাত্র আমার বেডটাই গদি দেওয়া। সাইজেও একটু বড়।বেশ আয়েশ করে শোয়া-বসা যায়।বাকীদেরগুলো নরমাল, সেরকম আরামদায়ক ও নয়। বুঝতে পারি এবার আমার কিছু গচ্চা যাবে। তাও মুখে একটা হালকা হাসি টেনে বলেছিলাম -” আমার তো আর করার মতো কিছুই বাকি নেই চার্নকদা। সবই তো ওরা করে দিলো”।
এক মিনিট কি যেন ভেবেছিলেন, তার পর খুব চিন্তিত গলায় বলেছিলেন-” না হে। এইখানে থাকা হবেনা। আমার শিরদাঁড়ায় সমস্যা।সব বিছানায় শুতে পারিনা। আর তাছাড়া আমার সিগারেটের নেশা। তোমাদের খুব সমস্যা হবে। আমার থাকাটা ঠিক হবেনা।”এই বলে চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠে পড়েছিলেন। অগত্যা সকলের জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয়েছিলো-” চার্নকদার সমস্ত সিগারেটের খরচা আজ থেকে আমি দেব। তবে আমার এই স্পেশাল গদি লাগানো বড় বিছানায় আপনি থাকলে নেহাৎ আপনার সমস্যা হবে, নাহলে এটাও দিয়ে দিতাম।আমি অন্য কোনো একটাতে ম্যানেজ করে নিতাম।আপনার আবার শিরদাঁড়ায় সমস্যা বলে কথা।নরম বিছানা তো চলবেনা। কিন্তু যাইহোক আপনাকে থাকতেই হবে। আমাদের অনাথ করে দিয়ে আপনার এইভাবে যাওয়া চলবেনা”। বলা বাহুল্য নিজের বিছানার দখলটুকু রাখতে আমাকে রীতিমত ডাক্তারির জ্ঞান ফলিয়ে চার্নকদার মহড়া নিতে হয়েছিল। পুরোপুরি সফল না হলেও আমাদের অনাথ করতে এরপর আর চার্নকদার মন চায়নি। উনি পাকাপাকিভাবে সাত নম্বরি হয়ে গেলেন।
যথারীতি সকালে চার্নকদার ব্রেকফাস্ট অগা নিয়ে এসে রেখেছে।খুবই অল্পের উপর। পিসছয়েক পাউরুটি বাটার দিয়ে, চারটে সিদ্ধ ডিম আর খান আষ্টেক পুরুষ্ট মর্তমান কলা।সঙ্গে বেড টি। আমরা লোভ সংবরণ করে বসে আছি।কখন তিনি ঘুম থেকে উঠে এই ছোটখাটো গন্ধমাদন সাফ করবেন। তাঁর অবশ্য জাগার কোনো লক্ষণ নেই।দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন। অগা আর সিটু ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কি একটা শলা পরামর্শ করলো।আর তারপরেই বেমালুম দুখানা কলা নিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করে দিলো। পাকা মর্তমান কলার গন্ধে কিনা জানিনা, হঠাৎ চার্নকদার নাসিকা ধ্বনি থেমে গেল। অবশ্য চোখ খোলার আগেই অগা আর সিটু কলাদুটো গলাধঃকরণ করে ফেললো।
ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে চার্নকদার নজর গেল দুটো কলার খোসার দিকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সিটু জবাব দিলো-“না মানে অগা আট খানাই এনেছিল আপনার জন্য। কিন্তু এমন বাঁদরের উৎপাত । দুখানা বেমালুম মেরে দিলো !কি অন্যায় ব্যাপার বলুন তো “
“বেশ শিক্ষিত বাঁদর বলেই মনে হচ্ছে । খোসা ছাড়িয়ে খেয়েছে। আবার খোসা দুটো রেখেও গেছে। তাইনা”? – চার্নকদা ব্যঙ্গ করে বললেন।
“হ্যাঁ । মানে ইয়ে, মানে অদ্ভুত টাইপের। কথা নেই বার্তা নেই মুহূর্তের মধ্যে দুখানা নিয়ে চম্পট”- অগা আমতা আমতা করে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে।
” অদ্ভুত ? মানে প্ল্যাটিরাইন জাতীয়! নাকি ক্যাটারাইন গোত্রের”?- আমাদেরকে একদম চমকে দিলেন তিনি।
“কি? রাইন ? রাইন নদীর কথা বললেন নাকি”? -অগা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। “নাহ”-এই টুকু বলে চার্নকদা চুপ করে গেলেন। আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলামনা। একটা গল্প শুরু হতে হতে হলোনা। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো অগার উপর। কি দরকার ছিল ওরকম আহাম্মকের মতো ‘কি রাইন ‘ বলে ফেলার। আমি চার্নকদাকে তোষামোদ করে বলি-” ছাড়ুন তো ওর কথা। কিছুই জানেনা। তাও জ্ঞান জাহির করতে ছাড়েনা। আপনি বলুন ।যেটা বলছিলেন । ওই পাতি না কি যেন একটা রাইন”।
যেন কিছুই মনে পড়ছেনা এরকম একটা ভাব করে চার্নকদার বললেন- “কোই নাতো। সেরকম কিছু বলিনিতো। বলছিলাম কলা গুলো বেশ ভালো ছিল। রোজ রোজ ‘পাতি’ সিঙ্গাপু’রাইন’ কলার থেকে এই
মর্তমানগুলোই ভালো”।
বলা বাহুল্য, অগা আর সিটু আরো খান ছয়েক মর্তমান কলা এনে দিলো ক্যান্টিন থেকে।সেগুলো শেষ করে যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এইরকম ভাব করে চার্নকদা বললেন-” ও হ্যাঁ। যেটা জিজ্ঞেস করছিলাম। অদ্ভুত বাঁদর বলতে কি প্ল্যাটিরাইন নাকি ক্যাটারাইন গোত্রের।কোনটা?”
আমরা বুঝে গেলাম এবার গল্প পাওয়া যাবে।সবাই মিলে বেশ গুছিয়ে বসলাম।চার্নকদা শুরু করলেন-” বাঁদর সাধারণত দুই রকম হয়। প্ল্যাটিরাইন বা ছোট লেজ বিশিষ্ট বা লেজহীন আর ক্যাটারাইন বা লম্বা লেজবিশিষ্ট। প্রথম প্রকার বাঁদর দেখা যায় এশিয়া আর আফ্রিকায়।এদের ওল্ড ওয়ার্ল্ড মাংকি ও বলে। দ্বিতীয় দলকে বলে নিউ ওয়ার্ল্ড মাংকি যাদের পাওয়া যায় আমেরিকা মহাদেশে।
বাঁদর সম্বন্ধে কোনোদিনই আমি উৎসাহী ছিলামনা। নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমাকে এগুলো জানতে হয়েছিল। অনেক বছর আগের ঘটনা। আমার তখন তরুণ বয়স। ফার্স্ট ইয়ার।একদিন এই হোস্টেলেরই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলা খাচ্ছিলাম। সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কয়েকটা বাঁদর।তাই দেখে মাথায় চাপলো দুষ্ট বুদ্ধি। বাঁদর গুলোকে দেখিয়ে দেখিয়ে বললাম ‘ এই হনুমান কলা খাবি’। ব্যস একটা পেল্লাই সাইজের ভুতো বাঁদর এসে আমার গালে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় হাঁকিয়ে কলাগুলো নিয়ে চম্পট। আমি ততক্ষনে চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করে দিয়েছি।
ব্যাপারটা এখানে শেষ হলোনা। সারাদিন গুম হয়ে রইলাম। কারোর সঙ্গে কথা ও অবধি বললামনা ভালো করে। একটু ধাতস্থ হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম এর প্রতিশোধ আমি নেবোই। তবেই আমার নামার নাম চাণক্য দত্ত।
কিন্তু সমস্যা হল পরদিন থেকেই বাঁদরের দল চম্পট দিলো এখান থেকে।প্রতিজ্ঞা টা শুনতে পেয়েছিল কিনা কে জানে”! চার্নকদা হতাশার সুরে বললেন।
” ওহ । তার মানে আপনি কিছুই করেননি? এমনি এমনি ছেড়ে দিলেন বাঁদর গুলোকে”? – দিপু প্রশ্ন করলো।
“নাহ । ছাড় আর পেলো কই ! কিছুদিন পরই খবর পেলাম কি এক অদ্ভুত অজানা রোগ দেখা দিয়েছে বাঁদরদের মধ্যে। দলে দলে বেচারারা মারা যাচ্ছে। এশিয়া মহাদেশ প্রায় বাঁদর শূন্য। গুটিকয় টিকে আছে আফ্রিকাতে। সেখানেও এই রোগ থাবা বসিয়েছে।খুব শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে না পারলে পৃথিবী বাঁদরশূন্য হতে আর দেরি নেই। এই সময় আমাকে আর ডঃ কর্ন চাবজ কে ডেকে পাঠানো হলো আফ্রিকাতে। আমিও না করলামনা। পাড়ি দিলাম আফ্রিকা।
ডঃ চাবজ কে তো তোরা চিনিস।সেই যিনি গরিলাকে সার্জারি করে বুনিপ বানিয়েছিলেন।বিখ্যাত সার্জেন ও প্রাণিতত্ত্ববিদ। আমার সহকারী রূপে উনিই নিযুক্ত হলেন এ যাত্রা। যাওয়ার আগে শুধু আমি নৈশিক বাবার আশীর্বাদ নিয়ে নিলাম।
যে সময়কার কথা বলছি তখন এত উড়োজাহাজের রমরমা ছিলোনা।যেতে হত জাহাজে করে। লম্বা কস্টকর জার্নি। প্রায় দেড়মাস ওই ধকল সয়ে যখন পৌছালাম জোহানেসবার্গে ততক্ষণে বাঁদরদের বংশ বিলুপ্ত প্রায়।গোটাকয়েক টিকে আছে।ডঃ চাবজ তো কোন ছার আমিও শুরুতে গিয়ে একদম অথৈ জলে পড়লাম।না আছে কোনো অসুখের হদিশ, না কোনো ক্লু। অথচ বাঁদর গুলো কিভাবে যেন অজানা এক রোগে ভুগে ভুগে শুকিয়ে যাচ্ছে আর তারপর পটাপট পটল তুলছে বংশ শুদ্ধ।
এইভাবে চলতে থাকলে আর কদিনের মধ্যে যে আফ্রিকার বাঁদর লুপ্তপ্রায় হয়ে যাবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ রইলোনা।কাজে লেগে পড়লাম।মাসখানেকের নিখুঁত অধ্যবসায়ে একটা অবজারবেশন করলাম যে
অজানা এই অসুখটা শুধুমাত্র ছোট লেজ বা লেজবিহীন বাঁদরদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।তারাই মরছে। আর লম্বা লেজের ক্যাটারাইন গুলো সংখ্যায় কমেছে দেশ ছাড়া হওয়ার কারণে।
কাজ সহজ হয়ে গেল। বোঝার চেষ্টা করলাম লেজ থাকার কারণে ক্যাটারাইন গুলো কি সুবিধা পাচ্ছে। এই সময় একটা খারাপ খবর দিলেন ড চাবজ। শেষ প্ল্যাটিরাইন টাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। পড়ে রইলো শুধু লম্বা লেজের বাঁদর গুলো।তারাও দিনদিন সংখ্যায় কমছে যেভাবে, খুব শিগগিরই কিছু একটা ব্যবস্থা না করতে পারলে যে আফ্রিকা আসাটাই জলে যাবে এটা বুঝতে বাকি রইলোনা।
এইবার শুরু হলো বাঁদর ধরার অভিযান।স্থানীয় বান্টু আর সোয়াহিলি আদিবাসীদের নিয়ে। একটাকেও যদিনা জ্যান্ত অবস্থায় পাকড়াও করা যায়, তাহলে এই অভিযান তো সম্পূর্ণ ভাবে ব্যর্থ হবেই। উপরন্তু আফ্রিকা বাঁদর শূন্য হবে। পৃথিবীতেও আর বাঁদর থাকবে কিনা সন্দেহ।
কিন্তু কোথায় কি! তারা চলছে গাছে গাছে। লাফিয়ে লাফিয়ে। আর আমরা মাটিতে। অসম লড়াই। একের পর এক সবকটা জঙ্গল ছেড়ে পালতে লাগলো। বাধ্য হয়ে আমিও উঠে পড়লাম গাছে। তারপর এগাছ ওগাছ করে ধাওয়া করলাম একদম বাঁদরের পন্থায়।ওরা চলে ডালে ডালে ,আমি চলি পাতায় পাতায়।আমার সঙ্গে পারবে কেন। তিনদিন তিনরাত এইভাবে ধাওয়া করার পর দিলাম এক মোক্ষম লাফ।সোজা একটাকে লক্ষ্য করে। সে ব্যাটা ঝুলছে গাছের ডাল ধরে ,আর আমিও একহাতে ঝুলছি তার ডাল থুড়ি লেজ ধরে।
এই সময় অগা প্রশ্ন করলো-“একহাতে কেন?আরেকটা হাত কি হলো”?
-“আরেক হাতে কলা ছিল। মর্তমান। ওটার লোভ দেখিয়ে বাঁদর তাকে কায়দা করার তালে ছিলাম।নেহাৎ ব্যাটা প্রাণভয়ে আফ্রিকা ছেড়ে পালাচ্ছিল। তাই এত দেরি হলো পাকড়াও করতে। এদিকে মাটি থেকে প্রায় দেড়শ ফুট উঁচুতে বাঁদর ঝুলছে গাছে। আর আমি তার লেজ ধরে।
তারপর শুরু হলো দরাদরি। আমার প্রতিশোধ নেওয়ার পালা।ব্যাটার লেজ ধরে মোচড় দিতে দিতে বললাম -‘এই হনুমান কলা খাবি/জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি!’ ব্যাস। আর যায় কোথায়। ব্যাটা সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝটকা দিয়ে আমার হাত থেকে কলাটা কেড়ে নিলো। আর সেই ঝটকায় ফলেই আমি পড়লুম নিচে।
-“সেকি! আপনি হাত ফসকালেন!”-দিপু জিজ্ঞেস করে বসলো।
-“নাহ হাত ফস্কাইনি।ব্যাটার লেজটাই খসে গেল।সেই শুদ্ধু পড়লাম মাটিতে। ব্যাস তারপরেই চোখে অন্ধকার।অজ্ঞান হওয়ার আগে শুধু একটা অস্পষ্ট ঝুপ করে শব্দ শুনেছিলাম।
জ্ঞান হওয়ার পরে দেখলাম তাঁবুর মধ্যে একটা অত্যন্ত নরম বিছানায় শুয়ে আছি।পাশের বিছানাটায় অঘোরে ঘুমাচ্ছে ভুতমুখো বাঁদর টা। তড়াক করে উঠে প্রথমে ব্যাটার গালে কষালাম একটা তিরাশি সিক্কার থাপ্পড়।নেওয়া হলো আমার প্রতিশোধ। সেই আওয়াজে কিনা জানিনা, তড়ি ঘড়ি তাঁবুর মধ্যে ঢুকলেন ডঃ চাবজ।চেঁচিয়ে উঠলেন -‘করছো কি? তোমার শিরদাঁড়ায় অপারেশন হয়েছে। বিশ্রাম নাও। নাহলে সারাজীবন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারবেনা।তাঁর মুখ থেকেই পুরো ঘটনাটা শুনলাম।আমি মাটিতে পড়ার একটু পরেই বাঁদর টাও পড়ে ঝুপ করে। মারাত্মক আঘাত লাগে দুজনেরই। আমার শিরদাঁড়া প্রায় টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।বাঁদর তার ও একই অবস্থা হয়েছিল। চাবজ না থাকলে দুজনের কেউই বাঁচতামনা।
সপ্তাহ খানেক পর খানিকটা সুস্থ হয়ে আবার কাজে লেগে পড়লাম। প্রতিশোধ নেওয়া শেষ। এবার বাঁদর গোষ্ঠীর অসুখের একটা হিল্লে হওয়া দরকার। তাঁবুর মধ্যেই বেচারা লেজকাটা ভুতমুখো বাঁদর টাকে ধরে রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে শুরু করলাম। কিন্তু এ ব্যাটা ও দেখি দিন দিন শুকিয়ে যেতে শুরু করলো। আফ্রিকাতে সেই ছিল শেষ বাঁদর। সবাই যখন ধরে নিয়েছে যে এও বাঁচবেনা, তখন মিরাকলটা ঘটিয়ে দিলাম।বাঁচিয়ে দিলাম ব্যাটাকে।
“কিভাবে? কিভাবে?”- আমরা সমস্বরে চেপে ধরলাম চারণকদাকে।
“কলা খাইয়ে”- চারণকদা মুচকি হাসলেন।
“প্লিজ খুলে বলুন”- আমরা তাঁর পায়ে পড়ে গেলাম।
“পিঠে বড্ড ব্যাথা করছে। শিরদাঁড়াটা ভোগাচ্ছে। একটু নরম বিছানা হলে ভালো হতো -এই বলে তিনি আমার বিছানায় আধশোয়া হলেন। আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম।তিনি আবার শুরু করলেন-” আসলে বাবাজির কাছ থেকে আশীর্বাদ নেওয়ার সময় কিছুটা আফিম চেয়ে নিয়েছিলাম । কলাগুলোতে সেটাই মিশিয়ে রেখেছিলাম চড়া মাত্রায়। যাতে ওই বাঁদর ব্যাটাকে কব্জা করতে পারি সময় মতো। গাছের ডালে ঝুলতে ঝুলতে ওই কলা খেয়ে ব্যাটার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তাতেই পতন।
আর ওদের অসুখটা ছিল উৎশি নাম একরকম মাছির কামড়।অন্য কিছুই হচ্ছিলনা। কিন্তু ছোট ছোট এই মাছি গুলো সারারাত কামড়ে কামড়ে ওদের ঘুমাতে দিতনা। যাদের লেজ ছিল তাদের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। তাই ওদের শিকার হচ্ছিল লেজবিহীন গুলো। আর রাতের পর রাত না ঘুমাতে পেরেই ওরা দোলে দোলে শুকিয়ে মরছিল।এ ব্যাটার যতদিন লেজ ছিল এ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে। কিন্তু যেই আমার হাতে লেজটা খোয়ালো, তারপরেই ব্যাটার ঘুম উধাও। মরণাপন্ন অবস্থা। নেহাৎ ওই কড়া ডোজের আফিম খাওয়াতাম কলায় মেখে তাই ব্যাটা ঘুমিয়ে বাঁচলো। পরে অবশ্য মাছি মারার কাজ করে ডঃ কেরানী থুড়ি কর্ন চাবজ খুব নাম কিনেছিল। কয়েক হপ্তা পরে আলিপুরের জু থেকে একটা মাদি বাঁদর নিয়ে এসে ছেড়ে দিলুম ওই ভুতমুখোটার সাথে,আর আফ্রিকাতেও লেজবিহীন বাঁদর প্রজাতির নতুন করে শুরু হলো ।” -চারণকদা থামলেন।
“সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ডঃ চাবজ এত কিছু পারেন ,আর সামান্য বাঁদরের লেজটাকে আবার জুড়ে দিতে পারলেন না। তাহলে তো আর কলা খাওয়ানোর দরকার হতোনা”- সিটু জিজ্ঞেস করলো।
“পারবে কিকরে? সেই লেজটা দিয়েই তো আমার শিরদাঁড়া মেরামত করেছিল। তাই তো আজ চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। তবে এটা তো অন্যরকম সমস্যা, তাই নরম বিছানা ছাড়া আমার সহ্য হবেনা”-এই বলে তিনি আমার বিছানায় চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারণকদার জন্য নির্দিষ্ট শক্ত একটা বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম।
লেখক পরিচিতি ~ ডঃ স্বদেশ মান্না-র জন্ম 4 April 1986, কলকাতায়। এন আর এস মেডিকাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করে বর্তমানে কোলকাতা পোর্ট হসপিটাল-এ কর্মরত। জীবসেবা-র পাশাপাশি ওনার লেখনীর দৌরাত্ম ও প্রশংসনীয়! অশেষ ধন্যবাদ স্বদেশ বাবুকে আমাদের anariminds.com এ লেখা পাঠানোর জন্য। উপভোগ করতে থাকুন ওনার ভিন্ন স্বাদের গুল্পগুচ্ছ।
প্রচ্ছদচিত্র ~ ডঃ রিয়া দাস
One thought on “চার্নকদার গল্পগুচ্ছ- পঞ্চম কাহিনী- লেজ”
natun kore Ghana da r sriti uske dilo …. khub valo
Comments are closed.