হিস্ট্রির মিস্ট্রি – ১ ~ দেবতা/দানব

Anirban & Arijit, History, Series, বাংলা, হিস্ট্রির মিস্ট্রি

….একে একে বারো জন শিষ্য টেবিলে বসলেন, প্রভু সবাইকে রুটি ভাগ করে দিলেন, নিজের হাতে সবার সুরা পাত্রে ভরে দিলেন মদিরা, তারপরে বললেন-
“তোমাদের মধ্যে একজন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে”।
চমকে উঠল শিষ্যরা! কেউ বাক্যহারা, কেউ জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাকিয়ে প্রভুর দিকে, কেউ হতাশায় ম্রিয়মান। তাদের মাঝেই জুডাস মুখ লোকাবার চেষ্টায় ব্যস্ত, চোখ দুটো বিষ্ফোরিত, তাহলে কি যীশু জানেন সব কিছু!

১৪৯৫, ফ্লোরেন্স, ইতালি

যীশুর শেষ ভোজ বা লাস্ট সাপার লিওনার্দোকে খুব টানে, তিনি তার কাছে ঈশ্বর নন, শুধু আরেকজন রক্তমাংসের মানুষ । যীশু সংসারী ছিলেন, তারও স্ত্রী ছিল। তার দর্শন, তার শান্তির বানী লিওনার্দোকে মুগ্ধ করে। কিন্তু চার্চ চায় না এই মানুষ যীশুকে, তারা এখন খুব ব্যস্ত যীশু নামের ভগবান তৈরী করতে। ধর্মই তো মানুষকে শাসন করবে। নত হবে তার মাথা বিশাল যীশুর মুর্তির সামনে। দেওয়াল জোড়া, ছাদ জোড়া অতিকায় মুরাল বলবে যীশুর গল্প। ভক্তের চোখ ভিজে আসবে তা দেখে। কিন্তু সেই সব ছবি আঁকবে কে?

রেনেসাঁর সময়ের যে কজন হাতে গোনা শিল্পী তারা কেউ চার্চের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজী নয়। কিন্তু এরা ছাড়া চার্চেরও চলবে না, তাই একরকম নিমরাজি হলেও এদের কাছেই যাজকদের হাত পাততে হয়, এরাই আঁকে সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ে, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের কোণে কোণে বসে এদের হাতে গড়া মূর্তি। প্রভুর যশ, খ্যাতি, মহিমা ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। মন না চাইলেও শিল্পীদের এগুলো করতেই হয়, নাহলে যে কোন দিন খুন হয়ে যাওয়ার ভয়!

লিওনার্দোর কিন্ত সেই ভয় নেই। পোপের দু’চক্ষের বিষ সে, বিচ্ছিরি একটা লোক, যে কিনা সময় কাটায় বেশ্যালয়ে, রাত বাড়লেই কবরখানা থেকে মড়া তুলে এনে কাটতে শুরু করে, বুক চাপড়িয়ে বলে পৃথিবীটা নাকি জেনেসিসের আগেও ছিল, আকাশে ওড়া সম্ভব, আরো কত কি। এহেন নাস্তিক লোককে খুন করে ফেলা হবে এটাই স্বাভাবিক, সে চেষ্টাও হয়েছে বার চারেক। কিন্তু কেউ তার টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। তার একমাত্র কারণ তার আশ্রয়দাতা।

গোটা ইতালি পোপের পায়ের তলায় থাকলেও ফ্লোরেন্স এখনও অধরা। আর সেটা মেদিচিদের জন্য, এরা এখন গোটা ইউরোপের ধনকুবেরদের টাকা পয়সা সামলায়, দরকার পরলে ধারও দেয়, বলতে গেলে পৃথিবীর অর্ধেক ভাগের ব্যানকিং সিস্টেম চালায় এরা। তাই ফ্লোরেন্সে এরাই সর্বে সর্বা। এই মেদিচিদেরই স্নেহধন্য লিওনার্দো।ওর সব খরচ মেদিচিরা দেয়। বদলে লিওনার্দোও মেদিচিদের দু’হাত ভরে দিয়েছে। ফ্লোরেন্সের শহরটা জুড়ে এখন লিওর দুর্দান্ত সব কাজের ছাপ, ওর আঁকা একের পর এক মাস্টারপিস শোভা পাচ্ছে মেদিচির প্রাসাদে। ওর বানানো নতুন নতুন অস্ত্রের প্রোটোটাইপ ভ্যাটিকানের সৈন্যদের বুকেও কাঁপুনি ধরাচ্ছে।

এই রকম দুর্দান্ত একটা জীবন কাটছিল লিওর। এমন সময়ই তলব এলো মিলান থেকে। মিলানের ডিউক ডাক পাঠিয়েছেন। লাস্ট সাপার এঁকে দিতে হবে লিওনার্দোকে। লাস্ট সাপার, এতোদিনের একটা স্বপ্ন সত্যি হবে লিওর! ঝটপট মেদিচিকে রাজী করিয়ে ফেললেন, কয়েক মাসের ব্যাপার, কাজটা করেই ফিরে আসবেন। পরেরদিনই একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে লিও বেড়িয়ে পরলেন। গন্তব্য মিলান।

মিলানের ডিউক এখন লুদভিকো ফোর্জা। ফ্লোরেন্সকে দেখে খুব গা জ্বালা হয় তার, কি দারুণ একটা শহর! তার নিজেরও তো কম ঐশ্বর্য নেই, তাহলে মিলানও বা বাদ যাবে কেন? ব্যস যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, ফ্লোরেন্সেরই নকল করে মিলানে তৈরি হয়ে গেল ডুওমো, গোল মাথাওয়ালা চার্চ। বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ব্রামান্তের বানানো একটা পুরোনো চার্চ ছিল মিলানে, সান্তা মারিয়া ডেলা গ্রাজি। এবারে তার নজর গেল সেইটায়। খুব সাধারন একটা গীর্জা, এটাকে বিখ্যাত করে দেওয়া যায় কি ভাবে? নিয়ে এসো লিওনার্দোকে ফ্লোরেন্স থেকে, সেই পারবে এই একরত্তি বাড়িটাকে অমর করে দিতে।

-অনেক নাম শুনেছি আপনার, পারবেন কাজটা করতে?

লিওর মুখে একটা স্মিত হাসি খেলে গেল,

-না পারার কিছু নেই, কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত?
-রাতারাতি আমি ছবিটা বানাতে পারব না, অন্তত মাস ছয়েক সময় লাগবে।
-কোন ব্যাপার নয়, ওই চার্চের উল্টোদিকের প্রাসাদটাই আপনার, যা যা লাগে বলবেন আমায়, সব পাবেন।

কাজ শুরু হয়ে গেল লিওর। সান্তা মারিয়ার যাজক মাঝে মাঝেই দেখেন উস্কোখুস্কো চুলের একটা লোক আসে। চার্চের ভিতরে যেখানে প্রিস্টরা খাওয়া দাওয়া করেন সেখানে আট মিটার বাই চার মিটার একটা বড় দেওয়াল আছে। খেপা লোকটা ঘন্টার পর ঘন্টা ফাঁকা দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপরে মইয়ে উঠে একটা দুটো আকিবুকি করে, তারপরে বেড়িয়ে যায়, এমনই চলতে থাকে মাসের পর মাস।

ছমাস পেড়িয়ে গেল হুস করে, ছবির কাজ এখনো মাত্র দশ শতাংশ হয়েছে। লিওর কোন তাড়া নেই কিন্তু, অনেকদিনের স্বপ্ন তার এটা, সময় নিয়ে বানাতেই হবে। দ্বিমাত্রিক ছবিটাকে যেন মনে হয় ত্রিমাত্রিক। যীশু আর তার ১২ জন শিষ্যর মুখ হতে হবে জীবন্ত। তাই জন্য লিও মডেল ধরে আনেন, পছন্দ হলে তাদের মুখের আদলে আঁকছেন চরিত্রদের অবয়ব। যীশুর ছবি আঁকা হল প্রথমে, মিলানেই দারুণ সৌম্যকান্তি এক পুরুষ পাওয়া গেছিল, তারপরে একে একে জীবন্ত হতে লাগল বাকি শিষ্যরা। কিন্তু জুডাস কই! একটা ক্রুর, নির্মম মুখের মানুষ চাই, যাকে দেখলেই মনে হবে এই বুঝি নরকের দরজা খুলে বেড়িয়ে এল।

কিন্ত এরকম লোক তো পাচ্ছেন না লিও। কাজ শুরু করার পরে তিনবছর কেটে গেল, কিন্তু মনের মতো একজনকে পাওয়া গেল না যাকে জুডাস বানানো যায়। মিলানের জেলখানা গুলো লিও নিজে ঘুরে দেখেছেন। যেরকম ধুর্ত মুখ তিনি চাইছেন তা পাচ্ছেন কই? এদিকে ডিউকের ধৈর্য হারাচ্ছে, রোজ রোজ নতুন কেউ এসে কাজে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে, একবার অধৈর্য হয়ে তো লিওনার্দো বলেই ফেললেন,
এবারে যে ব্যাগড়া দিতে আসবে আমি তার মুখ ই জুডাসের শরীরে বসিয়ে দেব!

মিলানে হল না, লিও জুডাস খুঁজতে হাজির হলেন রোমে। রোমের এক জেলখানায় একদিন সবে পা দিয়েছেন, দেখলেন এক কয়েদি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে গরাদের পেছনে। মুখ ভর্তি দাগ, চুল অবিন্যস্ত, নোংরা জামা কাপড়। দেখলেই শরীর শিউরে ওঠে। পেয়ে গেছি আমার জুডাসকে! নিজের মনের মধ্যেই লাফিয়ে উঠলেন লিও।

কয়েদী টাকে মিলানে নিয়ে আসতে খুব বেশি কসরত করতে হল না লিওনার্দোকে। ফাঁসীর আসামী, কারোর দাবী নেই তার ওপরে, কোন দাম নেই ওই মানুষটার, মিলানের ডিউকের একটা চিঠিতেই কাজ হল, শুধু আঁকা হয়ে গেলে রোমের জেলে ফেরত পাঠাতে হবে লোকটাকে।

দিন চারেক ধরে লোকটাকে সামনে বসিয়ে জুডাসকে দেওয়ালে ফুটিয়ে তুললেন লিও। যাক, তিন বছরে শেষ হল তার স্বপ্নের কাজ। মনে অনেক তৃপ্তি, চোখ উদ্ভাসিত সেই তৃপ্তিতে। এমন সময় আসামীর দিকে তাকিয়েই একটু অবাক হলেন। তার চোখে জল, অসীম শুন্যতা ভীড় করে আছে সেই চোখে।

-কাঁদবেন না, আমি ডিউককে বলব, উনি হয়ত আপনার ফাঁসীর সাজা রদ করতে পারেন।
-মৃত্যুকে আমি আর ভয় পাইনা মায়েস্ত্রো।
-তবে চোখে জল কেন?
-আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি?
-নাহ তো, রোমের কয়েদখানাতেই তো প্রথমবার…

কথাটা ফুরোবার আগেই লিওনার্দো চমকে উঠলেন, সত্যি কি একে আগে কোথাও দেখেছেন? ওই ভ্রু দুটো, ওই ওই চোখের মনি গুলো, ওই টিকলো নাক…. খুব, খুব চেনা লাগছে কি?

এবারে কয়েদী বলতে শুরু করলেন,

-আমি আগেও এখানে এসেছি, বসেছি আপনার সামনে, তিনবছর আগে। তখন এই দেওয়ালটা প্রায় ফাঁকা ছিল।

লিওনার্দো বিদ্যুতপৃষ্ঠ হলেন এবারে, আরে তাই তো! এই সেই সৌম্যকান্তি পুরুষ, যাকে দেখে তিনি সাতদিন ধরে একটু একটু করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন-

প্রভু যীশুকে!!

মাঝের তিনটে বছরে সেই মানুষ অনেক নিচে নেমে গেছেন, চুরি, ডাকাতি, খুনোখুনিতে জড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। প্রতারণা আর মিথ্যে হয়েছে নিত্যদিনের সঙ্গী, আর নিজের অজান্তেই তার নিষ্পাপ মুখটাও বদলে গিয়েছে। দেবদুতের জায়গাটাকে গ্রাস করেছে শয়তান।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির লাস্ট সাপারে যে মানুষটা পবিত্র যীশু সেই মানুষটাই প্রবঞ্চক জুডাস, এই ঘটনাটা কতটা সত্যি বা মিথ্যে আমি জানি না। কিন্তু মনের আয়নাতেই যে মুখ দেখা যায়, সে কথাটাই আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ছবিটা।

সবশেষে একটা কথা বলি। আচ্ছা লিওনার্দো তো ভগবানে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাহলে লাস্ট সাপার আঁকার সময় কি মানুষ যীশুকে এঁকেছিলেন নাকি ভগবান যীশু কে? আলবাত রক্তমাংসের মানুষটাকেই এঁকে ছিলেন, লাস্ট সাপারের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অনেক রহস্য। যা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নিজের যাদুতে লুকিয়ে রেখেছেন। যা বুঝতে আমাদের আরো ৬০০ বছর সময় লেগেছিল।

সে গল্প না হয় আরেকদিন বলব খন।

 

 

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ http://www.independent.co.uk

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds