হিস্ট্রির মিস্ট্রি -২ ~ শেষ ভোজের রহস্য

Anirban & Arijit, History, Series, বাংলা, হিস্ট্রির মিস্ট্রি

 

১৯৪১, মিলান

জনৈক আর্মি জেনারেল আর পাদ্রী অ্যাচার্বি দাঁড়িয়ে আছেন সান্তা মারিয়া চার্চের আধা অন্ধকার একটা ঘরে,

-যুদ্ধ লেগেছে , এ শহরও বাঁঁচবে না।
-কিন্তু ছবিটাকে তো বাঁচাতেই হবে।
-কি করে বাঁচাবেন, ফ্লোরেন্সে শুনলাম ওরা ডেভিডকে ইঁটের দেওয়াল দিয়ে মুড়ে ফেলেছে, এই দামড়া ছবিটাকে আপনি কি দিয়ে ঢাকবেন? ভেবেছেন কিছু?
-জানি না ঠিক, পার ফাভোর, আমাকে কিছু বালির বস্তা জোগাড় করে দেবেন?

১৫ই অগাস্ট, ১৯৪৩, মিলান

রাতের আকাশে একফালি চাঁদ আজ।অর্ধ-গ্রাস চন্দ্রগ্রহণ চলছে, কিন্তু সেদিকে কারোর নজর নেই। মিলানে আজ সারা রাত কারোর চোখে ঘুম নেই। মিনিটে মিনিটে কেঁপে উঠছে শহরটা, মিত্রশক্তির বোমারু বিমান গুলো ঝাঁঝড়া করে দিচ্ছে মিলানকে। পাদ্রি অ্যাচার্বি সারা রাত মাটির নিচের ছোট এক রত্তি ঘরটায় বসে প্রার্থনা করে গেছেন,

চার্চটার যেন কিছু না হয় প্রভু!

মানুষের সেই রাতের অত্যচারে ঈশ্বরও হয়ত মুখ ঢেকেছিলেন। ভোরের দিকে ৪০০০ পাউন্ডের একটা বোমা আছড়ে পড়ল চার্চ থেকে মাত্র ৮০ মিটার দূরে।


সারারাতের আতঙ্ক কাটিয়ে মিলানিজরা যখন বাড়ির বাইরে বেরোলেন তখন সান্তা মারিয়া চার্চ আর নেই প্রায়। দুদিকের দেওয়াল ধসে গেছে, ভেঙে পড়েছে সিলিং, বিষ্ফোরণের চোটে গোটা চার্চের ভিতটাই নেমে গেছে কয়েক ফুট। কিন্ত আশ্চর্য জনক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরের দেওয়ালটা! ওই দেওয়ালটাই তো ঢাকা আছে বালির বস্তা আর পাইন কাঠের তক্তা দিয়ে!

 

যতদিন বিশ্বযুদ্ধ চলেছে দেওয়ালের ওই তুচ্ছ আবরণ সরানো হয়নি, দু’বছর ধরে তা রোদে পুড়েছে, কাঠ চুঁইয়ে ঢুকেছে বৃষ্টির জল, ঢাকা পড়েছে বরফের আচ্ছাদনে।
একদিন মরণলীলা থামল, আর সেদিন ভোরে পাদ্রী কাঁপা কাঁপা বুকে খুলে ফেললেন দেওয়ালের আচ্ছাদন। আশেপাশে জড়ো হওয়া মিলানিজরা অবাক চোখে দেখল-

ওই ওই তো যীশু, আনত চোখ, নির্লিপ্ত মুখ। আর তাকে ঘিরে আর বারো জন শিষ্য। ঠিক যেমনটা শেষ বার দেখা গিয়েছিল বছর চারেক আগে।

নাহ, লিওনার্দোর লাস্ট সাপারের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।

দেওয়ালের এক কোণে শুধু একটু চিড় ধরেছে এই যা, সে সারিয়ে নেওয়া যাবে।

আঁকার পাঁচ বছরের মধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে পরতে থাকে লাস্ট সাপার, তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের আগে বার পাঁচেক আর পড়ে তিনবার। শেষবারেরটা ১৯৯৯ সালে। এখন সেই ছবি দেখতে গেলে অনেক হ্যাপা, প্রায় মাস আষ্টেক আগে থেকে বুক করতে হয় একটা স্লট, এক একটা স্লটে মাত্র ২০ জন করে ঢুকতে পারবে ঘরটাতে, ৩০ মিনিটের বেশি থাকা যাবে না। ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলা যাবে না। প্রতি ১৫ মিনিটে ট্যুরিস্টদের বার করা কার্বন ডাই ওক্সাইড আর জলীয়বাষ্পও পরিস্রুত হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। ৬০০ বছরের পুরোনো একটা দেওয়াল চিত্র বাঁচানোর এই চেষ্টা তুলনাহীন।

সারা পৃথিবী জুড়ে কয়েক হাজার লাস্ট সাপার আঁকা আছে, কিন্তু সবাই এটা দেখতেই এতো ভীড় করে কেন?
আমি নিজেও টিকিট পাইনি বলে চারগুন বেশি মূল্য দিয়ে দেখেছি ছবিটা, এক এক জনকে দেখেছি প্রতিবছর বারবার আসছে ছবিটা দেখতে। কিন্তু কেন?

লিওনার্দোর আঁকা সব ছবি কথা বলে, কিন্ত সেই ছবির ভাষা পড়তেই অনেকদিন সময় লেগেছে তাবড় তাবড় ইতিহাসবিদ, সিম্বলিস্টদের। সব সময় সেই ভাষা সত্যি না মিথ্যে তা নিয়েও অনেক মারপিট হয়েছে পন্ডিতদের মধ্যে, আমি যেটুকু জানি আপনাদের বলব, তার গ্রহনযোগ্যতা বিচার করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।

১ এপ্রিল, বুধবার, এডি ৩৩। যীশু শেষবারের মতো নৈশ ভোজে বসেন শিষ্যদের সাথে। রুটি আর সুরা ভাগ করেদেন সবার মধ্যে। আর তারপরেই আসে সেই উক্তি –

“ তোমাদের মধ্যে একজন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।”

এই মুহূর্তটাই ধরে রেখেছেন লিওনার্দো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে আর পাঁচটা লাস্ট সাপারের ছবির মতো এটাও একটা, কিন্তু আদপে আরো বেশি কিছু, আসুন টুপ করে ডুব দেওয়া যাক ছবিটার মধ্যে-

১. খ্রীষ্ট ধর্মে যীশু আর তার ১১ জন শিষ্যই ( জুডাস ব্যাটা বাদ এখানে) ভগবানের রূপ। সেই কারণে ওদের যে কোন ছবিতেই দেখবেন মাথার পেছনে হ্যালো আছে। মানে সাদা চাকতির মতো, আমাদেরও অনেক দেব দেবীর ছবির পেছনে এরকম দেখবেন। এবারে লিওর ছবিটা লক্ষ্য করুন, হ্যালো দেখতে পেলেন? পেলেন না তো? কারণ লিওনার্দোর কাছে ওদের কেউই ভগবান নন, এমনকি যীশুও। তাই মাথার পেছনে ওই সাদা থালা থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না!

২. যীশু তো ভোজ সেরেছিলেন রুটি আর ওয়াইন দিয়ে, তাহলে খাবার টেবিলে মাছ এলো কোথা থেকে? মাছটা হেরিং মাছ, ইউরোপে খুব পাওয়া যায়। ইতালিয়ান ভাষায় হেরিং এর উচ্চারণ হয় রেঙ্গা, যার মানে-
সেই মানুষ যে ধর্মকে পরিত্যাগ করেছে!

৩. সবার প্লেটে খাবার থাকলেও জুডাসের প্লেট ফাঁকা, কারণ সে অন্তঃসারশূন্য, যীশুর কথা শুনে জুডাসের হাত থেকে নুনের শিশিও পড়ে গেছে, নুন ছড়িয়ে পড়েছে টেবিলে। ইতালীয়দের কাছে নুন পড়ে যাওয়াটা অমঙ্গলের প্রতীক।

৪. জুডাসের পিছনে একটা হাতে ধরা ছুড়ি, কার হাত বোঝা যায় না, যেন নিয়তি বিশ্বাসঘাতককে চিনিয়ে দিচ্ছেন।

৫. এবারে আসি সবচেয়ে বড় রহস্যতে, লাস্ট সাপারের ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু তে আছেন যীশু আর তার সুরাপাত্র, যা থেকে তিনি বাকি শিষ্যদের পাত্রে ওয়াইন ঢেলে দিয়েছিলেন। খ্রীশ্চানরা একে বলেন হোলি চ্যালিস, দারুন পবিত্র একটা বস্তু ওদের কাছে।

তা এবারে লিওর ছবিটার দিকে তাকান তো একবার, যীশুর সামনে কোন চ্যালিস দেখতে পাচ্ছেন কি? নেই, একটা প্লেট আর কয়েক টুকরো পাউরুটি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তাহলে কি লিওনার্দো ভুলে গেলেন চ্যালিসটা আঁকতে? তা কি সম্ভব আদৌ? চার বছর সময় নিয়ে তিনি ছবিটা এঁকেছিলেন, তার এতদিনের স্বপ্ন এটা, এত বড় ভুল কি করতে পারেন নাকি থোড়াই! লিওর চ্যালিস আঁকতে ভুলে যাওয়াটা বিরিয়ানিতে আলুর টুকরো না দেওয়ার মতো মারাত্মক ভুল।
না, লিও ভুল করেননি, চ্যালিস আছে, কিন্তু সেটা দেখার চোখটাই যে নেই আমাদের!

যীশু আর তার ডানদিকের মানুষের মাঝের ফাঁকটা লক্ষ করেছেন, অদ্ভুত রকমের বেশি না? বাকিদের দেখুন, লিওকে বাকিদের বেশ কসরত করে আঁকতে হয়েছে, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে তারা। সন্ত থমাসের তো শুধু মুন্ডু আর ডানহাতের তর্জনী ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান নয়। তাহলে এতো বড় জায়গা মাঝখানে ছেড়ে রাখার অর্থ কি?

লিওনার্দো ছিলেন ঘোর পেগান, পেগানরা মাতৃয়ার্কিতে ( নবনীতা দেবসেনের থেকে ধার করলাম শব্দটা) বিশ্বাসী ছিলেন। একটা বড় হাতের A ভাবুন, এবারে মাঝের পেট কাটা লাইনটা বাদ দিয়ে দিন, ^ এরকম লাগবে দেখতে, পেগান দের মতে এটা পুরুষের প্রতীক, যা শিশ্ন কে বোঝায়।
আর এটা উলটে দিলেই পাবেন V।

যা নারীর প্রতীক,

যার মানে গর্ভ,

যা ধারন করে,

মানে পাত্র,

মানে চ্যালিস!

লিওর লাস্ট সাপারের লুকোনো চ্যালিস হল যীশুর ডানদিকের V টা। যেন লিও অব্যক্তে চিৎকার করে বলতে চাইছেন,

এই পুরুষের এক নারীও আছেন!

যীশুর কাঙ্ক্ষিত নারী! তা আবার হয় না কি? হ্যাঁ হয়। যীশুর স্ত্রী মেরি ম্যাগডালেনকে নিয়ে অনেক কথা অনেক গল্প আছে, এই লেখার পরিসরে সেটা হয়ে উঠবে না। অন্য আরেকদিনের জন্য তোলা থাক না হয়।

যারা ড্যান ব্রাউনের দা ভিঞ্চি কোড পড়েছেন তারা নিশ্চয় ভাবছেন লাস্ট সাপারে লুকিয়ে থাকা মেরি ম্যাগডালেনকে নিয়ে আমি কেন কিছু বলছি না, যারা বই টা পড়েননি তাদের জন্য বলি যীশুর ডানদিকের শিষ্যের দিকে নজর দিন, পুরুষ বলে কি মনে হচ্ছে আদৌ? মুখে পেলবতা, সোনালী লম্বা চুল, কামানো ভ্রু, উনি কি তাহলে একজন মহিলা? কিন্তু ১২ শিষ্যের একজনও তো নারী ছিলেন না, তবে কি, তবে কি উনিই মেরি ম্যাগডালেন, যীশুর পাশে থেকে তৈরি করেছেন V এর আকারটা, যা কিনা আবার নারীরই প্রতীক! অন্তত মিস্টার ব্রাউন এমনটাই দাবী করেছিলেন। কিন্তু এই দাবী একান্তই অমূলক। উনি আর কেউ নন, সন্ত জন। জনের অবয়ব নারীসুলভ। অন্যান্য শিল্পীর আঁকা লাস্ট সাপারের ছবিতেও জন এরকমই। লুকের গসপেলেও এরকমই বর্ননা আছে জনের।

মায়েস্ত্রো লিওনার্দো অ্যালিগরির যাদুগর ছিলেন ঠিকই, কিন্তু লাস্ট সাপারে ম্যাগডালেনকে আঁকার প্রয়োজন বোধ তিনি করেননি। তবে ম্যাগডালেনের উপস্থিতি রেনেসাঁর অনেক শিল্পীই তাদের সৃষ্টির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন!

তাও বলব,
তবে আজ নয়।

 

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ http://www.independent.co.uk

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds