হিস্ট্রির মিস্ট্রি – ৩ ~ ঈশ্বরের ফল

Anirban & Arijit, History, Series, বাংলা, হিস্ট্রির মিস্ট্রি

সৃষ্টির প্রথম দিনগুলোতে-

ভগবান ইডেন উদ্যানের ধুলো থেকে তৈরি করলেন আদমকে, কাঁধে হাত রেখে বললেন, এই জমি তোমার, এই ঝর্না তোমার, এই বাগান তোমার, এই মাটিতে তুমি ফসল ফলাও, বাস কর, এই এই…এই নাও, তোমার পাঁজর থেকে তৈরি করে দিলাম তোমার নারীকে, একে তুমি ইভ বলে ডেকো।

প্রথম পুরুষ তার নারীকে নিয়ে ভালই ছিল, দুজনেই নগ্ন, নিষ্পাপ, নিজেদের সত্তা নিয়ে কারোর মনেই প্রশ্ন নেই। আবহমান কাল ধরে এমনটাই চলতে পারত, কিন্ত একদিন একটা সাপ ইভ কে একান্তে পেয়ে বলল,

-এই মেয়ে, এদিকে আয়, এই ফলটা পেড়ে খা, তোর চোখ খুলে যাবে।

ইভ ফলটা তো খেলোই, তার ভাগ দিল আদমকেও। দুজনেরই চোখ খুলে গেল, পাপ,লজ্জা,কষ্টর সাথে আলাপ হল। মন দুটো উন্মুক্ত হয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করল নিজের অস্তিত্ব কে।

সৃষ্টিকর্তার কিন্তু এই বেয়াদবি একদম পছন্দ হল না, নিজের খেলার পুতুল যদি চোখের দিকে চোখ রাখে তাহলে তো রাগ হবে বইকি। ব্যাস আর কি, নির্বাসিত আদম ইভের যায়গা হল পৃথিবীতে। সেই শুরু মানুষের। সুখ,দুঃখ, লোভ, কাম,ক্রোধ,জ্বরা ঘিরে চলল তার যাপন। আর সেই দিন থেকেই ভগবানকে ভয় করতেও শিখল সে, জানল এই মহানের সামনে হৃদয় কম্পমান,চোখ অবনত, নতশির। মনের জানলা গুলোও তখন বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

 

আরো অযুত হাজার বছর পরে-

– আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
– হ্যাঁ, করি।
– আর খ্রীস্টে?
– না করি না।
– সে কি কথা, যিশুই তো আমাদের ভগবান।
– যিশু একজন সাধারন মানুষ, ভগবানের বানী প্রচার করেছেন মাত্র!
– আচ্ছা বেয়াদপ তো আপনি, পিতা,পুত্র আর পবিত্র আত্মা, এই তিন নিয়েই ট্রিনিটি, আর আপনি কিনা..
– আপনাদের ট্রিনিটিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই, যিশু যদি পুত্র হন তাহলে তো আমি পিতারই পুজো করব।
– নাহ, আপনার আর হল না।
– হল না মানে?
– মানে আপনাকে আমরা এই কলেজের ফেলো বানাতে পারব না।

এই কথোকথন কোনও দুজন দার্শনিকের নয়, দুই বিজ্ঞানীর। আর কলেজটা হল ট্রিনিটি, কেমব্রিজের গর্ব। প্রথম বক্তা এক প্রবীন অধ্যাপক, আর দ্বিতীয়জন ২৬ বছরের এক ছোকরা আইজ্যাক। যে সদ্য পাস করেছে কলেজ থেকে।

না, আইজ্যাকের সময় খুব একটা ভাল যাচ্ছে না, কয়েকবছর আগেও ক্ষেতে কাজ করছিল, নেহাত কাকা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে আইজ্যাককে শহরে নিয়ে এসেছিল, কাকারই সুপারিশে ভর্তি হয়েছিল ট্রিনিটিতে। তার মেধা আর প্রজ্ঞার আলোতে তাক লেগে গেছে শিক্ষকদের। কলেজের পাট চুকোবার আগেই বাইনোমিয়াল থিওরেম আবিস্কার করে ফেলেছে এই ছেলে।

এহেন প্রতিভার কেমব্রিজের ফেলো হওয়া তো সময়ের অপেক্ষা তাই না? কিন্তু না, সে শিকে ছিঁড়ল না আইজ্যাকের ভাগ্যে। ফেলো হতে গেলে খ্রীস্টধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে, মাথা নত করতে হবে যিশুর মুর্তির সামনে। আইজ্যাক নাস্তিক নয়, কিন্তু যিশু যে ঈশ্বর এ মানতে রাজী নয় সে, তাই চার্চের উগ্র ধর্মচেতনার চাপে কেমব্রিজের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে লাগল তার জন্য।

ঠিক তখনই মড়ক লাগল কেমব্রিজ শহরে, ভয়ংকর প্লেগের থাবাতে মৃতদেহের ভীড় জমতে শুরু করল শহরের রাস্তায়, ফুটপাতে, নালায়। তখনও এই মারণ রোগের প্রতিকার জানা নেই কারোর, তাই একরকম বাধ্য হয়েই শহর খালি করে দিতে হল, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিও বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্ট কালের জন্য, আইজ্যাক চলে এল উলথর্প ম্যানরে, মায়ের কাছে।

১৬৬৬ র একদিনে এই বাড়িরই বাগানে ছেলেটা বসে আছে। সবে মাত্র ডিনার হয়েছে, কিন্তু কোন রাতেই ঘুম আসে না ওর। কেপলারের খুব বড় ভক্ত আইজ্যাক, কিন্তু কেপলার বলে গেছে পৃথিবী আর চাঁদের গতিপথ গোল চাকতির মতো নয়, বরং অনেকটা ডিমের মতো। এইটা
কেন সেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারে না।

এমন কি শক্তি আছে যা গ্রহ গুলোর গতিপথ চ্যাপ্টা করে দিয়েছে?

এইসবই ভাবছিল সেদিন ও বাগানে গাছের নিচে বসে। এই সেই গাছ, যার ফল খেয়ে চেতনা পেয়েছিল আদম আর ইভ, নেমে আসতে হয়েছিল এই রুক্ষ পৃথিবীতে।
আইজ্যাক নিজের মনে ভেবে চলেছে, খাতার পাতা ভরে যাচ্ছে জ্যামিতিক উপপাদ্যে, কিন্তু হিসাব যে কিছুতেই মিলছে না।

এমন সময়ই টুপ করে একটা ফল পড়ল সেই গাছ থেকে, আর মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুতপ্রবাহ খেলে গেল আইজ্যাকের সুষুম্না বেয়ে! আচ্ছা ফলটা কেন মাটিতেই পড়ল? বাতাসে তো ভেসেই থাকতে পারত, অথবা সাঁই করে উঠে যেতে পারত আকাশের দিকে। তবে কি পৃথিবীটা টানছে ফলটাকে? নেহাত পৃথিবীর ভর বেশি, ফলের ভর বেশি হলে সেটাই হয়তো টেনে নিত মাটিকে নিজের কাছে। আইজ্যাক নিউটন এর নাম দিল গ্র‍্যাভিটাস, ল্যাটিন এই শব্দের মানে ওজন। সেই থেকেই এল গ্র‍্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণ।

উলথর্প ম্যানরের আপেল গাছ টা আর নেই, কিন্তু তার কলম থেকে বানানো আরেকটা আপেল গাছ আছে কেম্ব্রিজের বোট্যানিকাল গার্ডেনে।

আরো একবছর পরে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি আবার খুলেছিল। এই ঘটনার তেরো বছর পারে নিউটন প্রমান করেন দুরত্ব বাড়ার সাথে সাথে আর ভর কমার সাথে সাথে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও কমে যায়, তাই গ্রহ গুলো ওরকম ডিমের মতো পথে ঘরে, আর তাই জন্যই হুমড়ি খেয়ে পরে না সুর্যের ওপর। এই আবিষ্কার হয়েছিল কিন্তু কেমব্রিজে বসেই, হ্যাঁ ১৬৬৭ তে কেমব্রিজ খোলার পরেই আইজ্যাককে ফেলো করে নেওয়া হয়, রাজা দ্বিতীয় চার্লসের হস্তক্ষেপে। নিজের ধর্মচেতনার সাথে বিন্দুমাত্র আপোস করেননি নিউটন। চার্চকেই মাথা নত করতে হয়েছিল বিজ্ঞানের কাছে।

 

 

বছর ৬৫ আগে-

৩১শে মার্চ, ১৯৫২,
৪০ বছরের অ্যালান ট্যুরিং বেড়িয়ে আসছেন লন্ডনের কোর্টরুম থেকে, হতাশায় কাঁধ ঝুলে গেছে, কিন্তু চোয়াল শক্ত। এই লোকটা কে নিয়ে তো কদিন আগেই মাতামাতি করছিল গ্রেট ব্রিটেন। লোকটা নাকি একাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে থামিয়ে দিয়েছে, সেটাও ব্লেচলি পার্কের একটা ছোট্ট ঘরে বসে। ট্যুরিং এর বানানো মেশিন হারিয়ে দিয়েছে জার্মান এনিগমা মেশিনকে। যার জন্য দূরহ সাইফার গুলো কে ডিকোড করা হয়ে গেছে জলভাত।

আর এই সাইফার গুলোই ছিল লুকিয়ে থাকা জার্মান আউটপোস্ট গুলোর মধ্যে যোগাযোগের এক মাত্র মাধ্যম। অ্যাটল্যান্টিকের নিচে লুকিয়ে থাকা একটাও জার্মান সাবমেরিনও রক্ষা পায়নি মিত্রশক্তির হাত থেকে। এই একটা আবিস্কার নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আয়ু দু বছর কমিয়ে দিয়েছে! বাচিয়েছে প্রায় ১৪ কোটি মানুষের জীবন।

অ্যালান ট্যুরিং এর বানানো প্রথম কম্পিউটিং মেশিন।

 

এহেন মানুষকে নিয়ে তো বিজয় গাথা লেখা হওয়া উচিত, রানী খুশি হয়ে নাইটহুড দিয়ে ফেললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই, তাহলে ট্যুরিং কোর্টে কি করছিলেন?

ট্যুরিং এর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা চলছিল, আর মামলার আরেকদিকে ছিল ব্রিটিশ সভারিন স্বয়ং।

দোষটা কি ছিল ট্যুরিং এর? উনি ১৯ বছরের একজনকে ভালবেসেছিলেন। তা ভাল, কিন্তু সে যে পুরুষ! সমকামিতা, সোডোমি এগুলো তো খ্রীষ্ট ধর্মে পাপ! চার্চ কি বলবে? কি করে ইংল্যান্ড মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বিশ্বের কাছে? কে বলবে আর লং লিভ দা কুইন? না, একে তো কোনমতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না! অংকুরেই বিনাশ করতে হবে এই বিকৃত মানসিকতার।

তাই ট্যুরিং এর বিচার হল, বিচার বলা যায় না যদিও, সেইদিন ট্যুরিং এর স্বপক্ষে একজন উকিলও দাঁড়ায়নি কোর্টে। ‘রেজিনা ভারসাস ট্যুরিং’ মামলার রায় দাঁড়াল এই যে, মিস্টার অ্যালান ট্যুরিং একটি মানসিক রোগী। তার সামনে দুটো পথ খোলা এখন, হয় যাবজ্জীবন কারাবাস, তা না হলে ট্যুরিংএর এই ‘রোগের’ চিকিৎসা। সেইদিন মানুষটা দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছিল। বাকি জীবন গরাদের ওপাশে থাকলে তার নিজের বাকি রয়ে যাওয়া কাজগুলোর কি হবে?

শুরু হল ট্যুরিং এর ট্রিটমেন্ট। জানোয়ারটার যৌন ইচ্ছা কমিয়ে ফেলতে হবে আগে, কি ভাবে? ওষুধ দিয়ে নপুংসক বানিয়ে দেওয়া যাক।

সপ্তাহে একদিন করে চলতে লাগল ইঞ্জেক্সশন, আর বাকি দিনগুলো ট্যুরিং মাথা নিচু করে নিজের গবেষনার কাজ করে যেতে লাগলেন, তৈরি হল প্রথম কম্পিউটারের নকশা, প্রথম কম্পিউটারের চেস অ্যালগোরিদম ও এল। আর তার মধ্যেই ট্যুরিং এর ওজন কমে যেতে থাকল, শরীর হয়ে গেল নির্লোম, নারীসুলভ স্তনের আভা দেখা দিল, হাড় হয়ে গেল ভঙ্গুর।

একদিন হার মানলেন ট্যুরিং, ৭ই জুন,১৯৫৪, রাতে শোয়ার আগে একটা ফল ডুবিয়ে নিলেন বিষাক্ত সায়ানাইডের দ্রবণে। এক কামড় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, যে ঘুম আর ভাঙেনি।

এই ফলটাই সেটা যা আদম ইভের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছিল, দেবতা ভয় পেয়েছিলেন সেদিন, এই ফলই নিউটনের হাতে তুলে দিয়েছিল মহাজাগতিক রহস্যের চাবিকাঠি, আর এই ফলই স্বাক্ষী থাকল ট্যুরিং এর শেষ মুহূর্তের, যেদিন বিজ্ঞান হেরে গিয়েছিল ধর্মের কাছে। ঈশ্বর আর মানুষের টানাপোড়েন চিরন্তন, সৃষ্টি বার বার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে স্রষ্টাকে। আর এই একটা ছোট লাল ফল তার সাক্ষী থেকেছে যুগে যুগে।

এরপর যখন একটা আপেল খাবেন, এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভাববেন। আপনার ঈশ্বর হয়ত মুচকি হাসছেন তখন।

 

 

লেখক ~ অনির্বাণ ঘোষ

প্রচ্ছদচিত্র উৎস ~ http://www.independent.co.uk

প্রচ্ছদচিত্র অলঙ্করণ ~ Anari Minds

3 comments

Comments are closed.