আমার শীতের আদরটা

Anirban & Arijit, Childhood, Nostalgia, আদতে আনাড়ি, বাংলা

“ভিটি! জলদি আয়! ‘আবার যকের ধন’ শুরু হয়ে গেছে!”

 

আমি তখন খুব খুব ছোট, এই পাঁচ-ছয় বছর বয়স হবে। তখন আমরা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। দুটো কামরা আর এক ফালি রান্নাঘর নিয়ে। বাড়িটা চৌকোমতন, দোতলা, একপাশে সারি দিয়ে তিনটে কলঘর। লাল মেঝে, হলুদ রঙের দেওয়াল। এক তলায় ভাড়াটেরা, আর দোতলার বাড়িওয়ালা। কিন্তু আশ্রয়দাতা আর আশ্রিতের তফাত বুঝতে পারিনি। একতলা থেকে দোতলায় বাটিতে করে মাংস যেত, সেই বাটি আবার সন্ধ্যেবেলায় ফিরত গরম পায়েস নিয়ে। আমি আর ভাই কতদিন ওপরের দুই কাম্মার কাছে ঘুমিয়েছি। কাকিমা বলতে পারতাম না, তাই কাম্মা। ওদের দুই মেয়ে। একজন আমার থেকে একটু বড়, আরেকজন ভাইয়ের বয়সী। চারজনে একসাথেই বড় হচ্ছিলাম, কখনও মনে হয়নি আমাদের মায়েরা আলাদা।

 

এমনই একটা শীতের দুপুরের কথা, প্রাইমারীতে পড়ি, তাই দেড়টায় বাড়ি চলে আসি। আর ঠিক দুটোর সময় দোতলা থেকে বুবুনদিদির ডাক,

 

“ভিটি! জলদি আয়….”

 

দে দৌড়, দে দৌড়। আমি তখন একটা লাল সোয়েটার আর হাফপ্যান্ট পরে দৌড়চ্ছি দোতলায়। কালকেই সিংহদমন গাটুলা সর্দারকে নিয়ে কুমাররা গুহায় ঢুকেছিল, আজকে কি হবে! জানতে হবে তো নাকি!

 

একছুটে যখন উঠোন পেরোচ্ছি তখন উঠোনে শব্দ উঠছে,

ঘটাং, ঘটাং।

ঘটাং,ঘটাং।

 

ধুনুরী এসেছে, মা পুরনো দুটো শাড়ি বার করে দিয়েছে। উঠোনের মাঝখানে বসে ধুনুরী তুলো ধুনছে।

 

ঘটাং ঘটাং।

 

উঠোন ময় ছেঁড়া ছেঁড়া তুলো উড়ছে। আর একটা অদ্ভুত গন্ধে ভরে আছে চারপাশটা। ওই তুলো এর পরে ঢুকে পড়বে শাড়ীর মাঝে। মোটা লাল সুতো দিয়ে মোড়া হবে তার চারপাশ। মাঝে খানেও সেই লাল সুতোর সেলাই থাকবে। তৈরী হবে লেপ। হালকা, তুলতুলে, বেশ একটা আদরের মতো। দুপুর বেলায় মা সেই লেপ ছাদে দিয়ে আসবে। আর রাতে আদরটা গায়ে দিয়ে আরামের ঘুম আসবে। স্বপ্নে আমি বিমল,কুমারের সাথে জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব।

 

সব মানুষের জীবনে একটা ব্রাত্য মানুষ থাকে। যাকে সারাবছর কেউ মনে রাখে না। সেই লতায় পাতায় দূর সম্পর্কের ছোট কাকার মতো। যার বিয়ে হয়নি, একা থাকে, কোথায় থাকে তাও কারও মনে নেই। কিন্তু সে কাজ করে রেলে। আর তার ফোন নাম্বারটা এক রয়ে যায়। তাই প্রতিবার পুজোর আগেই..

 

“কিরে কেমন আছিস? ভাল তো? আচ্ছা শোন না, এন জিপির টিকিট কেটেছি কিন্তু সেই আর.এ.সি তে, তুই একটু দেখ না রে, গেল বারে তুই ছিলি ভাগ্যিস! তাই তো…”

 

বাঙালী বাড়িতে লেপ কম্বল গুলো সেই ছোটকার মত। বাকী সময়টা কেউ মনে রাখে না। ঠিক ভাইফোঁটাটা শেষ হবে, একটু একটু করে শিরশিরানি বারবে ভোরগুলোতে, পাশের বাড়ির কাকিমা জানলা দিয়ে মা কে বলবে,

 

“দেখেছ! এবারে শীতটা কেমন পিছিয়ে গেল না? আগের বছর এই সময়তেই তো..”

 

শীত নাকি প্রতিবছরই পিছিয়ে যাচ্ছে। বছরের শেষ অ্যাক্টে যখন সে আসছে তখন দর্শকরা বাড়ি যাবে বলে উসখুস করছে। তবু তো তাকে আসতেই হবে। দিন ছোট করে। কুয়াশা আর শিশিরকে বগলদাবা করে। আর তখনই আলমারীর ওপরের তাক গুলোয় হাত পড়বে। খাটের নিচ থেকে ট্রাঙ্ক বেড়বো। লেপগুলো গায়ে ন্যাপথলিনের গন্ধ নিয়ে উঠে আসবে বিছানায়। তখন থেকে মাস তিনেক ওরা সবার খুব জিগরি।

 

খুব ছোটবেলার লেপগুলো একটা বাড়ির মতো ছিল। আমেরিকায় টিনিটিন পড়ার পরে আমি আর ভাই সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের তাবু বানিয়েছিলাম। ওই লেপের তলায় লুকিয়েই খেলনা বন্দুক আর তীর ধনুকের লড়াই চলত। শত্রুপক্ষ যেন দেখতে না পায়! কেউ উঁকি মারলেই তাকে,

 

র‍্যাট ট্যাট ট্যাট!

সাঁই সাঁই!

 

কৈশোরে লেপটা আবার খুব ব্যক্তিগত হয়ে যায়। রাতে টর্চের আলোয় ফ্রান্সিস পড়া চলছে তখন। চারপাশের কালো জায়গাটা নিজের একটা পৃথিবী তৈরী করে নিচ্ছে। সেই লেপটাই আবার মন খারাপের কোল। বেশ কুঁকড়ে কেন্নোর মতো থাকা যায় ওর মধ্যে। লুকিয়ে কাঁদা যায়। লেখা যায় টুকটাক একটা দুটো চিঠি। আবোলতাবোল পদ্য। তারপর একদিন লেপটা বলে ওঠে,

 

“এই ছেলে, কি করছিস! কি করছিস! ইসস..”

 

বয়সের নিয়ম মেনে যৌনতা আসে। প্রথমে একা,পরে দুয়ে। সৃষ্টির নামে যে খেলা শুরু হয় সেটা সাঙ্গ হওয়ার সময় লেপ,কম্বল কি রাজাইটা গুটিয়ে থাকে পায়ের কাছে। তার অনেকটা তখন বিছানার বাইরে ঝুলছে। একটু পরে আবার শীত শীত লাগলে তাকে টেনে নেওয়া যাবে খন। প্রথমে যে উষ্ণতাটা ভাগ করে নেওয়ার ছিল পরে সেটা ভাগ হয়ে যায়। মাঝে আসে হিসু মাখা ওয়েলক্লথ। আর ছোট্ট ছোট্ট কাঁথা, একটা ছোট্ট লেপ। একটা থেকে দুটো রাজাই হয়। ছোট্ট লেপটার দুপাশে সহবাস করে পাশাপাশি। কখনও ওরা মেলে। কখনও হাত ছুঁয়েই থেকে যায়।

 

এই পরবাসে সাথে করে আনতে পারিনি আমার তুলোর আদরটাকে। এখানে পলিয়েস্টার, ডাক ফেদার, থিন উলের কম্বল। তার গাল ভরা নাম ডুভে। অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল, এক্সট্রা কমফোর্ট, আল্ট্রা লাইট..মোদ্দা কথায় অনেক স্বাচ্ছন্দ্য, ওইটাকেই এখন আমি আরাম বলি।

 

ছোটবেলায় ধুনুরী চলে যাওয়ার পরে উঠোন জুড়ে তুলোর বীজ পরে থাকত। কুড়িয়ে কুড়িয়ে জমাতাম এক জায়গায়। আর সেই মন কেমন করা গন্ধটা? যেটা পেড়িয়ে উঠে যেতাম দোতলায়?

দুটোই হারিয়ে গেছে যে।

 

এখন শত ম্যাজিকেও ফিরে পাব না ওদের।

Author – অনির্বাণ ঘোষ

Raw Cover Image: commons.wikimedia.org/wiki/File:Muhammad_Ainul_-_Howrah_2011-12-11_00912.jpg

Cover Image Design: Anari Minds