
হিস্ট্রির মিস্ট্রি-১৫ ভালোবাসার মৃত্যুরা
১.
– আচ্ছা, তোমার এই শক্তির রহস্য কি? আজকে তোমাকে বলতেই হবে।
ডেলাইলার এই কথায় স্যামসন হাসল একটু, রোজই হাসে। রোজ রাতের অন্ধকারে স্যামসন ডেলাইলার কাছে আসে। ডেলাইলা ওর শান্তির আশ্রয়। সারাদিন ফিলিস্তিনদের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত স্যামসন ডেলাইলার কাছে ভালবাসার সুখ খোঁজে। ওর কোলেই মাথা রেখে তলিয়ে যায় ঘুমে। আজকেও তেমনই একটা রাত।
– তুমি আমাকে ভালবাসো না স্যামসন।
– হটাৎ এমন কেন মনে হল তোমার।
– আমি জানি, ভালবাসো না তুমি আমাকে।
ক্লান্ত স্যামসন আবার প্রশ্ন করে,
– ভালবাসি তোমাকে সত্যি, বিশ্বাস করো।
– না বাসো না ভালো।
– কি করে বুঝলে?
– আমি তো তিনদিন ধরে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছি একটা কথা, মিথ্যে উত্তর দিচ্ছ।
– ওহ, এই ব্যাপার।
– তুমি চাও না আমি তোমার শক্তির রহস্যটা জেনে যাই। তুমি আমাকে তোমার শত্রু ভাব তাই না?
– না না ডেলাইলা, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।
– তাহলে বারবার মিথ্যে বলছ কেন? বললে টাটকা বানানো ধনুকের ছিলা দিয়ে বাঁধলে তোমার শক্তি হারিয়ে যাবে, আমি বাঁধলাম, তুমি সেই ছিলা ছিঁড়ে কেমন বেড়িয়ে এলে। তারপরে বললে তোমার চুল গুলোতে গিঁট বাঁধলে তুমি দুর্বল হয়ে পড়বে। আমি তাও করলাম, তাও তো কিছু হল না। মিথ্যুক তুমি। ভালবাসো না আমাকে।
প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করে এবারে স্যামসন,
– তোমার ছেলেমানুষি দেখে আমি মজা করছিলাম ডেলাইলা। আমার নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি আমি তোমাকে। এমন কিছু নেই আমার যা তোমার থেকে গোপন করেছি।
– আবার মিথ্যে, প্রবল পরাক্রমী স্যামসন যে একা হাতে সিংহ মারে, যে বার বার বিশাল ফিলিস্তিনি সেনাদের হারিয়ে দিচ্ছে তার শক্তির রহস্যটাই অজানা আমার কাছে।
– তোমাকে জানতেই হবে ডেলাইলা?
– তুমি আমাকে ভালবাসো স্যামসন, তোমার কিছু তাহলে গোপন থাকবে কেন আমার কাছে?
এবারে স্যামসনের মাথা নিচু হয়,
– আচ্ছা শোন তবে, আমি নাজারাইত। নাজারাইতরা ভগবানের খুব কাছের হয় জানতো। আমার সব শক্তি লুকিয়ে আছে আমার লম্বা চুলে। জন্মাবার পর থেকে আমি কখনও চুল কাটিনি জানো। ভগবানের আশির্বাদে এই চুলেই লুকিয়ে আছে আমার শক্তি।
– সত্যি বলছ!
– হ্যাঁ, আজকে আমি সত্যি বলছি, এবারে তুমি খুশি তো?
– হ্যাঁ, এবারে আমি খুশি, সত্যিই আমাকে তুমি ভালবাসো। তুমি এবারে ঘুমোও স্যামসন।
ক্লান্ত স্যামসনের চোখ এবারে বুজে আসে। রোজকার মতো ডেলাইলার কোলে মাথা রেখেই সে ঘুমিয়ে পরে আজও।
একটু পরে স্যামসনের যখন ঘুম ভাঙে তখন ওকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ফিলিস্তিন সেনারা। প্রথম ফিলিস্তিন সেনার আঘাতটা প্রতিহত করার সময়তেই স্যামসন বুঝল তার ঈশ্বর তাকে ত্যাগ করেছে, ওর অতুলনীয় শক্তি কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন খেয়াল হল ওর কাঁধ অবধি ছেয়ে থাকা চুলগুলোর কথা। সেগুলো তো নেই আর!
যখন স্যামসন তার গভীরতম ঘুমে আচ্ছন্ন তখন ডেলাইলার ঘরে ঢুকে এসেছিল এক বুড়ি আর একটা অচেনা লোক, কপটতা তাদের চোখে মুখে, কপটতা ডেলাইলার মুখেই বা কম কি? সুন্দরীর ঠোঁটে এখন বাঁকা হাসি। অন্ধকার ঘরে একটা বাতি জ্বালিয়ে বুড়ি স্যামসনের মাথার ওপরে ধরেছিল। অন্য লোকটার হাতে আবার কি ওটা? একটা কাঁচি! নিপুণ হাতে সে এবারে কেটে নিয়েছিল স্যামসনের মাথার চুল গুলো। স্যামসনের ঘুম তখন ভাঙেই না, ডেলাইলার কোলটাই যে ওর বিশ্বাসের বালিশ।
স্যামসনকে ধরে ফেলে প্রথমে ওর চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়। তারপরে অশক্ত, দুর্বল মানুষটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্ধকুপে। তার খবর আর কেউ রাখেনি।
আর ডেলাইলা? যাকে স্যামসন ভাল বেসেছিল অন্ধের মতো? যার জন্য তাকে অন্ধই হতে হল শেষমেষ?
না, ডেলাইলা স্যামসনকে ভালবাসেনি কোনদিনও, হয়ত ভালবেসেও ছিল। কিন্তু কয়েক হাজার রুপোর মুদ্রার সামনে সেই প্রেমটা তুচ্ছ হয়ে গেছিল। ডেলাইলা শুধু স্যামসনের দুর্বলতাকে বিক্রি করেনি। স্যামসনের বিশ্বাসেরও সওদা হয়েছিল সেদিন।
পিটার পল রুবেনসের আঁকা ডেলাইলা আর স্যামসনের ছবিতে ডেলাইলার ঘরে একটা ভেনাস আর কিউপিডের মূর্তি রাখা আছে। তাতে প্রেমের দেবতা কিউপিডের মুখটা বাঁধা। ভালবাসার পিঠে ছুরি মারার এই মুহূর্ত গুলো যে মূকই হয়।

||
২.
ওফেলিয়া গান গাইছে,
আর একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে।
হ্যামলেটকে তো ও খুব ভালবাসত, ডেনমার্কের রাজকুমার নিজের ইচ্ছা মতো কাউকে বিয়ে করতে পারবে না, সেটা জেনেও ভালবাসত হ্যামলেটকে। নিজের সবটুকু দিয়েছিল ও মানুষটাকে। নিজের বাবা পোলোনিয়াস আর দাদা লাইয়ারতিসের সাবধান বানী অসাড় লেগেছিল ওর। কত স্বপ্ন দেখেছিল ওফেলিয়া।
হ্যামলেট হয়ত সেই স্বপ্নগুলো দেখেনি। ওর ঘোলাটে আত্মস্বার্থের পরিধিতেও ছিল না ওফেলিয়া। তাই তো ওকে বারবার আঘাত করতেও হ্যামলেটের মনে একটুও কাঁপন ধরেনি। তা না হলে নিজের ভালোবাসার মেয়েটিকে কেউ বেশ্যালয়ে যাওয়ার কথা বলে? কেউ তাকে অপমান করে সবার সামনে? হ্যামলেট তো করেছিল। কিন্তু তাও ওফেলিয়া ভালবেসেছিল ওকে।
কিন্তু এটা কি হয়ে গেল? হ্যামলেট যে ওর বাবাকে হত্যা করেছে! তাতে তো একটুও অনুতপ্ত নয় ও। ওর নিজের ভালোবাসার মানুষটা যেন ওর বুকেও ছুরি বসিয়েছে একসাথে। আর তো ফেরার কোন রাস্তা নেই ওফেলিয়ার। ওর চোখের সামনে থেকে পরদা গুলো সরে যাচ্ছে, আর তো কিছুই সামনে নেই আঁকড়ে ধরার মতো। একটা মেয়ে তার ছোট্ট একটা না পাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সব হারিয়েছে ওফেলিয়া, আজ ও বীতশোক। পরিস্থিতির আঘাতে ওর মস্তিষ্কেও জট পাকিয়েছে যে। সেখানে ভূত,ভবিষ্যত, বর্তমান… কিচ্ছু নেই। ওফেলিয়া উন্মাদ হয়ে গেছে। ওর আত্মাটা আর নেই যেন ওর শরীরে। তাই ছোট নদীটায় যখন ও আজকে পরে গেল তখন আর উঠে আসার কোন চেষ্টা ছিল না। চারপাশে নুয়ে থাকা রঙিন ফুলগুলোও টানেনি আজ ওকে।
ওফেলিয়া গান গাইছে, সেই গানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে শুধু প্রলাপ। শব্দ গুলোও কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। কোনও প্রাণ নেই আর সেই গানেতে। প্রথমে পরনের কাপড়ে ঢুকে থাকা হাওয়া ভাসিয়ে রাখছিল জলকন্যাকে। তারপরে তা ভারী হয়ে গিয়ে অতলে টেনে নিচ্ছে তাকে।
ওফেলিয়া একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে।
মরে যাচ্ছে ওফেলিয়া,
যেমন করে ওর প্রেম মরে গিয়েছিল।

||
৩.
আমস্টারডাম শহরে রেমব্রাকে চেনে না এমন কেউ নেই। শুধু আমস্টারডাম কেন? গোটা ইউরোপেই ডাচ পেইন্টিংয়ের মুখ এই আঠাশ বছরের যুবক। ওর ছবিতে আমস্টারডাম শহর অন্য রূপ পায়। তুলির টান ইউরোপের বাকি সব আঁকিয়ের থেকে আলাদা। দূর থেকেও একটা ছবি দেখলেই বলা যায় হ্যাঁ এটা রেমব্রার আঁকা বটে।
আজকে রেমব্রা ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করেছেন ফ্লোরা। রোমান ফুলের দেবী। যে কিনা আবার বসন্তও নিয়ে আসে। রেমব্রার মডেল আজকেও সেই মেয়েটি যাকে রেমব্রা আগেও বারবার এঁকেছেন, এবং পরেও একেই আঁকতে থাকবেন। কিন্তু মেয়েটি যে গর্ভবতী ! তাতে রেমব্রার কিছু যায় আসে না যদিও, রোমান দেবীর থেকে সামনে বসে থাকা মেয়েটি তার কাছে বেশী প্রিয়, তাই ক্যানভাসে যে ফ্লোরার ছবি ফুটে উঠল তারও উদর স্ফীত।
সাসকিয়া ভ্যান উলেনবার্গ, প্রবল বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে। বাবা ছিলেন নাম করা উকিল। ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে এই মেয়ে বড় হতে থাকে কাকার কাছে, কাকাও বেশ ধনীলোক। আমস্টারডামের প্রথম সারীর আর্ট ডিলারদের মধ্যে একজন। টুকটাক ছবি আঁকার নেশাও আছে। এই কাকার স্টুডিওতেই একুশ বছরের সাসকিয়ার সাথে আলাপ হয় সাতাশ বছরের রেমব্রার। প্রেমে পড়তে সময় লাগেনি কারোরই। দুজনের আর্থসামাজিক তফাত আকাশ পাতাল হলেও শুধু এই ভালবাসার জন্য সাসকিয়া বিয়ে করে নিতান্তই মধ্যবিত্ত এই আর্টিস্টকে। রেমব্রার জীবনটাই বদলে যেতে থাকে তারপরে। একের পর এক দুর্দান্ত ছবি প্রসব করে ওর ক্যানভাস। সাসকিয়াও সবসময় আগলে রাখে শিল্পী মানুষটাকে। রেমব্রার ছবিতে বেশিরভাগ নারীই তৈরি হয় সাসকিয়ার আদলে।
১৬৩৪ সালে রেমব্রা যখন ফ্লোরার ছবি আঁকছেন তখন সাসকিয়া গর্ভে তাদের প্রথম সন্তান। ছেলের নাম রেখেছিলেন রুমবের্তাস, কিন্তু জন্মের পরেই সাসকিয়ার কোল খালি করে চলে যায় সে। পরের বারে এক কন্যাসন্তান এল, সেও রইল না। তার পরের বারে আরেকজন, না সেও তো চলে গেল। সাসকিয়া আর আগের মতো নেই। ধীরে ধীরে মেয়েটা ডুবে গেল অবসাদে। মুখেও ছাপ এল তার। রেমব্রা কিন্তু তাও সাসকিয়াকেই এঁকে যেতে থাকলেন।
১৬৪২ এ চতুর্থ সন্তানের জন্মের একবছরের মাথায় সাসকিয়া মারা গেল টিউবারকিউলোসিসে। রেমব্রার ভিতরের শিল্পীটাও সেদিনই নষ্ট হয়ে গেল। জীবনের রঙ ওকে ছেড়ে চলে গেল। তার সাথে সাথে ক্যানভাসও ভরে উঠতে থাকল সাদা কালো হিজিবিজি আর স্কেচে। সাসকিয়ার মৃত্যুই রেমব্রার শেষের শুরু। একটা ফুটফুটে মেয়ে মরল, আর তার সাথে মরে গেল এক শিল্পী, রয়ে গেল শুধু তার ভগ্নপ্রায় শরীরটা।
কিন্তু সব ভালবাসাই বোধহয় ক্ষণস্থায়ী,তা নাহলে শেষ জীবনে কপর্দক শূন্য রেমব্রা সাসকিয়ার কবরটিকেও বিক্রি করে দেন কি করে।

||
৪.
কয়েকদিন আগেই খবরটা পেয়েছে ফ্রিডা, দিয়েগো নাকি আবার একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, এবারে মারিয়া ফেলিক্সের সাথে। মারিয়া দারুণ সুন্দরী, অসাধারন অভিনেত্রী। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল মারিয়া ফ্রিডার খুব কাছের বন্ধু, সেই মারিয়ার সাথেই..কি করে পারল ওরা?
বাইশ বছরের ফ্রিডা কাহলো ভালবেসে ফেলেছিল বিয়াল্লিশের দিয়েগো রিভেরাকে। দিয়েগো তখন মেক্সিকোর নামকরা মুরালিস্ট। আর ফ্রিডা? মাত্র একবছর আগেই একটা বাস অ্যাক্সিডেন্টে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে ওর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। শরীরেও প্রচুর আঘাত এসেছিল। কিন্তু সরে যাওয়া শিঁরদাড়া, ভাঙা কোমরও আটকাতে পারেনি ফ্রিডাকে। মেক্সিকো একটু একটু করে চিনছিল নতুন এক আর্টিস্টকে। তার ছবিতে কথা বলার মাধ্যমকে। দিয়েগো আর ফ্রিডা বিয়েও করে ফেলে কয়েক বছরের মধ্যেই।
দিয়েগোই ছিল ফ্রিডার জগত। অন্তর্মুখী মেয়েটার সবকিছু। ওর স্বামী,সন্তান, প্রেমিক..সব। কিন্তু মেয়েটা যে বড্ড রোগে ভোগে। শিরদাঁড়ার অসুবিধাগুলো কখনও ওর পিছু ছাড়েনি। সারাদিন পরে থাকতে হয় করসেট। অন্যদিকে দিয়েগো ওর স্বভাব-গুণেই নারী বিলাসী। ঘন ঘন জড়িয়ে পরে একের পর এক সম্পর্কে। প্রথম প্রথম ফ্রিডা এগুলোকে হেসেই উড়িয়ে দিত। সবার সামনে কোন আমলই দিত না এই সংক্রান্ত কথাগুলোয়। ভিতরে ভিতরে কি রক্তক্ষরণ হতো না? হতো তো বটেই, কিন্তু ফ্রিডা যে দিয়েগোকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছে। ও নিজেও কক্ষপথচ্যূত হয়েছে কয়েকবার। তাও ফিরে এসেছে দিয়েগোরই কাছে। একবার ডিভোর্সের পরেও আবার বিয়ে করেছে ওই মানুষটিকেই। তবে সম্পর্কটা হয়ত সত্যিই আর আগের মতো নেই। দিয়েগো হয়ত সত্যিই এবারে ফ্রিডার থেকে দূরেই চলে যাচ্ছে। নাহলে নিজের এত কাছের বন্ধুর সাথে..
ফ্রিডার তো কথা বলা ক্যানভাসেই। তাই আজও ও ক্যানভাসের সামনেই এসে দাঁড়াল। এর আগেও ও অনেকবার নিজেকে আর দিয়েগোকে এঁকেছে। তবে আজকের ছবিটা একদম অন্যরকম। আজকের ফ্রিডার মুখে বিষাদের ছায়া, চোখ থেকে কয়েকবিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো যেন গলা টিপতে আসছে ওর। আর ফ্রিডার কপালে আঁকা দিয়েগোর ছবি। তাকিয়ে আছে অন্যকারোর দিকে। ফ্রিডা যে শরীরে মনে দিয়েগোকে নিয়েই ঘুরছে। তাকে আলাদা করে রাখে কিভাবে?
দিয়েগোর কপালে একটা বাড়তি চোখ। সেই চোখে দিয়েগো কি দেখে সেটা হয়ত ফ্রিডা ভাল ধরতে পারেনা।কিন্তু তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
না, ফ্রিডা দিয়েগোর বিচ্ছেদ আর হয়নি। কিন্তু ওরা কাছেও হয়ত আসেনি আর, দিয়েগোর বহুগামীতা এর পরেও চলতেই থাকে। ফ্রিডা ভুগতে থাকে একের পর এক অসুখে, একসময় পঙ্গু হয়ে হুইচেয়ারে আশ্রয় নিতে হয়। গ্যাংগ্রিনের জন্য বাদ দিতে হয় ডান পা। বার বার চেষ্টা করেও আত্মহত্যা করতে পারেনি যে মেয়েটা তার জীবন একদিন শেষ হয়ে যায় পালমোনারী এমবলিজমে। বেঁচে থেকে অনেক শরীরের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, দিন কেটেছে মুঠো মুঠো পেন কিলারের ভরসায়। কিন্তু ফ্রিডার মনের কষ্টটা কমানোর ওষুধ ছিল না তো কোন। যাকে ও এত ভালবাসত সে হয়ত ওর সাথে থেকেও অধরাই রয়ে গেল। ফ্রিডা বুঝতে পেরেছিল ও মারা যাবে। তাই সেই দিন সন্ধ্যেতেই দিয়েগোকে দিয়েছিল বিয়ের অ্যানিভার্সারির উপহার। যদিও সেটা আসতে তখনও একমাস বাকি।
ফ্রিডার ডায়রিতে লেখা শেষ শব্দগুলো ছিল-
“ বেড়িয়ে যেতে পেরে খুব আনন্দ হচ্ছে, আর কখনো ফিরব না।”

||
৫.
প্যারিস শহরের উত্তর পশ্চিমে একটা ছোট মফস্বল, নাম ভেথেউলি। সেখানকার একটা বাড়িতে শোক নামছে রোজ একটু একটু করে। সেই বাড়ির একটা ঘরে শুয়ে আছে এক মেয়ে। বাঁ পাশের জানলা দিয়ে আলো এসে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে খাট বিছানা। খাটের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এক শিল্পী। সামনে রাখা ক্যানভাস।
মরে যেতে থাকা ক্যামিলকে আঁকছে ক্লদ মনে’।
খুব সাধারণ একটা মেয়ে ক্যামিল দসিয়ুঁ কে ভালবেসে বিয়ে করেছিল মনে’। নিতান্তই সিভিল ম্যারেজ, চার্চের বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। মনে’র বাড়ি থেকে সম্পর্কটাকে মেনে নেয়নি যে। ওদের সংসারে দারিদ্র তখন নিত্যদিনের সঙ্গী। পকেটে পয়সা নেই। মনে তখন নতুন ধরনের ছবি আঁকছে। প্যারিস শহর তখনো ইম্প্রেশনিস্টদের চিনে উঠতে পারেনি। তবে মনে’র খ্যাতি আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে মনে’র ছবিতেই সবাই চিনতে শুরু করে সুন্দরী ক্যামিলকে। আরেক শিল্পী রেনোঁয়ার ছবিতেও মডেল হতে থাকে ক্যামিল। ওকে সবাই প্যারিসের রানী বলে ডাকে। একসময় মনে’ আর ক্যামিলর আর্থিক অবস্থা ভাল হয়। প্যারিসের রাস্তায় দেখা যেতে থাকে সুখী দম্পতিকে। পরণে হাল ফ্যাশনের নতুন নতুন পোষাক।
তবে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ক্যামিলের জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পরে। তাতেই দুজনের ভালোবাসার গল্পে দাঁড়ি পরে। ক্যামিল যখন শেষ শ্বাসগুলো নিচ্ছে তখনও মনে’ চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রিয়তমাকে ধরে রাখতে। সেই শেষ মুহূর্ত গুলো তাই আটকে রইল ক্যানভাসে। বিছানার সাথে মিশে যেতে থাকা ক্যামিলা, তার মুখের ওপরে পাতলা কাপড়ের আচ্ছাদন। চোখ কোঠরাগত, গাল দুটো ভেঙে গেছে। ক্যানভাস জুড়ে আলো আছে, কিন্তু আনন্দ নেই। বিষাদের ছায়া সেখানে।
মৃত্যুসজ্জাতেই চার্চের মতে আবার বিয়ে হয় মনে’ আর ক্যামিলের। আর তার কিছু দিন পরেই ক্যামিল মারা যায়।

||
শেষের কথা-
আমাদের সবার মধ্যে একটা স্যামসন, ওফেলিয়া, সাসকিয়া, ফ্রিডা, মনে’ লুকিয়ে আছে। ওরা লুকিয়েই থাকে, আমরাই সামনে আসতে দি না। তাই বছর ঘুরলে ভ্যালেনটাইন’স ডে আসে, ভালোবাসার দিন। তাতে লাল গোলাপী প্রেমের গান কবিতা ছবি আঁকা হয়। ভালোবাসার বাকি রঙ গুলোকে ভুলে থাকার চেষ্টা চলে। জীবনের ক্যানভাসে বিষাদের হলুদ, হারিয়ে ফেলার ধূসর, বিষ আর বিশ্বাসঘাতকতার নীল রঙ মাখায় সবাই। কিন্তু বাইরে দেখাতে চায় না কাউকে। ওই ছবিগুলো লুকিয়ে রাখার হলেও ওদের অস্তিত্ব প্রবল। মাঝে মাঝে দুর্বলতায় বাইরে বেড়িয়েও পরে। মানুষ তখন সেটা চাপা দেয় আরেকবার ভালবেসে, তখন আরো একবার জড়িয়ে পরে। আরেক বার ঝিনুকে মুক্তো খোঁজার চেষ্টা করে।
বিচ্ছেদের অতৃপ্তি অবশ্যম্ভাবী জেনেও।
Author – অনির্বাণ ঘোষ
Cover Image Design: অনির্বাণ ঘোষ
One thought on “হিস্ট্রির মিস্ট্রি-১৫ ভালোবাসার মৃত্যুরা”
Asadharon!!
Comments are closed.