
হিস্ট্রির_মিস্ট্রি- ১১ / যে মানুষের হাতদুটো ছিল ঈশ্বরের তৈরি- ৪
২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ফ্লোরেন্স
খুব ঠান্ডা পড়েছে আজকে সকাল থেকেই। এই কাল অবধিও হাল্কা সোয়েটারেই কাজ চলে যাচ্ছিল। আজ দেখ কেমন হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এমনিতে ফ্লোরেন্সে তেমন বরফ পড়ে না, কিন্তু এমন ঠান্ডা চলতে থাকলে রাস্তা ঘাট সাদা হয়ে যেতে সময় লাগবে না।
পকেট থেকে আইফোনটা বার করে একবার চট করে সময়টা দেখে নিল পাওলো। আটটা বেজে দশ, আর মিনিট তিরিশের মধ্যেই পৌঁছতে হবে। এসব ব্যাপারে লেট করলে খুব বাজে লাগে দেখতে।
পাওলোর একটু যে ভয় ভয় করছে না তা নয়। এমন একটা কাজ পেলে যেকোন ফোটগ্রাফার আনন্দে লাফিয়ে উঠবে। ওরও তাই হয়েছিল খবরটা শুনে। প্রায় ছয়শো বছরের লুকিয়ে থাকা গুপ্তধন এবারে প্রথম বার সামনে আসবে, আর সেটা আসবে পাওলো উডের ক্যামেরা দিয়েই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এমন কাজ হরদম মেলে। কিন্তু এই কাজটা একটু স্পেশাল, আর সেটা এই ঐশ্বর্যের মালিকের জন্য।
ভায়া দেল আরিয়ান্তোর রাস্তাটা দিয়ে এসেই ডানদিকে একটা বেশ বড় গীর্জা। বাইরে থেকে দেখলে বোঝাই যায় এ বাড়ির বয়স অনেক। সান লোরেঞ্জো চার্চের ঠিকানা জানে না এমন লোক ফ্লোরেন্সে খুব কমই আছে। বেশ কিছু মেদিচিদের সমাধি আছে এখানে।
পাওলো যখন চার্চের দরজা দিয়ে ঢুকছে তখন ঘড়িতে পাক্কা আটটা পঁয়ত্রিশ। দরজার মুখেই দাঁড়িয়েছিলেন চ্যাপেলের এখনকার ডিরেক্টর।
– গুডমর্নিং মিস্টার উড, আমিই মোনিকা বিয়েতি। আপনার আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?
ভদ্রমহিলার বয়স ওই পঞ্চাশের ধারে কাছে। ছোটখাটো চেহারা। পরণে নীল রঙের টিউনিক।
সিকিউরিটি অফিসে ব্যাগ আর মোবাইল জমা রাখতে হল। ক্যামেরাটাও বার করে লেন্স ব্যাটারি সব খুলে ভাল করে দেখে নিল ওরা। ওই ক্যামেরাটা নিয়েই ও শুধু যেতে পারবে এবারে।
চার্চে ঢুকেই বাঁ দিকে মেদিচি চ্যাপেল। ফাঁকা বড় হল ঘরটা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নিজের বুটের আওয়াজই ওর কানে লাগছিল। ঘরের দুপাশে মেদিচিদের সমাধি সৌধ। প্রত্যেকটাই অসামান্য। তবে তাদের মধ্যে গিউলিয়ানো দা মেদিচিরটাই যে সেরা তাতে কোন সন্দেহই নেই। যে মানুষের লুকিয়ে রাখা গুপ্তধনের সাথে আজকে মুলাকাত হবে তারই তো হাতে বানানো এটা। ওই যে মেদিচির মূর্তি, তার নিচে দুপাশে আধশোয়া আরো দুটো স্কাল্পচার। ডে অ্যান্ড নাইট, দিন আর রাত্রি। সত্যি, ভদ্রলোকের এলেম ছিল বটে।
হলঘরটা শেষ হলেই আরেকটা ছোট ঘর,কিন্তু সেই ঘরের এই খুব সাধারণ দেরাজের পিছনেও যে একটা গুপ্ত দরজা আছে সেটা পাওলোর কল্পনার বাইরে ছিল।
কিউরেটরের বিয়েতি দরজাটা খুললেন এবারে। একটা এবড়ো খেবড়ো পাথরের সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে।
– আসুন, এই দিকে।
জায়গাটা বেশ স্যাঁত স্যাঁতে। সূর্যের আলো পৌঁছয় না বলেই হয়ত। আর অদ্ভুত একটা গন্ধ। সেটা মনে হয় সিঁড়ির গায়ের সদ্য রঙ করা দেওয়াল থেকে আসছে।
সরু সিঁড়িটা দিয়ে নেমেই একটা ছোট মতন জায়গা, সেখান থেকে আরেকটা সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। গুপ্ত ঘরের রাস্তা।
এই সিঁড়িটা যে ঘরে গিয়ে শেষ হচ্ছে সেটা মাটির নিচে হলেও একদিকের দেওয়ালে একটা জানলা আছে। এই জানলাটা খোলে চার্চের পিছন দিকটাতে।
এই সেই ঘর! আর এই সেই লুকিয়ে থাকা ঐশ্বর্য!
ঘরের চার দেওয়াল জুড়ে চারকোল আর চক দিয়ে আঁকা মানব শরীরের স্কেচ। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। পাওলো এবারে কাজে লেগে পড়ল। মার্ক থ্রির ক্যামেরাটায় ছবিগুলো বন্দি করার আগে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। আসার আগে কিছু পড়াশোনা করে এসেছিল ভাগ্যিস! তাই বেশ কয়েকটা স্কেচকে চিনতে অসুবিধা হল না। আরে এইটা একদম অ্যাপেলোর মূর্তির মতো না? আর এই স্কেচটাই তো পরে ফল অফ দা ফাইটনে ব্যবহার করেছিলেন শিল্পী! আর..আর..
রেনেসাঁর সেরা শিল্পী যে ঘরে শ্বাস নিতেন সেই বাতাসের ভাগ আজকে পাওলোও পেল। এবারে চটপট নিউইয়র্কের অফিসে ফিরে গিয়ে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করতে হবে। তবে সেই অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে পাওলো যখন ফিরে আসছিল তখন তার মনে আরেকটা চিন্তা ঘোরা ফেরা করছিল।
দেওয়াল জুড়ে শুধু পুরুষ শরীরের স্কেচ। নারীদের কোন স্থান নেই কেন সেখানে?
অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর এখন আর কারোর অজানা নয়।
কিউয়ার, বিড়বিড় করে বলল পাওলো।
||
জুন, ১৫৩২, ফ্লোরেন্স
সান লোরেঞ্জোর চার্চটা মেদিচিদের ব্যক্তিগত। এই চার্চের মধ্যেই ওদের চ্যাপেল রয়েছে। সেখানে আছে বেশ কয়েকজন মেদিচিদের সমাধি। তার নবতম সংযোজন গিউলিয়ানো দি মেদিচির সমাধিটা।
এই তো মাস কয়েক হল কাজ শেষ হয়েছে। আজকে সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফ্লোরেন্সের ডিউক আলেসান্দ্রো আর শিল্পী স্বয়ং। শিল্পীর বয়স সাতান্ন, শরীর সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। যৌবন যে অনেকদিন আগে ছুটি নিয়েছে তা বুঝতে কারোর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আত্মবিশ্বাস আর অহংকারটা একরকম রয়ে গেছে। সেটা ওই দৃপ্ত চোখগুলো দেখলেই বোঝা যায়।
আলেসান্দ্রো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন গিউলিয়ানোর সমাধির দিকে। পঞ্চাশ বছর আগে ছুরি খেয়ে লোকটা মরে গেলেও দেখো আজকে কেমন অমর হয়ে গেল। শুধু এই চোখ ধাঁধানো সমাধিটার জন্য। কি অনন্য শিল্প, গিউলিয়ানো বসে আছেন। আর তার পায়ের কাছে দুই পাশে দিন আর রাত্রি। দুজনেই দুইদিকে আধ শোয়া হয়ে। দিন একজন বৃদ্ধ পুরুষ, তার মুখ ক্ষতবিক্ষত, কাঁধের পিছন থেকে উঁকি মারছে। চোখ দুটো বড়। অন্যদিকে রাত্রি এক নারী, যৌবনবতী, শান্ত। আনত তার চোখ, বড় চুল। কিন্তু..কিন্তু…শরীরটা..
– মায়েস্ত্রো যদি একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন?
– বলুন।
কারোর কথা এমনিতেও খুব একটা গায়ে মাখেন না এই বৃদ্ধ। তবু ফ্লোরেন্সের ডিউককে এইটুকু সৌজন্য দেখাতেই হত।
– আপনার এই ডানদিকের দিনের মূর্তিটা নিঃসন্দেহে দারুণ। কিন্তু বাঁ দিকের রাত্রির মূর্তিটাতে আমার ভাল লাগেনি। নারীদেহ এত পেশী বহুল কেন? চওড়া কাঁধ, লম্বা বাহু। আর দেহের সবচেয়ে সুন্দর যে জায়গাটা, সেই স্তন দুটো কিরকম দেখুন, দুদিকে খাপছাড়া হয়ে দুটো ডেলার মতো বসে আছে। যেন পুরুষের বুকেই দুটো গোলক কেউ বসিয়ে দিয়েছে।
শিল্পী তখন মুচকি হাসছেন। তার মুখের দিকে কয়েকক্ষণ তাকিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল আলেসান্দ্রোর কাছে।
– তারমানে..তারমানে এই মূর্তির মডেল কোন নারী ছিলেন না? আপনি একজন পুরুষের শরীরেই…
-ঠিক ধরেছেন আলেসান্দ্রো। মডেল একজন পুরুষই ছিলেন। এর থেকে ভাল স্তন বানানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। নগ্ন নারী শরীর আমি কোনদিন চোখেই দেখিনি।
বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা আলেসান্দ্রোকে পিছনে রেখেই বিগতযৌবন শিল্পী এবারে হাঁটা লাগালেন নিজের ওয়ার্কশপের দিকে। এরপরে আর কথা বাড়ানো উচিৎ নয়।
||
অক্টোবর, ১৫৩২,ফ্লোরেন্স
তোমাকে ভাল না বাসলে,
আমি যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাই।
অন্যের দিকে তাকালে
আমি আমার আত্মাকে হারাই।
আবার একটা প্রেমপত্র। শুরুটাই যা এমন, পরের লাইন গুলো কামনার রসে জারিত। এর সাথে এবারে এসেছে হাতে আঁকা একটা স্কেচ। গ্রীক পুরাণ থেকে। তরুন গ্যানিমিডকে মাঝ আকাশে ধর্ষণ করছে ঈগলরূপী অ্যাপোলো। প্রেরকের ইচ্ছাটা স্পষ্ট। তোমাসো ক্যাভিলিয়েরিকে বিছানায় পেতে চান তিনি।
তেইশ বছরের তোমাসো ক্যাভিলিয়েরিকে যে পুরুষ কামনা করছেন তিনি এই সময়ের সেরা শিল্পী। তোমাসোর আগেও তার তিনটে প্রেম ছিল। সেচ্চিনো, ঘেরার্দো,ফ্র্যাঞ্চেস্কোরা বিভিন্ন সময় হয়েছেন তার শয্যাসঙ্গী। কিন্তু এক পুরুষে বেশিদিন মন টেকে না তার।
কামনার আগুনে পুড়ে কেটে যাচ্ছে একাকী রাত।
ক্যাভালিয়েরির বন্দি আমি,
এ আমার স্বীকারোক্তি।
মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর পছন্দের তালিকায় নতুন নাম এখন তোমাসো।
||
অক্টোবর,১৫৩৬, রোম
– মাফ করবেন হোলি ফাদার, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার কি মতিভ্রম হয়েছে?
– কেন বলুন তো?
– আপনি এই কাজটা দেবেন মিকেলকে?
– হ্যাঁ কেন? এই সিলিং তো ওরই আঁকা, দেওয়ালেও আঁকতে ক্ষতিটা কি?
– সে পঁচিশ বছর আগের কথা, গত পঁচিশ বছরে কি কি হয়ে গেছে জানেন?
– আপনি কি ভাবেন? ভ্যাটিকানের দেওয়াল ভেদ করে বাইরের কোন খবর পৌঁছয় না?
– আপনি..আপনি তাহলে জানেন সবকিছু!
– হুম, জানি।
– সব জেনেও ওই পায়ুকামী মিকেলকে এই সিস্টিন চ্যাপেলের পবিত্র দেওয়ালে হাত দিতে দেবেন!
– মিকেলের থেকে এই কাজ ভাল আর কেউ করতে পারবে না, এই নিয়ে আপনার কোনও সন্দেহ আছে কি?
– না তা নেই,কিন্তু..
-মিকেলই আঁকবে এই দেওয়ালে। ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোই ভাল।
প্যাপাল মাস্টার অফ সেরিমনি বিয়াজিও দা সেসিনার কোন কথাই শুনলেন না পোপ তৃতীয় পল। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন।
সিস্টিন চ্যাপেলের অল্টারের দেওয়ালে ফ্রেস্কো আঁকার কাজটা মিকেলকেই দেওয়া হল। অবশ্য মিকেল খুব একটা যে খুশি তা নয়। গত চল্লিশ বছর ধরে পোপদের ফরমায়েশি কাজ করতে করতে যে সে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ। আর ভাল লাগছে না ওর ধর্মের নিয়ম মেনে চলতে। ও যা বলতে চায় তা এতদিন তো পারেনি বুক চিতিয়ে বলতে। তবে আজ এই বাষট্টি বছর বয়সে এসে ও আর কাউকে ভয় করে না। পোপের চোখ রাঙানিকেও না।
এই দেওয়ালই বলবে মিকেলের গল্প। এই দেওয়ালেই মিকেল অমর করে যাবে ওর আত্মাকে।
||
৩১শে অক্টোবর ১৫৪১, রোম
মিকেলের কাজ শেষ হয়েছে কালকেই। আজকে সিস্টিন চ্যাপেলে এসেছেন পোপ পল, বিয়াজিও সেসিনা আর কার্ডিনাল কারাফা। মিকেল নিজে অবশ্য নেই আজ এখানে। সে যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের পরের কাজের জন্য। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ডোমটা ওকে বানাতে হবে।
পোপের সামনে এখন অল্টারের দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে মিকেলের ফ্রেস্কো। অন্তিম রায়। যীশু যেদিন আবার ফিরে আসবেন পৃথিবীর মানুষের বিচারের জন্য। পাপ আর পুণ্যের দাঁড়িপাল্লায় মেপে তাদের পাঠানো হবে স্বর্গে বা নরকে।
মিকেলের জাদুতে কিন্তু সত্যি চোখ ধাঁধানো একটা দৃশ্যকল্পের সৃষ্টি হয়েছে। গোটা দেওয়াল জুড়ে তিনশোর ওপরে মানব শরীর। মাঝখানে যীশু তার মা মেরীর সাথে, তার ডানহাত ওপরে তোলা, দুপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সন্ত জন, পিটার আর বার্থালোমিউ।
ছবির একদম নিচে মৃত মানুষের আত্মার দল ভীড় করছে। তাদের মধ্যে পবিত্রদের স্থান হচ্ছে ছবির বাঁদিকে স্বর্গে। আর ডানদিকে পাপীদের নরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দানবেরা। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মিনোস, নরকের রাজা। কি দারুণ ভাবনা শিল্পীর…
প্রাথমিক ভাল লাগার ঘোরটা কেটে যাওয়ার পরে যখন আরেকটু ভাল করে ফ্রেস্কোটাকে দেখতে শুরু করল সবাই তখনই চমকে উঠল! সেই চমক ধীরে ধীরে বদলে গেল ঘৃণা আর ভয়ে। একি করেছেন মিকেল!
ছবি জুড়ে অধিকাংশ নারী পুরুষ শরীরই নগ্ন। এমনকি যীশু আর তার মা মেরীও! যীশুর মুখে চিরপরিচিত দাড়ি নেই। সেখানে একজন সদ্য যুবা, তার চওড়া কাঁধ আর পেশি বহুল শরীর নিয়ে উদ্যত হাতে আত্মার বিচারে ব্যস্ত। ঠিক গ্রীক দেবতা অ্যাপোলোর মতো গড়ন তার। মেরীর মুখেও সেই প্রশান্তি নেই। তিনি এখানে বিরক্ত, মুখ ফিরিয়ে আছেন নশ্বর মানুষদের দিক থেকে। তাছাড়া অনেক পুরুষ শরীর অকারণে আলিঙ্গন বদ্ধ। দুজন আবার নিজেদের মধ্যে চুম্বনরত! আর যীশুর বাঁ পায়ের নিচে ওটা কে? সন্ত বার্থালোমিউয়ের জায়গায় স্বয়ং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো!
সব থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছে সেসিনার। নরকের রাজা মিনোসের ছবিটা দেখেই ও চমকে উঠেছে। এত ও নিজেই! কানদুটো কি বিশ্রি ভাবে বড়! আর তার লিঙ্গে কামড় বসিয়েছে একটা সাপ! মিকেল নির্ঘাত জানত যে ও চায়নি মিকেল এই ফ্রেস্কো আঁকুক। কিন্তু তাই বলে এই ভাবে অপমান!!
||
এ ছবি সিস্টিন চ্যাপেলের যোগ্য নয়। এর থাকা উচিৎ ছিল কোন পতিতালয়ের দেওয়ালে।
কার্ডিনাল কারাফার বলা এই কথা মিকেলের কানে এসে পৌঁছছে। সারা রোম জুড়ে এখন গুঞ্জন এই ছবি নিয়ে।
তাও তো ছবির আরেক রহস্য তো কেউ ধরতেই পারেনি, মনে মনে ভাবে মিকেল। ফ্রেস্কোর একদম ওপরে ডানদিকে দুই পুরুষ একে ওপর কে জড়িয়ে ধরেছে। ওরা আর কেউ নয়, মিকেলের দুই প্রেমিক, সেচ্চিও দেই ব্রাকি আর ঘেরার্দো পেরিনি! আর তোমাসো? মিকেলের নতুন জ্বলে ওঠা প্রেম? সে কোথায়?
সন্ত বার্থালোমিউ রূপী যে মিকেল দাঁড়িয়ে আছে যীশুর বাঁ পায়ের নিচে, তার কাঁধের ওপরেই তো ভর দিয়ে আছে তোমাসো! যেন সে ভীত হয়ে মিকেলের কাছেই আশ্রয় খুঁজছে।
যে যুগে পুরুষের প্রতি পুরুষের ভালোবাসা ছিল চরম পাপ, যে যুগে সমকামী নামে কোন শব্দ ছিল না, অন্যরকম ভালোবাসার নাম ছিল পায়ুকাম, সেই যুগে দাঁড়িয়ে মিকেলঅ্যাঞ্জেলো তার প্রেমিকদের অমর করে রেখেছিলেন। পরমপিতার ঘরে দাঁড়িয়ে এমন কাজ করার দুঃসাহস তার ছিল।
||
শেষের দিনগুলোর কথা-
শেষ বয়সে এসে ধর্ম কিন্তু মিকেলকে হারিয়ে দেয়। যখন বার্ধক্য তাকে গ্রাস করতে শুরু করল, যখন শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল তখন মিকেলের আত্মাকে গ্রাস করল ওর অবচেতন। দুর্বল সেই মনে তার মনে হতে থাকল এতোদিন ধরে যা করে এসেছে সেটা পাপই! সমাজের যৌনচেতনাই সঠিক। কি হবে এবারে! পরম পিতার স্নেহ কি তবে মিকেল পাবে না!
মানুষের কাজের মধ্যে দিয়েই মানুষের মন বোঝা যায়। শিল্পীরাও তো রক্ত মাংসের মানুষই। মিকেলের শেষ জীবনের কাজেও তাই ভগবানের কাছে নিজেকে সমর্পনের ছাপ পড়তে লাগল। নগ্ন পুরুষ শরীরের উদযাপন কোথায় হারিয়ে গেল।
পাথরে হাত দিলেই তখন শুধু যীশু বেরিয়ে আসছেন। নিজের সমাধির জন্য নিজেই বানালেন এক মূর্তি। সদ্য মৃত যীশুকে মেরীর কোলে তুলে দিচ্ছেন নিকোদেমুস। নিকদেমুসের মুখের জায়গায় বসালেন নিজেকে। প্রভুর স্পর্শে থাকার আকুতি সেখানে স্পষ্ট।
মিকেল ফুরিয়ে আসছেন।
।।
১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৫৬৪, পালাজো রদ্যানিনি, রোম
অশক্ত হাতে আজ মিকেল বানাতে চেষ্টা করছেন পিয়েতা। মৃত যীশুকে নিয়ে মা মেরীর শোক। কিন্তু এ কি হল! যীশুর মুখের অবয়ব ফুটিয়ে তোলার আগেই পাথর শেষ হয়ে গেল! যে পাথর ছিল তার প্রাণ আজ সেই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল! যে পিয়েতা তাকে যৌবনে এনে দিয়েছিল শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সন্মান সেই পিয়েতাই আজ আর মিকেলের হাতে ধরা দিল না।
নাহ, আর কিছু দেওয়ার নেই ওর।
নামিয়ে রাখলেন ছেনি, বাটালি।
পাথরের জাদুকরের শেষ জাদুটা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল।
এর ঠিক ছদিন পরে, ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৫৬৪ তে মিকেল মারা যান। উননব্বই তম জন্মদিনের তিনসপ্তাহ আগে। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মৃতদেহকে রোম থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তার প্রিয় শহরে।
যে শহর তাকে লালন করেছে।
যে শহর তাকে দিয়েছিল প্রথম খ্যাতি।
প্রথম প্রেম।
প্রথম আশ্রয়।
ফ্লোরেন্স।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
লেখক- অনির্বাণ ঘোষ
One thought on “হিস্ট্রির_মিস্ট্রি- ১১ / যে মানুষের হাতদুটো ছিল ঈশ্বরের তৈরি- ৪”
অসাধারণ! শিল্প, শিল্পী, ইতিহাস, ধর্ম, এসব ছাপিয়ে এই লেখা মানবতার নশ্বরতা ছাড়িয়ে চিরন্তন হওয়ার আকুতিকেই ফুটিয়ে তুলেছে। সত্যিই তো সব ফুরিয়ে যায় একদিন, এমনকি পাথরও খয়ে যায়। থেকে যায় শুধু ব্যাকুলতা, আর ভালোবাসা।
Comments are closed.