বে-জাত

Facts, Freedom, Ideas, Protest, আনন্দ আকাশ, বাংলা

শাঁখের আওয়াজ আর নামাজের মধ্যে মিল কোথায় বলুন তো ? নিশ্চয় ধর্ম টর্ম ভাবছেন , ধুর মশাই , ওই দুটো বাজলে আমাদের খেলার রফাদফা হয়,থুড়ি মানে হতো ।। সবাই খেলায় মেতে আছি, টান টান উত্তেজনা , টিমের তখনো হয়তো কেউ কেউ ব্যাট করতে পারে নি , এই সময় সাইরেনের মতো বেজে উঠলো শাঁখের আওয়াজ বা নামাজের আওয়াজ । মানে খেলা আজকের মতো এখানেই শেষ , না হলেই বাড়ি ফিরে উত্তম মধ্যম অপেক্ষা করছে । একদিন রেজাউল , ইরশাদ , আর আমরা ভেবেও ছিলাম – কোনোভাবে যদি এই আওয়াজ দুটো বন্ধ করা যায় । ছোটো মনে ধর্ম বুঝতাম না , ঠাকুর মানে সিন্নি, আর ঈদ মানে সিমাই ।

রেজাউল একটা টুপি পরে আসতো খেলতে , অনেক তোয়াজ করে , ৩ টা মার্বেল দিয়ে একদিন ওটা বাগিয়েছিলাম । সদর্পে বাড়িতে ঢোকার পর ই বুঝলাম কি একখান এটম বোমা নিয়ে এসেছি , মা ওটা ছিনিয়ে সরিয়ে রেখে দিলো যাতে বাবা দেখতে না পায় – কিন্তু ব্যাড লাক খারাপ । বাবার নজরে পড়েই গেলো – তারপর কিছু মধুর ভাষণ -“রিন্টু একটা কুলাঙ্গার, বংশের মুখ ডোবাবে ইত্যাদি ইত্যাদি , ” । কারণ টা বুঝতে আমার অনেক দিন লেগেছিলো , মা বুঝিয়েছিল ওই টুপি রেজাউল রা শুধু পরে , আমার পড়া উচিত না । পরে এক মন্দিরে গিয়ে দেখেছিলাম ওখানেও পুরোহিতরা টুপি পরে , মোদ্দা কথা ধর্ম প্রচারী রা কোনো না কোনো ভাবে আমাদের টুপি পড়িয়েই ছাড়ে ।

এই টুপি ঘটনার পর পুজোর ছুটি এবং ১ মাস পর আবার স্কুল , বিজয়ার প্রণাম করছি সকল মাস্টারমশাই কে, কিন্তু খুব সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছি অ – হিন্দু শিক্ষক দের । বাড়ি এসে মা কে বলতেই এক বিরাশি সিক্কার চড় গালে এসে পড়লো । গালে হাত বোলাতে বোলাতে মায়ের কাছে বুঝেছিলাম , শিক্ষক দের জাত হয় না, ধর্ম হয় না ।

আমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হতো হানিফ আর সেকেন্ড বিকাশ । আর আমি ? হ্যা, আমি ও ফার্স্ট বা সেকেন্ড থাকতাম তবে উল্টো গুনতি তে ।

তো , হানিফ ছিল ইংলিশ এ তুখোড় সেজন্য আমাদের ইংলিশ টিচার সমীর স্যার এর চোখের মনি , এসে কম্পিটিশন , ডিবেট -এসবে ওর প্রাইজ ছিল বাঁধা । আবার বিকাশ ছিল আমাদের অঙ্ক টিচার কামাল স্যারের প্রিয়পাত্র । বিজ্ঞানমঞ্চের কম্পিটিশনে কামাল স্যার ওকে নিয়ে যেত , ও প্রাইজ জিতলে মনে হতো যেন কামাল স্যার ই জিতেছেন । যেদিন মাধ্যমিকে ওরা ভালো রেজাল্ট করলো – ওদের দুজনের বাবা ,মায়ের মতোই সমীর স্যার বা কামাল স্যার ছিল আনন্দে আত্মহারা।

কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স হোস্টেল , পার্ট ১ এক্সাম শেষ , সকলে খুশি আমরা । কিছুদিন এসাইনমেন্ট ,ল্যাব থেকে মুক্তি | অবি খবর আনলো সাহিলের মোটর বাইক একসিডেন্ট করেছে , মাল্টিপল ফ্র্যাকচার , এবি নেগেটিভ রক্ত লাগবে । এতো রেয়ার গ্রুপ , মফস্বলের ব্লাড ব্যাঙ্ক এ রক্ত নেই ।কলেজে পোস্টার দেয়া হলো , অনেক খুঁজে একজন কে পাওয়া গেলো , ভুবন বলে পাশের গ্রামের একজনের । একটা জিনিস সেদিন বুঝলাম , হিন্দুর আর মুসলিমের রক্তের রং এক , একজনের রক্ত আর একজনের শরীরে মিশতে কোনো অসুবিধা হয় না ।

উপরের ঘটনাগুলোতে একটা জিনিস তো স্পষ্ট , বস , দরকারের সময় ধর্ম বাঁচায় না , মানুষ ই আপনাকে বাঁচাবে , তা সে যেই ধর্মের ই হোক । তবে সবাই অবশ্য মানুষ নয় , চামড়ার মোড়কে ঢাকা কিছু অমানুষ ও ছড়িয়ে আছে , যারা সুন্দর ভাবে ধর্মের উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে । আজ আসিফার খবর শুনে একটা জিনিস মনে হলো , এরকম কাজ যারা করতে পারে তারা কোনো ধর্মের হতে পারে না । তাদের পশু বা বর্বর ধর্ম বলা চলে ।

বিদেশে এসে একটা জিনিস বুঝেছি , এদের কাছে আমার আর হুসেনের কোনো পার্থক্য নেই । দুজনেই ইন্ডিয়ান । দুঃখ একটাই এই পরিচিতি টুকুর জন্য আমাদের অন্যের দেশে আসতে হলো ।

কেরালা তে শুনলাম একটা বড় অংশের ছাত্র ছাত্রী এপ্লিকেশন এ “নো রিলিজিওন ” লিখেছে – হয়তো একদিন আমাদের দেশ হবে – “নো রিলিজিওন ” দেশ । স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে তো ? স্বপ্নই তো , দেখতে ক্ষতি কি !!! অন্তত স্বপ্নের পরিধি তে ধর্মের ছোবল নেই ।।

 

কলমে আনন্দ

ছবি – clipartmag.com

অলংকরণ –  আনাড়ি মাইন্ডস