ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট

Anirban & Arijit, Humor, আদতে আনাড়ি, বাংলা

ফুটবল টা ওর মাথায় কিন্তু আঠা দিয়ে আটকানো নয়। তবে ওই বলই এখন ওর শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলা যায়। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে যখন পা পেট বুক মাথা দিয়ে বলটা নাচায়, তখন হাঁ করে পাশে দাঁড়িয়ে দেখে পথচলতি লোকেরা। কখনও পা ওপরে তুলে দিয়ে হাতে ভর দিয়ে উলটো হয়ে দাঁড়িয়েও পায়ের ওপর বল নাচাতে থাকে। তালির শব্দে ভরে ওঠে এই কানাগলি। আশপাশ থেকে মন্তব্য উড়ে আসে, “খাসা ব্যালেন্স কিন্তু ছেলেটার। মারাদোনা হবে দেখো একদিন।” যখন বল জাগলিং এর খেলা শেষ করে সামনে পেতে রাখা টুপির দিকে তাকায়, তখন কানাই আর ব্যালেন্স করতে পারে না চোখের সামনে কিছুক্ষণ আগে দেখা প্রশংসকের ভিড়, আর টুপিতে জমা পয়সার মধ্যে। হাত দিয়ে তুলে টুপির মধ্যে আবার ফেলে দেয়, আওয়াজ আসে দুটো এক টাকা আর একটা আট আনার কয়েনের। আড়াই টাকায় আজ খোঁজ নিতে হবে কি পাওয়া যায়। আলুর চপও যে সাড়ে চার টাকা হয়ে গেছে, রোজ রোজ শুকনো মুড়ি চিবোতে কার ভালো লাগে।

কানাইয়ের মতো আমরাও সবাই কিন্তু জীবনের প্রথম থেকে শেষ দিন অবধি ব্যালেন্সের খেলা খেলে যাই নিজেদের অজান্তে। সেই খেলাতেও দক্ষতা দরকার। তবেই না জীবনের দাঁড়িপাল্লায় সাম্য বজায় থাকে। দাঁড়িপাল্লা বলতে মনে পড়ল। এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে বাড়ি থেকে ঠিক হল সোনার আংটি দেওয়া হবে। তবে এর পেছনেও কারণ ছিল। তারা আমাদের বিয়েতে বউকে সোনার দুল দিয়েছিল, তাই ব্যালেন্স করতে হবে। পাড়ার মোড়ের স্যাকরার দোকানে গিয়ে গ্রিলের খাঁচার বাইরে বসলাম। সামনের দাঁড়িপাল্লা টা দেখেই চোখে লাগল। চোখ বাঁধা মহিলা মূর্তির হাত থেকে ঝুলছে দুটো ছোট তামার প্লেট। কৌতুহলবশত জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, “এ জিনিস কোথায় পেলেন দাদা?” যা আন্দাজ করেছিলাম তাই। হাওড়া কোর্টে আছেন ওনার ভাই। সেখান থেকেই আমদানি। বললেন, “আমার দোকানে সব হলমার্ক যুক্ত গয়না। তাই চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যাবে, এটা বোঝাতেই এই আয়োজন।” মাথা নাড়লুম, তবে কার চোখ বন্ধ থাকবে সে নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেল।

কথা ঘুরে যাচ্ছে। যা বলছিলুম, কখনও ভেবে দেখেছেন যে আমরা দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে সবকিছু ব্যালেন্স করে চলি নিজের অজান্তেই? দাঁড়ান ডেমো দি।

আইনক্সে “অ্যাভেঞ্জারস” দেখে এলেন ১৮০ টাকা পার হেড খসিয়ে। তারপর পপকর্ন, বাটার কর্ন, সুইট কর্ন খেয়ে ঢেঁকুর তুলে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে সোফায় বসতেই গিন্নী টিভি চালিয়ে “জামাইরাজা” দেখতে শুরু করল। আপনার ভেতরের থানোস তখন রুটি ছিঁড়ে বেগুনভাজা পাকিয়ে মুখে ঠুঁসছে।

এই কারণেই আমি সিনেমা সাধারণত ১৫.৬ ইঞ্চি স্ক্রিনে দেখা পছন্দ করি। আরে হলের দামড়া স্ক্রিনে গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে ডলবি ডিজিটাল সাউন্ডে “রামগোপাল ভার্মা কি আগ” দেখলেও মন্দ লাগবে না। তাই যে সিনেমা ল্যাপটপের ছোট পর্দায় হিট করবে, জানবেন তাতে দম আছে। কিন্তু আপনার দম কমতে শুরু করলে?

ওজন বেড়ে যাচ্ছে, বা মধুমেহ ধরব ধরব করছে। এই অজুহাতে আপনি ঠিক করলেন সকালবেলা “মর্নিং” ওয়াকে যাবেন এবার নিয়ম করে। জুতো কেনা হল, ট্র‍্যাকশুট রেডি। জমিয়ে হাঁটলেন হন হন করে। শেষে জিভ টিভ বেরিয়ে একশা। এসে বসলেন শম্ভুর চায়ের দোকানে। অর্ডার করলেন লেবু চা, চিনি ছাড়া। চা খেতে খেতে আপনার কানে এল ছস করে তেলে শিঙাড়া ছাড়ার শব্দ। বারকয়েক ঢোঁক গিলে, “আজই-লাস্ট” পণ করে মেরে দিলেন দুটো গরম শিঙাড়া আর জিলিপি। তারপর মন মেজাজ চাঙ্গা করে বাড়ি ফিরলেন। বুঝলেন তো কিভাবে ব্যালেন্স করে ফেললেন ক্যালরি। যা ঝরালেন, তা বাগালেন। এই কারণেই আমি মর্নিং ওয়াক যাই না। বলা ভালো মর্নিং যে কেমন দেখতে, বা কি কালারের হয়, সেটা লাস্ট দেখেছি মনে হয় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়। আরে তখন একটা মজার কেস হয়েছিল।

আমার এক বন্ধুর সাথে তখন শীতের সকালে উঠে ব্রিজে হাঁটতে যেতাম। ফেরবার সময় যথারীতি কচুরি সাঁটিয়ে ফিরতাম। আর সেই টাকা কে দেবে সেই নিয়ে বাওয়াল হত রোজ। তা একদিন আমরা ব্রিজের মাথায় বসে আড্ডা মারছি ভোরবেলায়। হঠাৎ দেখি আমার পায়ের তলায় একটা কুড়ি টাকার নোট পড়ে। বন্ধুর আনন্দ আর দেখে কে, কারণ ওরই টার্ন ছিল সেদিন। ওকে তো আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না। লাফাতে লাফাতে ব্রিজ থেকে নেমে গুছিয়ে কচুরি গিললাম খোসাওয়ালা আলুর তরকারি দিয়ে। তারপর একটা করে গজা। আহ্, বাড়ি ফিরে ঘুম দিলাম। বেলা ১১ টা নাগাদ দেখি বন্ধু ফোন করছে। ধরতেই বলল, “জানিস একটা কেস হয়েছে।” জিজ্ঞেস করতে বলল, “বাড়ি ফেরার পর বাবা জিজ্ঞেস করল যে আমরা আজ ব্রিজে গেছিলাম কিনা। হ্যাঁ বলতে বাবা বলল যে আজ আমাদেরও আগে বাবা গেছিল হাঁটতে ওখানেই। আর কুড়ি টাকার নোট হারিয়েছে একটা। জিজ্ঞেস করছিল আমরা পেয়েছি কিনা।” ফোনটা ওই অবস্থাতেই কাটতে বাধ্য হলাম, কারণ আমার বেমক্কা হাসি আর বিষম খাওয়ার আওয়াজ কাকু শুনলে সেটা ভালো হত না।

এদিকে শীতের দিনে গিজারের গরম জল আর ঠান্ডা জলকে সমানুপাতে মেশাতে হলে সাধনা করতে হয় বস। বাঁদিকের কল কে ৫ প্যাঁচ আর ডানদিকেরটা ৭ প্যাঁচে মোটামুটি উষ্ণ গরম জল পাওয়া যায়। এই সাত ইজ টু পাঁচ সেটিং কিন্তু পরের দিন চেঞ্জ হয়ে যাবে গ্যারান্টি। তখন কনফিডেন্সের সাথে কল চালিয়ে এক মগ তুলে মাথায় ঢাললেই জোর কা ঝটকা! আবার ব্যালেন্স করতে হবে আদুল গায়ে দাঁড়িয়ে। তাহলে বুঝতে পারছেন তো, ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট কিন্তু সমানে চলছে।

তবে এই বয়সে আর মর্নিং ওয়াক বা জিম করা সম্ভব নয় বুঝে গেছি। এদিকে ফিটনেসও রাখতে হবে। তাই সেদিন অ্যামাজনের অফারে একটা ফিটনেস ব্যান্ড কিনে ফেললুম। ভাবলুম এই ব্যান্ড টা হাতে দিনরাত পরে থাকলেই শরীর ফিট থাকবে। কিন্তু আ মরণ, ল্যাদের ঘোরে স্পেসিফিকেশন টাও ভালো করে পড়া হয়নি!

আমাদের পাড়ার শুভদীপ। একটা বিশালাকৃতি হার্লে ডেভিডসন নিয়ে ঢিগ ঢিগ করে সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলেই নিয়ম করে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুঁড়ে কুকুর খেঁদায়। আর তারাও ওর খাবারের প্লেটে মুরগি মাটন রূপে আবির্ভূত হয়ে বদলা নেয়। এছাড়া বাইরে দাঁড় করানো হার্লের পেছনের চাকায় এক ঠ্যাং তুলে শান্তির জল ছিটিয়েও ওরা পুরো ব্যাপারটাকে ব্যালেন্সড রাখতে জানে।

তবে এই যে এত ব্যালেন্স ব্যালেন্স করছি, একটা জিনিস কিন্তু আমরা ছেলেরা কোনওদিন ব্যালেন্স করতে পারি না। যারা পারে তারা সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, চাইলে থানোসও। কোন জিনিস? আরে এ কি যে সে ব্যাপার, যে রান্নায় নুন বেশি লাগল বলে চিনি দিয়ে নেড়ে দিলেন, বা গাড়িতে এসি চলছে না বলে গান চালিয়ে দিতে বললেন, যাতে ভুলে থাকা যায় গরম। বস, এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক সমস্যা। নিজের মা আর বউকে ব্যালেন্স করে দেখান দেখি, আরসালানের ভেজ বিরিয়ানি খাওয়াব আপনাকে। ওই দেখো আসছে তেড়ে সবাই মারতে, আরে ভাই কজন বলে এমন সত্যি কথা! মুখ ফুটে বললুম বলে রাগ করছেন? ফেবু তে লিখি বলে কি মানুষ নই? আমাদেরও কি ইমো থাকতে নেই? আমি সবসময় আমার জুনিয়রদের বলি যে, প্রেম যখন করবি, চুটিয়ে করবি। কোনও বাধা না মেনে এগিয়ে যাবি। জীবনে ঠিক দুবার গলায় মালা পরার সুযোগ পাবি যদি না বুদ্ধিজীবী বা পলিটিশিয়ান হোস। প্রথম মাল্যদানের পরেই কিন্তু খেলা ঘুরবে। তখন অ্যাটাকিং খেললে রেড কার্ড খাবি, ডিফেন্সিভ খেললে গোল খাবি, মাঠ ছেড়ে পালাতে গেলে খিস্তি খাবি। ভুল বুঝবেন না, এই স্টেটমেন্ট থেকে অনেকেই হাস্যরস পাবেন , আবার অনেকে এর তদন্তে মনোনিবেশ করবেন জানি। তবে, যা ভাবছেন তেমন কিছু নয়। আমার বাড়িতে দুজনেই দুজনার নয়নের মণি, একে অপরকে চোখে হারায়।

তবে আমাকে এরা বলে বলে গোল দেয়। বাড়িতে দিনরাত খিস্তি খাই বলে বাইরে তা বিলিয়ে ব্যালেন্স করে দি। প্রকাশ্যে কাউকে দেওয়ার সুযোগ না পেলে ফেসবুক খুলে একে ওকে সিস্টেমকে বা উঠতি লেখককে গালি দিয়ে ভূত ভাগাই। গালি আবার সুর করে না দিলে ঠিক জমে না। এটারও ডেমো চাই? ওকে, একটা ভদ্র গালি বেছে নিলাম, ধরুন “শুয়োর”। কাউকে “শুয়োর” বললে আপনার যে ফিল গুড আসবে, তার থেকে “শুউউয়ার” বলে দেখুন। দাতা ও গ্রহীতা দুজনেই খুশি হবে। গলা ছেড়ে খিস্তি মারলে আবার হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে, বিশাল স্ট্রেস রিলিফ।

যাকগে, অনেক ভাট বকলুম। যে জন্য এত কথা বলা, সেটা হচ্ছে যে হাতে আর সময় নেই। এখন কটা দিন সাও পাওলোর মোড় থেকে টোটো ধরে রিও তে নামতে চাই, পথে বুয়েনস আইরস বা মিউনিখ বা মাদ্রিদ যেন বেশি চোখে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে সমগ্র পল্লীবাসীকে অনুরোধ করছি। পতাকার সংখ্যা বাড়াতে থাকুন, আকাশ যেন ঢেকে যায়। এই একটা ব্যাপারে ব্যালেন্স করতে দেব না বলে দিলুম! মাঝে মাঝে ভাবি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার লোকেরা বিশ্বকাপের সময় কলকাতা চলে আসে না কেন! একসাথে বসে আরও বেশি মজা করে খেলা দেখতে পারব সবাই। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা হেরে গেলে ব্রাজিলের সাপোর্টাররা মিছিল নিয়ে বেরোবে, আর পরের দিন ব্রাজিল ফুটে গেলে অপোনেন্ট চান্স পাবে। বেশ মজা হবে কিন্তু। এই লেখাকে তাই নেমন্তন্ন হিসেবেই পেশ করলাম, কেউ পারলে পৌঁছে দেবেন তো একটু ওইদিকে।

তবে সেই গোল্ডেন সময় আর ফিরে আসবে না। চিলির সালাস জামারানো জুটি মনে আছে? মনে পড়ে সেনেগালের সেই মাঠে জার্সি ফেলে তাকে ঘিরে তালে তালে নাচ? মনে পড়ে রবার্তো বাজ্জোর সেই সাডেন ডেথে আকাশে বল পাঠানো আর রোমারিওর উল্লাস? ক্রোয়েশিয়া বলে যে একটা দেশ আছে, সেটা জেনেছিলাম দাভর সুকের কে দেখে। জিদানের গুঁতো, রোনাল্ডিনহোর চোখ ধাঁধানো লম্বা ফ্রি কিক, কাকার লাল কার্ড খেয়ে মাঠময় ঘুরে বেরানো, রবার্তো কার্লোসের সেই কার্লিং ফ্রি কিক, বার্থেজের টাকে চুমু, এস্কোবারের আত্মঘাতী গোল, রিভাল্ডোর নিখুঁত অভিনয়, ভুভুজেলার আর্তনাদ। এইসব জিনিস যারা দেখেছে, তারা লাকি। কারণ, বারে বারে আর আসা হবে না…

ব্যালেন্সিং অ্যাক্টের লাস্ট ডেমো টা এবার কমেন্ট বক্সে দেখাবেন আপনারা। ইয়ে জ্বলে যাওয়া একটা লেখা পড়েও বাহবা দেওয়া শুরু করুন দেখি। 😉

~~~♣~~~

লেখক ~ অরিজিৎ গাঙ্গুলি