ইঁদুরদৌড়

Friends, Humor, Satire, School, Tuition, বাংলা

কদিন আগে আমার স্কুলের স্টার,ফার্স্ট ডিভিশন,সেকেণ্ড ডিভিশন,থার্ড ডিভিশন সব আমরা একসাথে মদ খাচ্ছিলাম।পেগ মেপে মেপে,সবার সমান মাপ।একই সাথে লাস্ট বেঞ্চির মত খেউর হচ্ছিল।বউ বাচ্চা আসলে সবাই আবার চুপটি করে নীরব হয়ে ইস্কুলের ফার্স্ট বেঞ্চির মত আচরণ করছিলাম।কাজের ব্যাপারে সবচেয়ে সম্মানীয় পোস্টে আছে স্টার,কিন্তু ইনকাম সবচেয়ে বেশী সেকেণ্ড ডিভিশনের।আমরা একে অপরকে নাম ধরেই ডাকছিলাম।গ্রেড ধরে নয়।নানা ব্যাপার আলোচনা করছিলাম।তাতে কে কতটা পড়েছি,ক্লাস টেস্টে কত পেয়েছি ছিল না।বরং কে কতটা হট ছিল,কার ডিমাণ্ড বেশী, কোন স্যারের ব্যাচে কতটা বাঁদরামি করেছি সেগুলোই টপিক ছিল।একবারের জন্য আলোর প্রতিফলন,চলন,গমন,ক্যালকুলাস,ভয়েস চেঞ্জ,মোগল সাম্রাজ্যের পতন ওঠেনি।বরং ট্রাম্প কার্ড,নিষিদ্ধ কাজ,খেলার মাঠ,ক্যাবলামি,পলিটিক্স আরও নানা ঘটনা উঠে আসছিল।

সোজা কথা এই “কৃতী ছাত্র” নামক নাটকটি করে সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করার আমি খেলাপ।এটা করে কী লাভ?আপনার ব্যাচের টপটেন কে ট্র্যাক করেন আপনি?না নিজের সার্কেলেই থাকেন? আমাদের ইস্কুলের টপ টেনকে সম্বর্ধনা দেওয়া হত।সেখানে অনেক ঢপ মেরেছি আমরা।কনভোকেশন অবধি পোষায়, কিন্তু এভাবে জগৎকে জানানোর মতলবটা আমার ক্লিয়ার হয় না।সবাই পড়াশুনোয় ভাল হয় না।কিন্তু মাঝারি আর খারাপ ছাত্রকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোয় মাহাত্ম্য নেই।
কোন ছেলে বা মেয়েটা হয়ত পড়াশুনোয় ভালো না,কিন্তু ভালো আঁকতে পারে।কেউ হয়ত ফুটবল বা দাবা ভালো খেলে,কেউ হয়ত ব্যবসা ভাল বোঝে,কারও হাতের কাজ ভালো সেই গুলোকে তার মাপকাঠি ধরা উচিৎ।নইলে এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্হা হোক যাতে সার্বিক বিচার হবে।পাখিকে সাঁতার কাটতে বললে বা মাছকে উড়তে বললে হবে না।

মনে আছে আমাদের একটা থার্ড ডিভিশন ফাটাফাটি ইলেকট্রিকাল জিনিস সারাতো,সার্কিট ডায়াগ্রাম দেখে কত সব জিনিস বানাতো।রেডিও,এফএম,মোটর হাতপাখা,সেন্সর ট্যাপ,এলিডি ঘড়ি,টর্চ কত্তকি।একটা সেকেণ্ড ডিভিশন বানাতো জিন্সের ব্যাগ,জামা,মানিব্যাগ অনেক কিছু।ওগুলোই মনে পড়ে।মনে পড়ে একটা ফার্সট ডিভিশন খেলার মাঠে দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে ফিল্ডিং করত,গাছের ছায়া দেখে দাঁড়াত সে।হাজার খিস্তি দিলেও নড়ত না।

মনে পড়ে কেমিস্ট্রি টিউশন পড়তে এসে দরজা আটকে দিত একটা সেকেণ্ড ডিভিশন।স্যার বাইরে থেকে চেঁচাচ্ছেন – “ওরে দরজা খোল রে তোরা!!!!”
এদিকে দাবী উঠেছে – “একটা টিভি আর কেবল্ লাগাবেন কি না বলুন?”।আরেক মক্কেল তো স্যারের বাড়ির ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়েই পড়ত।
“তোদের যা ভেবেছিলাম,তোরা তার উল্টো বেরোলি”।মনে নেই কোন এক্সপেরিমেন্ট বা ফর্মুলা বা ইকুয়েশন।কীভাবে টেস্টটিউবে রিং হত মনে পড়ে না,কিন্তু মনে পড়ে একটা ফার্সট ডিভিশন কীভাবে কেমিস্ট্রির ল্যাব বন্ধ করে দিয়েছিল।দরজার সামনে এমনি কফ ফেলেছে,সে পুরো সিগ্রিণ ডেলা।স্যারেরা ঘেন্নায় ল্যাব খুলতে পারছে না। আরেকবার হাজারবার বারণ করা সত্ত্বেও লাস্ট বেঞ্চিতে এমনি কফ দিয়েছে যে একটি মেয়ের দেখে গা গুলিয়ে সে ওয়াক ওয়াক করতে করতে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল।বায়োলজি প্রাকটিকালের পর গোটা কুড়ি মৃত ব্যাঙের হাত পা ডাইসেক্ট করে মেয়েদের কমন রুমে রেখে এসেছিল একটা স্টার।তারপর গার্জেন কলের ভয়ে ইস্কুল থেকে মিসিং।

সব ব্যাচেই এরকম ঘটনা থাকে।বুদ্ধি বিক্রীর বিশ্বযুদ্ধে আমরা সবাই কোন না কোনদিন শহীদ হবই।সেরকম জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের ছোট ছোট ছাত্রদের এভাবে বর্ণাশ্রমের মত ক্যাটাগোরাইজ করে দিলে সেটাতো চাপ বাড়িয়ে দেওয়া।আমাদের ইস্কুলে ভাল আলু,পচা আলু আলাদা করতে সেকসান বানানো হত।ন্যক্কারজনক ব্যাপার।

দুঃস্হ মেধাবী ছাত্র,শিল্পী,খেলোয়ার এদের দেখানো হোক্।মাধ্যমিক এইচএস্ জয়েন্ট এসব আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচার করে,জীবন নয়।সোনার দোকানের গয়নার এ্যাড দেওয়ার মতন ভালো ছাত্রের ডিসপ্লে বন্ধ হোক্।এগুলো বিভেদ বাড়ায়।

সকলের সকলকে লাগে মশাই।ভারতে কোথায় কী রিসার্চ হচ্ছে পারলে হাইলাইটেড হোক্।কারণ ওগুলো কৃতিত্ব ও অধ্যবসায় প্রমাণ করে, এগুলো নয়।কোন গ্রামে কোন ছেলেটা বা মেয়েটা ভালো খেলছে হাইলাইটেড হোক্।

হয়ত আমি ভুল,কিন্তু বিশ্বাস করুন,পড়াশুনোয় টপার টপার করে বিভেদ করলে দুপক্ষেরই ক্ষতি।কারণ কে জীবনে কোন ক্ষেত্রে টপ করবে সেটা কেবল বইখাতা ঠিক করে দেয়না।আমাদের বস্তাপচা এডুকেশন সিস্টেমকে ভাঙার চেষ্টা চলছে দিল্লীতে। বিশ্বখ্যাত ফিনিশ ধারা নিয়ে আসবার চেষ্টা চলছে,অথচ পশ্চিমবঙ্গে আমরা সেই টপারবন্দনা করেই গেলাম।ঘরে ঘরে নিজের ছেলেকে হ্যাটা করে,পরের ছেলে ভালো নয়ত নিজের ছেলে সেরা, পরেরটা জালি এই কম্পিটিশনের খেলা চলছে।এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার।

~~~♣~~~

লেখক ~ গুলগুলভাজা (দেবপ্রিয় মুখার্জী)

প্রচ্ছদ ~ The Wall, Pink Floyd