
পাঠকের চোখে – তেইশ ঘন্টা ষাট মিনিট
বইয়ের নাম : তেইশ ঘন্টা ষাট মিনিট
লেখক : অনীশ দেব
প্রকাশক : পত্রভারতী (হার্ডকভার, ২৫৮ পাতা)
আচ্ছা, কেমন হত যদি দৈনন্দিনের জরুরী প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্যে আমাদের খেলতে হত একটা করে খেলা আর সেই খেলার হারজিতের ওপর নির্ভর করত আমাদের চাওয়া কিন্তু না পাওয়া সব জিনিসগুলো।
এবার ‘জরুরী প্রয়োজনের‘ জায়গায় রাখুন ন্যূনতম খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকার। আর ‘খেলার‘ জায়গায় রাখুন লড়াই। আপনারই চেনা কারও সাথে অথবা অচেনা কিন্তু আপনারই মত প্রয়োজনের তাগিদে উঠে আসা কোনো মানুষের সাথে আপনার সংগ্রাম।
চেনা লাগছে? ঠিকই ধরেছেন, খেলার নাম ‘জীবন‘ ওরফে বেঁচে থাকার লড়াই। যেখানে রোজকার চাহিদাগুলো পূরণ করতে প্রতিটি মানুষকে নামতে হয় যুদ্ধে, অন্য মানুষদের হারিয়ে অস্তিত্বের সংগ্রামে থেকে যাবার আশায়।
লেখক তাঁর গল্পে এই টিকে থাকার লড়াইকে আবহ দিয়েছেন আজ থেকে আরো সোয়া তিনশ বছর পরের। যেখানে বৈষম্য আর উঠোন, ব্যালকনিতে বিভক্ত নয়, একটা গোটা শহর ভাগ হয়ে গেছে ‘ওল্ডসিটি‘ আর ‘নিউ সিটিতে‘। নিউ সিটির প্রযুক্তি, বৈভবের জীবনযাত্রা যেখানে স্বর্গের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়, সেখানে ওল্ড সিটিতে বাড়িঘর ভেঙে এখনশুধুই নোংরা বস্তির ভিড়। মাঠে ঘাস নেই, মাটিতে গাছ নেই, মানুষের হাতে কাজ নেই। অপরাধের সংখ্যা যত বেড়েছে পাল্লা দিয়ে কমেছে চিকিৎসা এবং শিক্ষার সুযোগ। প্রশাসন নেই বললেই চলে কেবল বিনাপয়সার বিনোদন আছে! কেমন সেই বিনোদন?
বিনোদনের যদিও হরেক নাম তবে তার মধ্যেও সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ‘কিল গেম‘! যে খেলার কোয়ালিফায়িং পর্ব আর মূলপর্বে প্রতিযোগীরা কখনো লড়াই করে হিংস্র জানোয়ারের সাথে কখনো একে অপরের সাথে। নিয়ম একটাই, হয় মরো অথবা মারো। সেই খেলার (?) অবিরাম সম্প্রচার হয় দুই শহরেই। নিউ সিটিতে বিজ্ঞাপনের টাকা উসুল করতে আর ওল্ড সিটিতে কারণ, পরের গেমের জন্য চাই আরো আরো উত্তেজনা দিতে পারে এরকম খেলোয়াড়! চাই এমন কাউকে যে জীবনের জন্য লড়বে বেঁচে থাকার তোয়াক্কা না করেই।
গল্পের মূল চরিত্র জিশান কিভাবে এই মারনখেলায় ঢুকে পড়ে আর কিভাবে বিভিন্ন খেলায় সে মহড়া নেয় অসম প্রতিযোগীদের তাই নিয়েই গল্প। আর তার মাধ্যমেই সে এগিয়ে যায় সেই অমোঘ খেলার দিকে, যেখান থেকে কেউ ফেরেনি আজ পর্যন্ত, যার নাম ‘কিল গেম‘। দিন গুজরানের রোজকার লড়াই থেকে এই গল্পের প্রতিটা লড়াই একটা জায়গায় শুধু আলাদা। আমাদের একেকটা যুদ্ধ জিতে ফেরার পুরস্কার ‘একটু ভাল করে বাঁচা‘, এখানেও পুরস্কার তাই। কেবল ব্যর্থতার মূল্যটা একটু আলাদা। এখানে মুহূর্তের ভুল মানেই হার, হার মানে মৃত্যু।
অনীশ দেবের লেখা ভয়ের আর কল্পবিজ্ঞানের ছোটগল্প পড়া ছিল এর আগে, তাই টানটান লেখনী সম্পর্কে ধারণা ছিলই। তবে যেরকম সংলাপধর্মী বর্ননা এবং দুতিন বাক্যের প্যারাগ্রাফে পুরো বইটা লেখা হয়েছে তাতে বই পড়াটা আধমিনিটের জন্যেও ক্লান্তিকর হয়নি বোধ হয়। চমৎকার! সত্যি বলতে কি, লেখাটা পড়তে পড়তেই, প্রায় সিনেমা দেখছি এই ভাবনা একবারের জন্যেও না আসাটা অসম্ভব, এতটাই বেশি বেশি করে সিনেম্যাটিক মুহূর্ত ছড়িয়ে রয়েছে পুরো বইটায়।
তবে সব ভাল যার শেষ ভাল, এক্ষেত্রে কিন্তু সব ভাল হয়েও শেষটা ভাল লাগল না। উপসংহার না থাকা হয়ত গল্পের পরবর্তী পর্বের (ষাট মিনিট তেইশ ঘন্টা) জন্য পাঠককে উৎসাহিত করবে কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষের দিকের কুড়ি পাতা মতন বেশ তাড়াহুড়ো (rushed writing) করে লেখা বলে মনে হয়েছে।
এছাড়া, গোটা বইতে নায়ককে কেন্দ্র করে, third person limited narration, ব্যবহার করতে করতে হঠাৎ করে একটি চরিত্রের পূর্বাশ্রম বলবার জন্য মাল্টিপল ন্যারেশনে চলে যাওয়া যথেষ্ট অস্বাভাবিক লেগেছে। বিকল্প হিসেবে transitional অথবা parallel timeline ব্যবহার করতে পারতেন লেখক। প্রথমটা অন্য চরিত্রের মুখ থেকে সংলাপের ছলে প্লট ছাড়ানো। দ্বিতীয়টা শুরু থেকেই সমান্তরাল ভাবে আরেকটা ন্যারেশনে চলে যাওয়া।
একইরকম ভাবে ‘ওল্ড সিটি‘, ‘নিউ সিটি‘র মত অকারণ ইংরেজী শব্দের ব্যবহার সংখ্যায় কম হলেও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। বিশেষত যেখানে নতুন জনরের লেখা লিখে বাংলায় নতুন পরিভাষা তৈরী করার সুযোগও বিদ্যমান।
শেষ দুর্বলতা, সিন্ডিকেট, গেমস করপোরেশন আর পিস ফোর্সের দুষ্টচক্র সম্বন্ধে পাঠককে বেশ কিছু প্রশ্ন ধাক্কা মারে, যেগুলোর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা এই বইতে পাওয়া যায় না। এটাও হতে পারে সেগুলো দ্বিতীয় পর্বের জন্য তোলা থাকল। সেটাই যদি হয় তবে প্রশ্নগুলো ছায়াশ্রিতা না হয়ে কুয়াশাবৃত (inquisitive not confounding) থাকলে সম্ভবত অনেক বেশি করে পাঠকমনের আগ্রহের সঠিক পরিচায়ক হত মনে হয়।
গল্পটি লেখা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে ‘কিশোর ভারতী‘ পুজোসংখ্যায়, শেষ হতে হতে ২০১০। অতএব হলিউড ফিল্মখোররা বুঝে গেছেন নিশ্চয়, ‘হাঙ্গার গেমস‘(২০০৮) এর সাথে যোগাযোগ টেনে লাভ নেই বিশেষ। বরং যেটা বলার সেটা হল বিদেশে এই জনর ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় এবং উপন্যাস আর সিনেমা তিনদশক আগে থেকেই সেখানে স্বীকৃতি দিয়েছে এই ডিসটোপিয়ান (dystopian) দুনিয়ার চর্চাকে। বাংলায়, অন্ততপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে সেরকম বহুলপঠিত ফিউচারিস্টিক (futuristic) থ্রিলার চোখে পড়েনি এই লেখাটির আগে। সেইজন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ। আশা রাখব এই গল্পের আরেকটি পর্ব ছাড়াও ভবিষ্যতে এই পটভূমিকায় আরো গল্প বা উপন্যাসের জন্ম দেবেন অনীশ দেব মহাশয়।
~~~☀️ সমাপ্ত ☀️~~~
লেখক ~ সপ্তর্ষি বোস
প্রচ্ছদ ~ সপ্তর্ষি বোস
www.facebook.com/anariminds
#AnariMinds #ThinkRoastEat