সিনে দর্পণ – ওকজা

Anari Talkies, Friends, Ideas, Movie, Reviews, দর্শকের চোখ, বাংলা

#আনাড়ির_চোখে 

টাইটেলঃ ওকজা

পরিচালকঃ বং জুন হো

গল্পটা সেই পুরনো পোষ্য আর পালকের প্রেমের! সেই মার্কিন ভোগবাদের বিপরীতে এক আবেগসর্বস্ব লড়াইয়ের! কিছু মানুষের একটা আদর্শ রক্ষার জন্য জীবন বাজী রাখার গল্প

তবু এই চিরাচরিত গল্প থাকা সত্ত্বেও সিনেমাটা নিয়ে দুবার ভাবতে বাধ্য করাল ওকজা। কারণ বর্তমানের এই স্বার্থপর পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শুধু নিজেদের বাঁচানোর আয়োজনই দরকার, নাকি যেকোন মূল্যে মানবিকতা আর ভালোবাসার জয়ধ্বজাটা তুলে রাখা প্রয়োজন, পুরো সিনেমা জুড়ে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাল ওকজা।

গল্পটা শুরু হয় এইভাবেআমেরিকার বিখ্যাত মিরান্ডা কর্পোরেশনের সদ্য নিযুক্ত সিইও লুসি মিরান্ডা(টিলডা সুইন্টন) ঘোষণা করলেন, দেশব্যাপী বেড়ে চলা খাদ্যসংকটের সমাধান হিসেবে তাদের নতুন আবিষ্কারসুপার পিগলেট। অর্থাৎ সাধারণ শূকরছানার থেকে আকারে বৈশিষ্ট্যে অনেক উন্নত, এরকম কিছু শূকরছানাকে পৃথিবীর ছাব্বিশটি দেশে ছাব্বিশজন কৃষকের কাছে দেওয়া হবে, যাদের সেই দেশের সংস্কৃতি জলবায়ু অনুযায়ী সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বড়ো করে তোলা হবে। দশ বছর পরে তাদের মধ্যে সবথেকে সুন্দর এবং বিশেষ শূকরটিকে নিয়ে আয়োজিত হবে একটি প্রতিযোগিতা, যার মূল নির্বাচক হবেন বিখ্যাত প্রাণীবিদ পশু চিকিৎসক  ডঃ জনি উইলকক্স(জেক গিলেনহাল)

দশবছর পর, কোরিয়ার এক নিঃসঙ্গ পাহাড়চূড়ায়, আমরা দেখতে পাই একটা বাচ্ছা মেয়ে, এবং তার সাথে এক বিশালবপু শূকরকে। বাচ্ছা মেয়ে মিজা(আন সেও হুন) তার বয়স্ক ঠাকুর্দা তার পোষ্য প্রিয়বন্ধু ওকজাকে নিয়ে সুখে দিন কাটায়। প্রসঙ্গত ওকজা একটি শূকরী।

একদিন, মিরান্ডা কর্পোরেশন থেকে জনি উইলকক্স কিছু লোক আসে ওকজা কে দেখার জন্য, এবং জনি তাকে নির্বাচন করে শ্রেষ্ঠ শূকর হিসেবে। মিজার অজ্ঞাতসারে ওকজাকে নিয়ে চলে যাওয়া হয় সিওল।

মিজা এই আঘাত সামলে নিয়ে মনস্থির করে সে ফিরিয়ে আনবে ওকজাকে। সেই মতো সে সিওল পৌঁছায়, ওকজাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে, এবং ঘটনাচক্রে তার পরিচয় হয় এ্যানিমাল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য জে(পল ডানো) তার বন্ধুদের সাথে, যাদের উদ্দেশ্য ওকজাকে বাঁচানো আর লুসি মিরান্ডোর কীর্তিকলাপ পৃথিবীর সামনে ফাঁস করে দেওয়া।

তারা পরিকল্পনা করে ওকজার সাথে একটা ট্রান্সমিটিং যন্ত্র লাগিয়ে তারা ওকজাকে লুসির গোপন গবেষণাগারে পাঠাবে, যেখানে সে বিভিন্ন প্রাণীদের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা করে অথচ বাইরে রটায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাণীগুলোর পালন হয়। তারপর প্রতিযোগিতার দিন সবার সামনে প্রকাশ করবে সেই ভিডিও।

ইতিমধ্যে লুসি ঠিক করে প্রতিযোগিতার দিন সবার সামনে মিজার সাথে ওকজার দেখা করিয়ে জনগণের কাছে নিজের মানবিক ভাবমূর্তি বজায় রাখবে, তাই মিজাকে কোম্পানির মুখ করতে চায়।

এরপর দ্রুত ঘটতে থাকে বিভিন্ন ঘটনা, অনেক চেষ্টার পরেও ওকজা ধরা পড়ে যায় মিরান্ডোর হাতে এবং শেষ অবধি মিজা ওকজা এবং আরেকটি শূকরছানাকে নিয়ে ফিরে যেতে সক্ষম হয় পাহাড়চূড়ায়।

পুরো সিনেমাটা শেষ করেওয়াওবলে ওঠার মতো নয় মোটেও, জায়গায় জায়গায় অনেক প্রশ্ন জাগে, যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয়, কিন্তু তাও যখন ওকজাকে গোপন গবেষণাগারে জোর করে সঙ্গমে বাধ্য করা হয় আল্ফান্সো নামের আরেক জেনেটিকালি মিউটেটেড শূকরের সাথে, এবং তা দেখে জে এবং তার বন্ধুদের কষ্টের অভিব্যক্তি, অথবা যখন ওকজা আর মিজার মিট প্রোডাকশন হাউস থেকে বের হওয়ার পথে এক শূকর দম্পতি ইলেকট্রিক বেড়ার আঘাত সহ্য করেও তাদের ছানাকে ঠেলে বের করে দেয় খোঁয়াড় থেকে, কোথাও যেন আমাদের আবেগ, অসহায়তাগুলোও জুড়ে যায় মুহূর্তগুলোর সাথে। শেষটা মিলনান্তক হলেও তাই একটা হালকা বিষাদের রেশ রয়ে যায়। 

টিলডা সুইন্টনকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে অন্যতম প্রিয় অভিনেত্রীর স্থানে রাখি, ভদ্রমহিলা যেভাবে নিজের লুকস পাল্টাতে পারেন চরিত্র অনুযায়ী, তা প্রশংসনীয়। জেক গিলেনহাল জনি উইলকক্সের চরিত্রে বেশ একটা কমিক ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন, যদিও সিনেমাটাতে তিনি পার্শ্বচরিত্র হিসেবেই রয়ে গেছেন। মিজার চরিত্রে ছোট্ট মিষ্টি আনও বেশ সাবলীল। পল ডানোর নিরীহ মুখের সাথে তার ব্যক্তিত্বটা বিপরীতধর্মী মনে হল একটু। এছাড়া পার্শ্বচরিত্র হিসেবে লিলি কলিন্সও ভালো অভিনয় করেছেন।

সিনেমাটাতে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে প্রথম থেকেই। যেমন, ওই প্রত্যন্ত পাহাড়চূড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ থাকা কতোটা বাস্তব? বা মিজার মতো ছোট মেয়ে পকেটে কিছু খুচরো নিয়ে কিভাবে শহর সম্পর্কে অজ্ঞ হয়েও এতো তাড়াতাড়ি সিওল পৌঁছতে পারে? মিরান্ডোর মতো কোম্পানীর অফিসে বা মিট প্রোডাকশন হাউসে এতো সহজে যে কেউ ঢুকে যেতে পারে? শেষ অবধি ওকজা কি বলল মিজার কানে কানে? এরকম ইতিউতি ছোটখাটো সন্দেহ রয়েই গেছে জায়গায় জায়গায়। ওকজাকে অনেক জায়গায় কুমড়োপটাশের মতো দেখতে মনে হয়েছে আমার।

নেটফ্লিক্স গত দুতিনবছরে যে কটা চলচ্চিত্র বের করেছে, তার হিসেব করলে হয়তো প্রথম পাঁচের মধ্যেও এটা থাকবে না। তবু এই সিনেমাটা চোখ টেনেছে, কারণ খুব সরল একটা কাহিনীর মাধ্যমে কিছু জটিল প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে, যেটা আদতে খুবই কঠিন কাজ। 

খল আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে। শুধু সমাজের বৃহৎ অংশ যখন সেই খল মানসিকতাকে জাস্টিফাই করে মানবজাতির স্বার্থে, তখনই সেটাপ্রয়োজনএর রূপ নেয়। আর সেই প্রয়োজনকেই ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করে কিছু মানুষ। তাই যখন মিরান্ডা কর্পোরেশনের কর্ণধার মুখ দিয়ে বের হয়, ‘দাম সস্তা করলে সমস্ত মানুষ কেনার জন্য ছুটে আসবে!’ তখন ভোগবাদের করালগ্রাসে আক্রান্ত এই সমাজের নগ্ন সত্যটা একটু বেশিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বুঝিয়ে দেয় ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য আদর্শের মৃত্যু ঘটানোটা অস্বাভাবিক নয় আজকের সমাজে। তবুও এর মধ্যেও শুধু কিছু মানুষ সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায় বুকের মধ্যে থাকা ভালোবাসায় ভর করে। এরাই শেষ অবধি বুঝিয়ে যায় বেঁচে থাকার অর্থ!

কে ভালো? কে খারাপ? কেনই বা খারাপ? যারা নিজের ভালোবাসার প্রাণীটিকে বাঁচাতে জীবনপণ করে তারাই ভালো, নাকি যারা খাদ্যসমস্যার সমাধানেই জন্য একপ্রকার সমাধানে পোঁছতে চায় মানুষের স্বার্থে, হোক না ব্যবসায়িক মানসিকতাসম্পন্ন, তাদের বাস্তববোধকে কতোটা উপেক্ষা করা যায়? জটিল প্রশ্ন গুলো মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় সিনেমা চলাকালীন।

তাই ওকজাকে নিয়ে খোঁয়াড় থেকে বের হয়ে আসার পথে মিজা যখন শুনতে পায় অন্য শূকরগুলোকে গুলি করে মারার শব্দ, তার অসহায়তাটা যেন আমাদেরও গ্রাস করে। ভালোবাসার প্রাণীটার জন্য আমরা পৃথিবীর শেষ অব্ধি যেতে পারি, কিন্তু একই পরিস্থিতিতে থাকা আরেকজনের জন্য কতোটা দিতে পারি নিজের?

যতোই ভালোবাসায় বাঁচি, দিনের শেষে হয়তো আমরা নিজের স্বার্থরক্ষাতেই ফিরে যাই, ব্যক্তিগত সুখটুকুই মুখ্য হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।

ওকজা সেই স্বার্থের ওপরই এক বৃহৎ চপেটাঘাত।   

~~~☀️ সমাপ্ত ☀️~~~

লেখক ~ দেবায়ন কোলে

প্রচ্ছদ ~ google

www.facebook.com/anariminds

#AnariMinds #ThinkRoastEat