দর্শকের চোখে – লাভিং ভিনসেন্ট

Anari Talkies, Anirban & Arijit, Movie, Reviews, দর্শকের চোখ, বাংলা

টাইটেলঃ লাভিং ভিনসেন্ট
পরিচালকঃ ডরোটা কবিয়েলা আর হিউ ওয়েলশম্যান

পেশায় পোস্টম্যান জোসেফ র‍্যুঁলা ছেলে আরমান্দকে একটা কাজ দিলেন। কাজটা হল একবছর আগে মৃত ভিনসেন্ট ভ্যান গগের লেখা শেষ চিঠি তার ভাই থিওর হাতে পৌঁছে দিতে হবে। একরকম নিমরাজী হয়েই আরমান্দ চিঠিটা নিয়ে এল প্যারিসে। এসে জানতে পারল থিও ছয়মাস আগেই মারা গেছে। থিও এক স্ত্রী আছে, তার হাতেই তবে চিঠিটা দিতে হবে। কিন্তু সেই মেয়েটির খবর কেউ জানে না। আরমান্দ এবারে এল ছোট্ট গ্রাম অভারে। ভিনসেন্টের জীবনের শেষ কয়েকটা মাস কেটেছে যেখানে। সেই গ্রামের ডাক্তার গাশেটের সাথে ভিনসেন্ট আর থিওর সখ্যতা ছিল ভাল। তার কাছে যদি জানা যায় থিওর স্ত্রীয়ের খবর। আরমান্দের মনের বিশ্বাস এও যে ভিনসেন্টের মৃত্যু আসলে আত্মহত্যা না, খুন। আরমান্দ নিজেই তার তদন্ত করতে লেগে পড়ল। তাতে জড়িয়ে গেল অভার গ্রামের সরাইখানার মালিক, তার মেয়ে, ডাক্তার গ্যাশেট আর তার কন্যা, এমনকি এক মাঝিও। শেষে কি আরমান্দ পারল রহস্যভেদ করতে?

গোটা গল্পের আদ্যপান্ত বানানো। ভ্যানগগ ২৮ বছর বয়সে প্রথম রঙ তুলিতে হাত দেন। তারপরের দশ বছরে এঁকে ফেলেন ২০০০ এরও বেশি ছবি। কোন মানসিক স্থিতি ছিল না ভিনসেন্টের। ওর মনের অবসাদের রঙ গুলোই ফুটে উঠত ক্যানভাসে। সেই মানুষটাই একদিন হটাৎ করে গুলি করে বসেন নিজেকে। অভার গ্রামের সরাইখানার দোতলার ছোট্ট ঘরে মারা যান ভিনসেন্ট ভ্যানগগ।

ভ্যান গগের জীবদ্দশায় কেউ ওকে নিয়ে মাতামাতি করেনি। মাত্র একটা ছবি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি? পরে গোটা পৃথিবী তোলপাড় হয়েছে ওঁর এক একটা অয়েলপেন্টিংকে নিয়ে। স্টারি নাইট, সানফ্লাওয়ার, হুইটফিল্ডের কপি এখন শোভা পায় ড্রয়ং রুমে। মনোবিজ্ঞানীরা উঁকি মারার চেষ্টা করেন ওঁর মস্তিষ্কের গভীরে। ফ্রেঞ্চ ইম্প্রেশনিস্টদের মধ্যে সবার আগে উঠে আসে ওঁর নাম। ভ্যান গগকে নিয়ে বেশ কয়েকটা সিনেমাও তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু এমন সিনেমা আগে কখনও তৈরি হয়নি। আর কোনও দিন হবে কিনাও সন্দেহ আছে।

এ যেন গঙ্গার জলেই গঙ্গার পুজো। ভ্যান গগের আঁকার অনুকরণেই একটা গোটা সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন ডরোটা কবিয়েলা আর হিউ ওয়েলশম্যান। সিনেমার প্রতিটা ফ্রেম হাতে আঁকা। কুড়িটা দেশের ১২৫ জন আঁকিয়ে ৪ বছর ধরে এঁকেছেন সেগুলোকে। সব মিলিয়ে ৮৫৩টা শট, ৮৫৩ টা ক্যানভাস। অ্যানিমেশনের জন্য একটা ক্যানভাসের ওপরেই অনেকবার আঁকা হয়েছে। তেলরঙে সেই সুবিধাটা পাওয়া যায়। আর তার ফলে যেটা তৈরি হয়েছে সেটার কোন তুলনা হয় না। একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা এটা। এইটুকুই বলা যায়।

লাভিং ভিনসেন্ট তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র ভিনসেন্টের প্রতি ভালবাসা থেকে। যার কণামাত্র শিল্পী পাননি এই পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সময়। সিনেমাতে মারা যাওয়ার আগে ভিনসেন্ট ডাক্তার গ্যাশেটকে বলেন, “ মে বি ইট ইস বেটার ফর এভরিওয়ান”। হয়ত এটাই সত্যি। ভিনসেন্টের অসময়ে ফুরিয়ে যাওয়াই হয়ত ওকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে।

সিনেমা শেষের টাইটেল ক্রেডিটে দেখা যায় এই গল্পের প্রতিটা চরিত্রকে শিল্পী নিজেই এঁকে গেছেন। যেন গোটা গল্পটাই ভিনসেন্টেরই লেখা। নিজেই ঠিক করেছেন তার চলন। লাভিং ভিনসেন্ট আদতে কোন রহস্যগল্প নয়, বরাবরের অবহেলিত শিল্পীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণের দলিল নয়। লাভিং ভিনসেন্ট আসলে একটা মানুষের জীবনের উদযাপন, যে অন্যরকম ভাবে দেখেছিল চারপাশটাকে। যাকে কেউ বুঝতে পারেনি।

আমাদের এই নশ্বর শরীরের কি বা মূল্য। মানুষ তো বেঁচে থাকে তার সৃষ্টির মধ্যে। ভিনসেন্টের নিজের কথায়,

“আমি যখন আঁকি শুধু মাত্র তখনই নিজেকে জীবন্ত মনে হয়।”

~~~♠~~~

রিভিউ ~ অনির্বাণ ঘোষ

One thought on “দর্শকের চোখে – লাভিং ভিনসেন্ট

Comments are closed.