বাকিটা ইতিহাস

Friends, Protest, Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

জেনেভা থেকে কালই মেলটা এসেছে।১লা ফেব্রুয়ারিতে কাবুল যেতে হচ্ছে আমায়।ব্যাপারটা এখনও বাড়িতে জানানো হয়নি।শুধু শুধু চিন্তা করবে সবাই।আমি,জয়দীপ বসু,সিনিয়ার টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর,জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার,থিঙ্কলাইফ ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত আছি গত পনেরো বছর হল।সারা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোয় মহিলা ও শিশু নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে থিঙ্কলাইফ।আমার কাজ আমায় বার বার বারমুখো করেছে,গত পনেরো বছরে আফ্রিকার বেশ কয়েকটা দেশে ঘুরে ঘুরে কাজও করেছি তবে হিন্দুকুশের দক্ষিণে এই প্রথম।কলকাতায় বাবা মার কাছে যাবো একবার কাবুল যাওয়ার আগে,গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে।আমার পিতামহ স্বর্গীয় শ্রী শচীন্দ্রনাথ বসুর একটা ডায়েরি খুঁজে পেয়েছিলাম,আগেরবার ছুটিতে কলকাতায় গিয়ে।আমার কাছে ওটা একটা অমূল্য সম্পদ।1946 এর কলকাতা দাঙ্গার ওর থেকে প্রামাণ্য দলিল আর হয় না,ইচ্ছা আছে ইংরাজীতে অনুবাদ করার।পাবলিশার জুটে যাবে আশা করি।এবার কলকাতায় গিয়ে ডায়েরিটা সাথে নেব কাবুল যাওয়ার আগে।বিদেশে কাজের চাপ থাকলেও বাড়ি ফিরে বিশেষ কিছু করার থাকে না,আর কাবুলে কোনো পূর্ব পরিচিতি না থাকায় সন্ধ্যাগুলো ফাঁকাই কাটবে মনে হয়।তখন অনুবাদ করেই সময় কাটবে।মনটা উৎফুল্ল হয়ে আছে সেই ভেবেই।এখনও একমাস সময় আছে হাতে অতএব হায়দ্রাবাদের এই সুন্দর শহরটায় চুটিয়ে কাটিয়ে নিতে চাই শেষদিনগুলো।প্রত্যেক শহরই ছেড়ে আসার সময় কিছু স্মৃতি জুড়ে যায় মনের ক্যানভাসটায়,তার কোনোটা সবুজ,কোনোটার রঙ নীল,আর কোনোটা ধূসর। গতবার ঘানা থেকে আসার সময় আমার আফ্রিকান কুক মারিয়ার দশ বছরের মেয়েটা একটা মালা গেঁথে দিয়েছিল লাল সবুজ পুঁথি দিয়ে,তলায় একটা ক্রস লাগানো,দেখতে অবিকল ছোটোবেলার রথের মেলার পুঁথির হারের মত।মাঝে মাঝে যখন তাকিয়ে থাকি মালাটার দিকে,অবাক লাগে।আফ্রিকার বুকে একটুকরো পশ্চিমবঙ্গ লুকিয়ে আছে না পশ্চিমবঙ্গে একটুকরো আফ্রিকা!জানিনা,কেন যে মনে হয় বিশ্বের কোনো জায়গাটাই বুঝি আমার পর নয়,নতুন নতুন চেহারার মানুষগুলোর আড়ালে ওই তো দাঁড়িয়ে আছে আমার দাদা,দিদি,ছোটো ভাই ,বোনেরা,আমার বন্ধুরা।এবারও তাই পাব আশা করি,পামীর মালভূমি আর হিন্দুকুশের দেশে।কাবুল,আমি আসছি।
*********************************************
জেনিভাতে একটা রিক্যুয়েস্ট মেল পাঠিয়েছিলাম কাবুলের টিকিটটা কলকাতা থেকে করতে।আবেদন মঞ্জুর করেছে ওরা।আজ দুপুরের ফ্লাইটে নেমেছি কাবুলে।আমার কাবুল যাওয়ার গল্পে আমার মা বাবার থেকেও বেশি গলা শুকিয়েছে প্রতিবেশীদের।পাড়ার বিনয়কাকুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কাল,বললেন সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে ইংলিশ অনার্স করে কেউ এরকম অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়না।চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রাইভেট টিউশন করার প্রস্তাবও এসেছিল অনেকগুলো।কোলকাতাকে এই জন্যেই এত ভালোবাসি।পাশের বাড়ির ছেলেকে সবাই নিজের বাড়ির ছেলের মতই ভাবে।বম্বেতে মাস্টার্স করছিলাম যখন কলকাতাকে এই জন্য মিস করেছিলাম খুব।তারপর ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি একা থাকায়,নয় নয় করে কম তো হল না,পনেরোটা বছর বাড়ির বাইরে আমি।
কাবুলের সময় এখন দেখাচ্ছে সকাল ১১.২২,তার মানে কলকাতায় এখন প্রায় রাত ১২টা।তাপমাত্রা -1°c।মোটা প্রাদার জ্যাকেট ভেদ করে শরীরে সূঁচ ফোটাচ্ছে হিমেল হাওয়া।হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটা রাস্তা দক্ষিণপশ্চিমে বেঁকে গেছে এসটিওলাল রোডের দিকে,আমরা যাব আরও পশ্চিমে শহরতলির দিকে।আমার ডান দিকে হসমত খান লেকের নীল জল স্থির,বরফ জমা।আমার ব্ল্যাক শেভরোলেতে আমি ছাড়াও রয়েছে ড্রাইভার ইনায়ত আর সিকিউরিটি এজেন্সির আসমত খান।দুজনেই স্থানীয়,পশতু ভাষায় দক্ষ আর ইংরাজীটাও বেশ ভালোই বলতে পারে।আমার তাই সুবিধাই হয়েছে।ব্যাগ থেকে দাদামশাইএর ডায়েরিটা বার করে নিয়েছি পড়ব বলে,হঠাৎ আসমত চেঁচিয়ে উঠল, খতরনাক,কাজেম,কাজেম।কিছু বুঝে ওঠার আগেই খান পাঁচ ছয় কালো জোব্ব‍া পরিহিত মুখ ঢাকা আফগান গাড়িটাকে থামিয়ে দিয়েছে।ইনায়তকে ওরা পশতুতে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল,উত্তরটা মনে হয় সন্তোষজনক হয়নি।একজন হাতের কালাশনিকভের বাটটা দিয়ে ইনায়তের মাথায় বেশ জোরে একটা গুঁতো মারতেই রক্তাক্ত হয়ে গেল ওর কপালটা,মুহুর্তে ইনায়েত অজ্ঞান হয়ে গেল।পাশে আসমতকে দেখলাম ভয়ে মুখ চুন হয়ে গেছে।দরজা খুলে ঢুকে পড়েছে এবার লোকগুলো।আমার আর আসমাতের পিঠে এখন খোঁচা দিচ্ছে কালাশনিকভের ব্যারেলের অগ্রভাগ।ইনায়তকে ড্রাইভার সিট থেকে সরিয়ে দিয়েছে একটা দশাসই আফগান,না ওদের আফগান বলা ভুল হবে।এতক্ষণে বুঝেই গিয়েছি তালিবানের কবলে পড়েছি আমরা।তালিবানদের আফগান বলা যায় বলে মনে করি না আমি,কোনো জঙ্গির কি কোনো দেশ থাকতে পারে?দেশবোধ থাকলে কি তারা জঙ্গি হতে পারে?
ড্রাইভিং সিটের দখল নিয়েছে এক তালিবান।গাড়ি এখন ছুটতে শুরু করেছে আরো উত্তরে।ব্যাগে ঝোলানো কি-রিংটায় কম্পাস আছে একটা,তাই দিকটা বুঝতে পারছি।আমার পাশের জঙ্গি আমার আর আসমতের ব্যাগ হাতড়িয়ে ফোনগুলো বার করে ফেলেছে,কম্পাসটায় চোখ পড়েনি এখনও।দেখলে খুলে নিত নিশ্চয়ই।বাঁদিকে রুক্ষ প্রান্তর দেখতে পাচ্ছি,শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্তে চলছি আমরা।কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ওরা আমাদের চোখ বাঁধেনি।আমি নয় বিদেশী,আমার কাছে এদেশের সব দিকই অচেনা কিন্তু আসমতের চোখ না বাঁধার কারণটা বুঝলাম না,হয়ত ওদের কবল থেকে মুক্তি না পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে ওরা এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে এসবের তোয়াক্কা করেনা।জীবনে প্রথম বার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে,এটাকেই কি ভয় বলে?
**********************************************
কাবুল ছাড়িয়েছি দশ ঘন্টা আগে,মাঝখানে দু তিন বার গাড়ি থেমেছিল প্রাকৃতিক প্রয়োজনে।কিছু খাওয়াও হয়নি গত বারো ঘন্টায়,আগের বার যখন নেমেছিলাম স্ফীত ব্লাডারকে খালি করতে,তীব্র হাওয়ায় দাঁড়াতে পারছিলাম না।তুষারপাত হচ্ছে ক্রমাগত।তুষারপাতের ফলে রাস্তা বন্ধ হয়েছেও কয়েকবার।জঙ্গিরা তবে খুব তৎপর,বেলচা দিয়ে সমানে রাস্তায় জমা তুষার কেটে গাড়ি ছোটাচ্ছে।আমি এখন পণবন্দী,রাজনৈতিক ভাষায় যাকে হোস্টেজ বলে,তা না হলে এতক্ষণে মেরে ফেলত নিশ্চয়ই।আমায় টোপ রেখে ওরা কি আদায় করবে সরকার থেকে?টাকা পয়সা,অস্ত্র,আরও ক্ষমতা?কি জানি!শুনেছি পণবন্দীদের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যত্র শালীন ব্যবহার করা হয়।আমার কপালে কি আছে জানি না।তবে আমার জীবনের বিনিময়ে কোনো অন্যায্য দাবি মিটুক সেটা প্রাণপণে চাইনা।ইনায়তের হুঁশ ফিরেছে অনেকক্ষণ।পরিস্থিতি দেখে চুপ করে গেছে ও।তালিবানরা এত নির্বিবাদী হোস্টেজ আগে পেয়েছে বলে মনে হয় না।আমি একবারও জিজ্ঞাসা করিনি আমাকে নিয়ে ওরা কোথায় চলেছে।কোনো লাভ হবে না জানি।বিপদের সময় আতঙ্কিত হলে বিপদ আরও বাড়ে,জেভিয়ার্সের ফাদার বলতেন।
খানিকদূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে।গাড়ির গতিও আলোটাকে দেখে শ্লথ হয়েছে।মনে হচ্ছে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।গাড়ি থেকে নামা মাত্র ঠান্ডায় পাটা অবশ হয়ে যায়,মোটা বুটের চামড়া আর পশমের গ্লাভস্ ভেদ করে হাড়ের কাঁপানি শুনতে পাচ্ছি যেন।তাপমাত্রা এখন নিশ্চয়ই -5 বা -6°c।অনবরত তুষারপাতের ভিতর দিয়ে আমাদের ঘিরে নিয়ে চলে জঙ্গিদের দল।একটা মাটির বাড়ি,ছাদে খড়ের ছাউনি,তার সামনে অনেকখানি উঠোন,অনেকটা আমাদের পশ্চিমবাংলার গ্রামদেশের মতন,আলোর ক্ষীণ রেখা দেখা যাচ্ছে ওখান থেকেই।পরপর একই ধরণের অনেকগুলো বাড়ি রয়েছে।প্রত্যেকটা বাড়িকে ঘিরে দেড়মানুষ সমান উঁচু মাটির পাঁচিল,পাঁচিলগুলোয় আর বাড়ির দেওয়ালে সাদা রংএর প্রলেপ।আজ আকাশে পূর্ণচন্দ্র।জোছনায় ভেসে যাচ্ছে আফগান গ্রাম।তালিবানরা সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে এটা পড়েছিলাম কোনো এক পত্রিকায়।আমার আর আমার সঙ্গীদের হাত এতক্ষণে পিছুমোড়া করে বেঁধেছে ওরা,পিঠে কালাশনিকভের গোঁত্তাটা টের পাচ্ছি ভালো ভাবে।নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য পশতোতে কথা বলে চলেছে ওরা,আসমত আর ইনায়ত নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে।সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের দরজাটা খুলে ঠেলে ঢোকায় ওরা।একটা বড় ঘর,অন্য আসবাবের বালাই নেই,শুধু মেঝেতে একটা তক্তাপোশ আর তার উপর একটা ছেঁড়াখোড়া গালিচা।দেওয়াল ঘেষিয়ে বেশ কয়েকটা তাকিয়া পাতা।দেওয়ালেও গোটাচারেক ওয়াল হ্যাঙ্গিংএ কিছু লেখা,তবে ঘরের মোমবাতির আলোয় ভীষণ অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।আসমত আর ইনায়েতকে এঘরেই থাকতে হবে মনে হয়,দুইচারজন জঙ্গি ওদেরকে ঘিরে রেখেছে।আমাকে ওরা নিয়ে চলল আরো ভিতরে,সরু একটা করিডর ধরে।দুপায়ের বদলে হাঁটু গেড়ে চলা শুরু হয়েছে।সাধারণ গ্রাম্য বাড়ির ভিতরে তালিবান বাঙ্কার।অন্ধকার নিশ্ছিদ্র এখানে।এ আঁধারের শেষ কোথায়?
*********************************************
যে ঘরটায় আমি এখন আছি তাতে একটা দুই বাই তিন ইঞ্চির ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরের জগতের আলো হাওয়া প্রবেশ করে।ঘর বললে ভুল হবে,একটা খুপরি এটা।মাথা সোজা করে রাখা যায় না এতটাই নীচু ছাদ।গত তিন দিন ধরে একভাবে শুয়ে বসে আছি,খিদে পেলে শক্ত আফগানি রুটি খাচ্ছি।জামাকাপড় ছাড়ার বালাই নেই।প্রবল শীত তাই নাহলে নিজের গায়ের গন্ধে নিজেরই টেকা দায় হত।পাশেই নোংরা পুতিগন্ধময় টয়লেট।আমার পাহারায় আছে পনেরো ষোলো বছরের একটি বাচ্চা ছেলে।শুনেছিলাম এরা ছোট শিশুদেরও অপহরণ করে নিজেদের দলে ভেড়ায়,পরবর্তীকালে জঙ্গি হওয়ার ট্রেনিং দেওয়ায়।সেইরকমই কোনো হতভাগ্য আফগান বাবা মার সন্তান হয়তো নাসির।নামটা জানতে পেরেছি গত তিন দিনে ওকে ওর দলের লোকেরা নাম ধরে ডাকায়।নাসিরের মুখখানি খুব সুন্দর,খুব পবিত্র,ওর হাতের বন্দুকটা ততটাই কুৎসিত আর বেমানান।দুই এক বার ভাঙা ভাঙা ইংরাজীতে কথা বলেছে ও আমার সাথে।এদিকে আসমত আর ইনায়তের কি হল জানতে পাচ্ছিনা বলে ভীষণ টেনশন হচ্ছে।ভারতীয় দূতাবাস ও আফগান সরকার এতক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজ শুরু করেছে।কি চায় এরা?নাসিরকেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার।ছেলেটা পাথরের মত চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে যেকোনো প্রশ্নের উত্তরে,তাই আমার প্রশ্নের উত্তরে কোনো জবাব দেয়নি।শুধু কালই একবার উসখুশ করতে দেখেছিলাম।দাদামশাই এর ডায়েরিটা কাল বার করেছিলাম।আমার ট্রলি থেকে সবই ওরা বার করে নিয়েছে,জামা কাপড়,টয়লেটারিজ,পেন,খাতা যাবতীয়।পড়ে আছে খান খতক দেশ থেকে আনা চকোলেট আর এই ডায়েরিটা।এই ডায়েরিটাকে কেন বাদ দিয়েছে জানি না হয়ত ওদের বিপদজনক মনে হয়নি তাই।ডায়েরিটা কাল যখন পড়ছিলাম,নাসিরকে দেখেছিলাম একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে,হয়তো ভাবছিল ছেঁড়া পুরোনো ডায়েরিটায় কি পড়ছি এত মন দিয়ে।আজও বার করেছি পড়ব বলে,হঠাৎ নাসিরের গলার অাওয়াজে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাই আমি, হোয়াট ইউ রিড এভরিডে?

অ স্টোরি।

স্টোরি?হোয়াট স্টোরি?

স্টোরি অফ টু ফ্রেন্ডস্,অফ লাভ,অফ হ্যাট্রেড্।

ইট অ বুক?

নো,ইটস অ হ্যান্ডরিটেন ডায়েরি অফ মাই গ্র্যান্ডফাদার।হাউ ডু ইউ নো ইংলিশ?

আই ওয়েন্ট টু স্কুল।

দেন হোয়াট হ্যাপেনড?
নাসির চুপ করে যায়।এর বেশি বলার পারমিশান ওরও নেই বুঝতে পারি আমি।
ইউ ওয়ান্ট টু লিসেন টু দ্য স্টোরি?
খানিকক্ষণ ভাবে নাসির,তারপর বলে নো।ঘরের বাইরে ওর দলের একজন কেউ হাঁক দেয় ওর নাম ধরে ডেকে।মধ্যবয়স্ক এক জঙ্গি ওকে কিছু একটা বলে।বেরিয়ে যায় নাসির।বদলে ঘরে ঢোকে দীর্ঘদেহী জঙ্গি।
**********************************************
তিনদিন থেকে নাসিরকে ডায়েরি পড়ে শোনাচ্ছি আমি।দিনের বেলায় গল্প শুনতে ও আগ্রহী নয়,অগত্যা রাতের বেলা নাসিরের ইলেকট্রনিক ইউএস মিলিটারি ওয়াচের টর্চ লাইট জালিয়ে ডায়েরি পড়া শুরু করেছি।নাসির আমার থেকে হাত দুয়েক দূরে একটা টুলের উপর বসে আছে।প্রথম দিন না করেছিল,আজ নিজেই বলল ডায়েরি পড়ে শোনাও।মূল ডায়েরি পাঠের আগে নাসিরকে পাকিস্তান ভারত বিভাজনের পূর্বকথন শোনাতে হয়েছে।খানিকটা দেখলাম ছেলেটা জানে,জি.কেটা নেহাত মন্দ নয়।
১৯৪৬ এর জানুয়ারি মাস থেকে জুলাই মাস অবধি ডায়েরিতে গতানুগতিক রোজনামচা লেখা আছে।কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কলকাতা দাঙ্গা হয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ ও আছে।শচীন্দ্রনাথ বসুর আর তার প্রাণাধিক প্রিয় বাল্যবন্ধু আলতাফ হোসেনের জীবনের সত্যি গল্প এই ডায়েরির পাতায় পাতায়।তবে রোজনামচা আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাসিরকে শোনাতে আমি ততটা আগ্রহী ছিলাম না,যতটা আগ্রহী ছিলাম শচীন আর আলতাফের গল্প শোনাতে।তাই খানিকটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ডায়েরিটা পড়তে শুরু করেছি 1946 এর 15ই আগস্ট থেকে।পড়ছি আর ইংরাজীতে অনুবাদ করে ওকে বলছি।এক এক দিন এক পাতা করে।

১৫ই আগস্ট
কাল ১৬ই আগস্ট,মুসলিম লীগের তরফ থেকে প্রতক্ষ্য সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়েছে।আমাদের বেনিয়াপুকুরের পাড়াটায় ষাটভাগ হিন্দু,চল্লিশভাগ মুসলিম।আলতাফ এসে আমায় বলছিল,কলকাতায় বড়সড় দাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা আছে।ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে সবাই।কাল কলেজে বিনোদ বলছিল,ভবানীপুরের নর্দান পার্কের সব রেলিং কে যেন খুলে নিয়ে গেছে গত পরশু।সকালে বাবা বলছিলেন,দুর্জয় ঘোষের ছেলেকে পাড়ার রহমতের দোকনে ছুরি শান দিতে দেখেছেন।আলতাফ কাল দেখেছে মুসলমান ছেলেদের হোস্টেলে অনেক অস্ত্র জমা হচ্ছে।পাড়ার কয়েকজন বাড়ির মেয়েদের পশ্চিমে পাঠিয়ে দিয়েছেন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে।মা আর ইন্দুকে কোথায় পাঠাব?বাবাও বৃদ্ধ হয়েছেন,অশক্ত।আলতাফের বাড়িতেও বৃদ্ধ আব্বু ও আম্মি আছেন,হামিদা ভাবি রয়েছেন।তবে,আমি আর আলতাফ হাতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি,যদি খারাপ কিছু হয়ও,আমি আর ও প্রাণপণে ঠেকাবো।যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ ।

১৬ই আগস্ট,১৯৪৬
আমার আর আলতাফের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে।সারা কলকাতায় আজ বীভৎস নরহত্যা শুরু হয়েছে।আমাদের অধ্যাপক গৌরীনাথ শাস্ত্রীর বাড়িতে সকাল সাড়ে নটা নাগাদ লীগের একটা বিশাল মিছিল আক্রমণ করেছিল।স্থানীয় হিন্দুরা বাধা দেওয়াতে দুই দলের মধ্যেই লড়াই বেঁধেছে।বেশ কয়েকজন ক্যাম্পবেল হাসপাতালেও ভর্তি আছে।
আজ সকালে ইন্দুকে খুব বকেছি,কোন বন্ধুদের কথা শুনে চিলেকোঠার ঘরে লাঠিসোটা,দা এসব লুকাচ্ছিল,আমি বকাতে মেয়ের কি কান্না,বলে,দাদা যদি কিছু হয়ে যায়।মেয়েমানুষের কাছে তার জীবনের থেকেও তার ইজ্জতের দাম বেশী,বুঝি আমি।মাঝে মাঝে অসহায় লাগে খুব।যেসব হাতগুলো ধরে বড় হয়েছি,যাদের বাড়ির উঠানে খেলেছি,তাদের আজ অবিশ্বাস করতে হবে?আলতাফ,আমার ভাই,আমার বন্ধু,চার দিদির পর ওকেই তো ভাই বলে ভেবেছি। ওকেতো মুসলিম বলে আলাদা করে ভাবিনি।ও বলে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের ঝগড়ার বলি হবে সাধারণ মানুষ।একদল বলে লড়কে লেঙ্গা পাকিস্তান,আর এক দল বলে নেহী দেঙ্গে পাকিস্তান।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বাংলা ভাগের বিরোধী কিন্তু মুসলিম লীগের দাবিটাও একেবারে অন্যায্য ভাবতে পারছি না।আমাদের পূর্বপুরুষের পাপের ভাগ আমাদের আজ বহন করতে হচ্ছে।কিসের জন্য দেশগাঁয়ের সাধারণ মুসলিম এত ক্ষেপে উঠেছে?শত শত বছরের দাম্ভিক জমিদারি প্রভুত্বের তলায় ওরা চাপা পড়েছিল।আমরা হিন্দুরা পাশ দিয়ে কুকুর বেড়াল গেলে খাবার ফেলি না অথচ মুসলমান পথ মাড়ালে গেলাসের জলটুকুও ফেলে দিই।এত দ্বেষের প্রতিদান কি এ দেশ রক্ত দিয়ে দেবে?

১৭ই আগস্ট
আজকের দিনটার মত কালো মর্মন্তুদ বেদনার দিন আগে একটাও দেখিনি।সারাদিনে আজ যা রক্তক্ষয় দেখেছি,তার বিবরণ লিখতে বসে আমার হাতও যেন রক্তে আর ক্লেদে ভরে উঠছে।শুধু বিধর্মী বলেই কাউকে হত্যা করা,তার শিশু,তার নারীকে নিপীড়ন করা এ আমি মানতে পারছি না।আলতাফ আর আমি ভেবেছিলাম এ গৃহযুদ্ধ ঠেকাব কিন্তু এই উন্মত্ত জনতাকে থামাতে শতসহস্র শচীন আর আলতাফ প্রয়োজন।
আজ সকালে ব্যানার্জী বাড়ির উপর বোমা পড়ে প্রথম।কেউ বাঁচেনি ওরা।পাশের বাড়ির যদুদাকে দেখলাম বন্দুক নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে মানুষ মারছে।এই যদুদাই ইদের সময় আলি ভাইদের সঙ্গে কোলাকুলি করত।স্টেটসম্যান পত্রিকায় ছবি বেড়িয়েছে এন্টালি আর শোভাবাজারের অলিতে গলিতে পড়ে আছে লাশ।মোড়ের মাথার রহমতের দোকানটা জ্বালিয়ে দিয়েছে,আলতাফ আর আমি কোনোমতে রহমতকে বার করে নিয়ে এসেছি।
বাবা আর ইন্দু ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।মা সারাদিন গোপালের কাছে ইষ্টনাম জপ করছে।আলতাফের আব্বু আমায় বলছিলেন অন্য কোথাও চলে যেতে।কোথায় যাব এদের নিয়ে?হা ঈশ্বর আমায় পথ দেখাও!

এর পর ১৮ই আগস্ট থেকে ২০শে আগস্ট পর্যন্ত ডায়েরিতে কিছু লেখা নেই।

২১শে আগস্ট
আলতাফ,আমার ভাই,আমার বন্ধু পাগল হয়ে গেছে।আজ এ কথা লিখতে আমার চোখ ফেটে জল আসছে।গত পরশু থেকে হামিদা ভাবিকে পাওয়া যাচ্ছিল না।আজ সকালে ভাবির শরীরটা একটা ম্যান হোলের মধ্য থেকে পাওয়া গেছে।আলতাফকে সামলানোর চেষ্টা করলাম অনেক ভাবে।রক্তবর্ণ চোখ করে বসেছিল গোঁজ হয়ে।শেষে খালি একটাই কথা বলল,বেরিয়ে যাও শচীন।তোমার বন্ধু আলতাফ মারা গেছে।

এরপর আবার চারদিন ডায়েরিতে কিছু লেখা নেই।
২৫শে আগস্ট
আজ সকালে বেনিয়াপুকুর থেকে ভবানীপুর চলে এসেছি আমরা।হিন্দু রিলিফ সোসাইটির ক্যাম্পে।আলতাফকে বাঁচাতে পারলাম না।ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে একের পর এক হিন্দু মারছিল ও।গতকাল বাড়ি থেকে বেরনোর সময় পাড়ার ছেলেরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে ওকে।বাঁচাতে গিয়েছিলাম আমি।বেধড়ক মার খেয়ে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।মরেই গেছি ভেবেছিল ওরা।তাই যদি সত্যি হত!আলতাফ চলে গিয়ে আমার হৃদয়ের একটা দিক উজাড় করে দিয়ে গেল।বাঁচাতে পারিনি ওকে।এ পাপ রাখব কোথায়?এ মরা দেশ ভাগ হবে কিনা জানি না কিন্তু যে ভাগ মানুষগুলোর মধ্যে হয়ে গেল তার ভাগশেষ কোনোদিন থাকবে না।এ ভাগ মিলবে না…এত মানুষের অভিশাপ..এ ভাগ মেলার নয়।

এতটা পড়ে আমি চুপ করে থাকি।নাসির বলে ওঠে ‘দেন?’
দেন হি ডিডনট্ রাইট এনি মোর।ঠাকুমার কাছে শুনেছি,শচীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন ঘুমের মধ্যে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠতেন।দীর্ঘ জীবন বেঁচে ছিলেন কিন্তু অভিশাপের মত জীবনটাকে বয়ে বেড়াতেন।

ইউ পিপল ইন ইন্ডিয়া স্টিল ফাইট লাইক দিস?
ইয়েস উই ডু।আওয়ার কান্ট্রি ইস ডিভাইডেড সো আর উই।পার্মানেন্টলি।ভায়োলেন্স ব্রিংস ওনলি ভায়োলেন্স।

নাসির চুপ করে থাকে।আমি জিজ্ঞাসা করি,আসমত আর ইনায়ত কোথায়?

আসমত ইজ ডেড।টুমরো ইফ দে ডোন্ট লিসন টু আওয়ার ডিমান্ড উই আর গোয়িং টু কিল ইনায়ত,মে বি দেন ইউ।

নাসিরের গলায় নিজের মৃত্যু পরোয়ানা শুনে অদ্ভুত লাগল।কষ্ট হল আসমাতের জন্য।বলে উঠলাম,হোয়াট মাই গ্র্যান্ডফাদার ফেসড ইউ পিপল আর ডুয়িং দ্য সেম।ইউ আর কিলিং ইয়োর ওন পিপল।হোয়াট ডিমান্ড ইউ হ্যাভ?

আই ডোন্ট নো এস্কাক্টলি।

আর ইউ গোয়িং টু কিল পিপল ফর রিজন ইউ ডোন্ট নো?
চুপ করে থাকে নাসির।ঘুম নেমে আসে আমার চোখে।আফগান জেলে,নাকি এই পৃথিবীর বুকে এটাই আমার শেষ ঘুম?
**********************************************
সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি পায়ের কাছে ডায়েরিটা খোলা পড়ে আছে,নাসির মনে হয় রাতে আবার উল্টে পাল্টে দেখেছিল।এখন ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই,যদিও ঘরের বাইরের কাঠের আগল দেওয়া তাও একা অরক্ষিত অবস্থায় আমায় ফেলে ছেলেটা কোথাও যায় না।সবে এসব ভাবছি হঠাৎ আগল সরিয়ে ঘরে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকল আগের দিনের মধ্যবয়স্ক জঙ্গি।
কিছু বলার সুযোগ দিল না লোকটা, ঘাড়ের কাছটা ধরে টানতে টানতে অন্ধকার করিডর দিয়ে নিয়েচলেছে আমায়।হঠাৎ সূর্যের প্রবল আলোতে চোখ ঝলসে যায় আমার,বুঝতে পারি খোলা কোনো জায়গায় এসে পড়েছি।দিবালোকের সঙ্গে চোখ অ্যাডজাস্ট করতেই বুঝলাম একটা মাঠে এসে পড়েছি।মাঠের একধারে অনেক তালিবান জঙ্গিরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর মাঠের মাঝখানে হাঁটুমুড়ে বসে আছে ইনায়ত।আমার জীবনের থেকে এখন ওর জীবনের দাম কম,আমি একটু বেশি দামি টোপ।আমাকে ছাড়াতে সরকার ওদের দাবি না মানলে প্রথমে ইনায়তকে মারা হবে ভয় দেখানোর জন্য।সারা বিশ্বে একই ভয় দেখানোর খেলা চলছে শতাব্দী জুড়ে।ধর্মের নামে,সংস্কারের নামে।শচীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন, এ ভাগ মেলার নয়।
ইনায়তের সামনে একটা ল্যাপটপ, ক্যামেরা অন করা,ওর পাশেই হাঁটুমুড়ে বসিয়েছে আমাকে।কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা জঙ্গিরা আমার আর ইনায়তের দিকে বন্দুক তাক করে।মধ্যবয়স্ক জঙ্গি হাঁক দেয়,নাসির।কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা হলেও নাসিরের চোখদুটো দেখা যাচ্ছে।নাসিরকে ওরা পশতুতে বলছে ইনায়তকে মারার জন্য,আমি পশতু না বুঝলেও ইনায়তের মুখের অবস্থা দেখে বুঝেছি সব।নাসির ওর হাতের কালাশনিকভ তুলে তাক করেছে ইনায়তের দিকে।আমার চারপাশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ।শোঁ শোঁ হাওয়া চলছে।গুলির আওয়াজে চোখ বন্ধ করে দিই আমি।একসাথে বেশ কয়েকবার গুলি চলে।চোখ খুলে ইনায়তকে পাশে দেখে অবাক হয়ে যাই,কে মরল তাহলে?আমি নিজেই নয় তো!প্রচন্ড আতঙ্কে মানুষের হ্যালুসিনেশান হয় শুনেছি,এরকমই কিছু নয় তো?বাস্তব বুঝতে পারি যখন সামনের দিকে তাকাই।আফগান মাটির রুক্ষ প্রান্তরে পড়ে আছে নাসির।ঘটনার আকস্মিক অভিঘাতে জঙ্গিরাও হতবাক।কেউ কেউ ছুটে গেছে ওর দিকে।ইনায়ত অবাক হয়ে একটা কথাই বলল,ইটস সো আননার্ভিং স্যার।
**********************************************
কাবুল থেকে দেশে ফেরার বিমানে উঠেছি আজ।নাসিরের মৃত্যুর পর তালিবান আর আফগান সরকারের কি কথা হয়েছে জানি না,ইটস এ পলিটিক্যাল সিক্রেট।যেটুকু ভাসা ভাসা বুঝেছি আফগান জেলে বন্দি কোনো জঙ্গিকে ছাড়ানোর জন্য এই অপহরণের নাটক।কাল দীর্ঘ দশ বারো ঘন্টার সফরের পর সেনাবাহিনী আমাকে আর ইনায়তকে নিয়ে এসেছে কাবুলে।জঙ্গিরা ওদের প্ল্যানে সফল হয়েছে কিনা জানি না।হতভাগ্য নাসির ওর জীবন দিয়ে ওদের মৌলবাদের অসারতা প্রমাণ করে দিয়ে গেছে।পৃথিবীর বুকে আসমতের মত অনেক নিহত ভ্রাতার ভাই ও।ইনায়তের মত অগ্রজকে হৃদয়ে কঠিন হয়ে মারতে পারেনি তাই।এই ফাঁকতালে আমার মত নগণ্য মানুষ ছাড়া পেয়েছি।রক্তনদীর স্রোত বন্ধ হবে কিনা জানি না,আরও কত নাসিরকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে মানুষের আসলে একটাই ধর্ম,মনুষ্যত্ব?

~~~♠~~~

লেখিকা ~ পিয়া সরকার

[ঋণ স্বীকার :ছেচল্লিশের দাঙ্গা -সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং
জীবনানন্দ দাশ]