ইচ্ছেডানা

Childhood, Friends, Love Story, Saddest Stories Are The Best Stories, Short Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

বাড়ি কাঁপিয়ে একটা আওয়াজ হলো – পায়েল রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে দেখে রক্তিম বিছানার ওপর হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে কাঁদছে – আর আলমারির পাশে দেয়ালের কোনটায় ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের একমাত্র ছেলে বুবান – মাকে দেখে আবার সব ভুলে গিয়ে খিলখিল করে হেসে মেঝে থেকে একটা সুতো কুড়িয়ে নিয়ে ডাইনিং এ পালিয়ে গেলো।

কিছুই না, রোজদিনের মতো রক্তিম অফিস থেকে বাড়ি ফিরে বুবান কে মেরেছে, আর সেই ধাক্কাতেই বুবানের মাথাটা ঠুকেছে গিয়ে দেওয়ালে – মারার কারণটাও একটু অন্যরকম – না কোনো স্কুলের লেখাপড়া বা পাশের বাড়ির বাচ্চাকে মারার কমপ্লেইন এর জন্য নয় – বুবান এর চার বছর বয়স, ডাকলে শোনে না ,কোনো ইন্সট্রাকশন বোঝে না, মুখ দিয়ে উদ্ভট আওয়াজ করে, কারও সাথে স্পেশালি কোনো বাচ্চার সাথে মেশে না – এরকম নানারকম আচরণ দেখতে দেখতে রক্তিম জাস্ট ফেড আপ হয়ে গেছে।

পায়েল এর সাথে বহু বছরের সম্পর্ক, আর সেই পায়েল এবং দুই বাড়ির বাবা মায়েদের চাপেই বাচ্চার প্ল্যানিং – এখনকার দিনে যখন লোকজন ৪২ এর জন্মদিনে টিন্ডার-তুতো বয়ফ্রেন্ড থুড়ি “বিএফএফ” এর সাথে ফি-ফি আইল্যান্ডে গিয়ে ইনস্টাগ্রাম এ ছবি দিয়ে বলে “#ফিল_লাইক_২৪”, সেখানে এতো তাড়াতাড়ি নেক্সট-জেন প্ল্যানিং এর কোনো লজিক খুঁজে পায়নি রক্তিম – শুনতে খুব খারাপ লাগলেও এটাই ভীষণ রকমের সত্যি যে আজকের দিনে একটা বাচ্চাকে মানুষ করা মানে “হাতি পোষা” – শুরু হয় কনসিভ করার থেকে – হাজার গন্ডা টেস্ট, ওষুধ, মিনিমাম ৫০০-৭০০ টাকা ফিসের ডাক্তার, হবু মায়ের বিভিন্ন ট্রাইমেস্টারে বিভিন্ন অদ্ভুত ধরণের অসংলগ্ন দাবি , ভোর ৬ টায় আলুর চপ থেকে রাত ৩.৩৫ এ বাসকিন রবিন্স এর আইস-ক্রিম – এরকম নানাবিধ-বিবিধ ভারতী বেজেই যাবে ওই ৯ মাস – নেক্সট, বাচ্চা কামস ইনটু দ্য সিন্ উইথ এ থিম সং ফ্রম দ্য মাদার ডেডিকেটেড টু দ্য বাচ্চা – “তোমার হলো শুরু, আমার হলো সাড়া ” – প্রথম রাত থেকে শুরু হবে তার রাত জাগা, এরপর সেরেল্যাক-পেডিয়াসিওর-ইন্ফ্যামিল – এর আকাশ ছোঁয়া দাম, উপরন্ত তার ৭০% হবে নষ্ট কারণ কেউ জানে না বাচ্চা কত টা খাবে, এখানেই শেষ নয় – এরপরে আছে এডুকেশন এক্সপেন্স – প্লে-স্কুলের খরচ আজকাল মাস এ হরেদরে প্রায় ৫০০০-১০০০০ টাকা পড়ে , হাই-স্কুল, কলেজ আর হায়ার স্টাডিস তো ছেড়েই দিলাম……..এবং এই এতো কিছু বেয়ার করার পরে ছেলে মেয়ে বড় হয়ে বলবে “কি করেছো বাবা মা হয়ে আমার জন্য !!” – ইন এ সিম্পল নাটশেল, হ্যাভিং এ বেবি ইস লাইক ইনভেস্টিং ইওর হার্ড-আর্নড মানি ইন এ ড্রাউনিং স্টক মার্কেট উইথ নো রিটার্ন।

এবারে আসি পায়েলের কথায় – পায়েল এর যুক্তি ছিল – “তুমি তো অফিসে বেরিয়ে যাও, সারাদিন রান্নাঘরে তোমার মায়ের আসিস্ট্যান্ট হয়ে কেন দিন কাটাবো আমি? তার চেয়ে একটা বাচ্চা হোক ,সেই “সংসার” ই যখন করবো তো ভালোভাবেই করি ” – এর সাথে অনুঘটক হিসেবে যোগ হয় রক্তিমের এক অফিস কলিগের বৌয়ের কন্সিভ করা – “জানো আজ অর্পিতা র বাচ্চার এনোমালি স্ক্যান হলো, জানো আজ অর্পিতার বাচ্চা ফার্স্ট লাথি মেরেছে ” -ইত্যাদি প্রভৃতি , রক্তিম তখন সেলস টিমের সাথে মিটিং এ – এহেন কথাবার্তার কি উত্তর দেবে জানতো না – কাজেই ইগনোর করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না ওর – দিনের পর দিন এই ইমোশনাল অত্যাচার চলতে লাগলো , সাথে রক্তিম এর শাশুড়ির “অনেক তো ঘুরলে, এবার একটা কোলে আসুক”, রক্তিম এর বাবার “হ্যাঁ মানে দেখ এটা একান্ত ই তোদের ব্যক্তিগত ব্যাপার তাও বলছি, পায়েল এর দিকটাও ভেবে দেখ কিন্তু “, এরপর একদিন বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে রক্তিম নিমরাজি হলো – যথা সময়ে বুবান এলো পায়েল এর কোলে।

২৭অগাস্ট, ২০৩০:

রক্তিম আর পায়েল এর ডিভোর্সের ১২ বছর হয়ে গেছে – এই ১২ বছরে প্রথম দিকে রক্তিম তাও এক-আধ বার খোঁজ নিতো বুবান এর, ক্রমশ আলাদা থাকতে থাকতে ইমোশন গুলো ডিএসএলআর ক্যামেরার মতো ফেড-আউট হয়ে যেতে লাগলো – না রক্তিম আরেকটা বিয়ে বা লিভ-ইন কোনোটাই করেনি – কোয়েম্বাটুরে একটা ওয়ান বিএইচকে তে একাই থাকে, রান্নার লোক আছে – কলকাতা ফেরার মতো মানসিক অবস্থা বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই আর ওর – তবে পায়েল এর কাছে এখনো রক্তিম কৃতজ্ঞ , ডিভোর্সের দাবিটা রক্তিম এর দিক থেকেই ছিল তা সত্ত্বেও পায়েল মিউচুয়াল ডিভোর্স করেছে এবং ওর থেকে খোরপোশ এর জন্য একটা পয়সা ও নেয়নি – চোয়াল শক্ত করে বলেছিলো – “বুবান আমার জন্য এসেছে তো পৃথিবীতে, ওকে আমি এক যেভাবে পারি মানুষ করবো, কারোর সাহায্য-দয়া চাইনা আমার ” – সেই শেষ দেখা বুবান আর পায়েল কে, মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয় রক্তিমের – এই পায়েলকেই ও ভালোবেসেছিল ? যে মেয়ে টা অষ্টমীতে বাবার রক্তচোখ উপেক্ষা করে ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলো বাড়ির সবাইকে ছেড়ে , ৫ মিনিটের দেখার জন্য ঢাকুরিয়া স্টেশন এ দাঁড়িয়ে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা, নিজের পকেট মানি বাঁচিয়ে ওর জন্য সিগারেট কেনার পয়সা জমিয়ে রাখতো, বলতো, “তোমার আঙুলে ওই নিকোটিনের গন্ধটা আমি হাতে পেতাম তুমি চলে যাওয়ার পরেও” – এই প্লেটোনিক ভালোবাসা এভাবে হঠাৎ করে বাচ্চা-সর্বস্ব হয়ে উঠবে, রক্তিম দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি কখনো। শেষ এর দিকে তো মানে রীতিমতো মারামারি লেগে যেত দুজনের আর বুবান পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো।

বুবানের কথা:

আমি গাড়ি চড়তে খুব ভালোবাসি, ছোটবেলায় বাবার গাড়িতে উঠলে আর নামতে চাইতাম না, গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ালে মাকে মারতাম যেন মায়ের জন্যই গাড়িটা চলছে না – আসলে গাড়িটা চললে আশেপাশের সব কিছু মুভিং লাগতো আমার, গাছ বাড়ি গাড়ি দোকান সাইকেল লোকজন সবাই পেছনে সরে সরে যাচ্ছে – আর দাঁড়িয়ে থাকলে খুব অস্বস্তি হতো। পড়ে বাবা একটা স্কুটিও কিনেছিলো, ওটার সামনে দাঁড়িয়ে খুব ঘুরতাম – ঠান্ডা হাওয়া লাগতো যখন গায়ে খুব ভালো লাগতো আর আমি আনন্দে হাসি থামাতে পারতাম না – প্রথম প্রথম মা বাবার এগুলো ভালো লাগলেও পরে ওরা বুঝতে পারে যে আমি আর ৫ টা বাচ্চা দের মতো নই – বিদ্যুৎ চমকানো, ঝড়বৃষ্টি, টেবিল থেকে কোনো কৌটো বা জলের বোতল মেঝে তে পড়ার শব্দ একদম সহ্য করতে পারিনা – দুই কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলি। কোনোকিছুর বিশেষত খসখসে কোনো জিনিস এর ছোঁয়া আমার গায়ে ফোস্কার মতো লাগে – আমার এই আচরণ টা ডাক্তার কে বলেছিলো মা , উনি বলেছিলেন এটা নাকি “সেন্সরি ইস্যু” – এবং আরো বলেছিলেন যে আমাকে তিনটে থেরাপি করানোর জন্য – বিহেভেরিয়াল, অকুপেশনাল আর স্পিচ থেরাপি – মা নিয়ে যেত হসপিটালে আমাকে, সেখানে ডাক্তার রা অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস করাতো আমাকে দিয়ে – কিছু বুঝতে পারতাম না, অসহ্য কষ্ট হতো একটা, রেগে গিয়ে ওদের মারতেও যেতাম। বিকেলে মা বাড়ির কাছে একটা পার্কে নিয়ে যেত, ডাক্তার বলেছিলো “ওকে সোস্যালাইস করাতে হবে ” – সেখানে গিয়ে আমি নিজের মতো স্লিপে চড়তাম, দোলনায় উঠতাম কিন্তু তার চেয়েও বেশি পছন্দের ছিল আমার পার্ক এর ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে এদিক ওদিক ছড়ানো আর ওদের সাথেই আমার মতো করে কথা বলা, কারণ তখনো আমি অন্যদের মতো কথা বলতে পারতাম না।
অন্য আমার বয়সী বা আমার চেয়ে ছোট বাচ্চাদের সাথে আমার একদম খেলতে বা ইন্ট্যারাক্ট করতে ইচ্ছে করতো না – আর ডাক্তার বাবা মা আরো সবাই সব সময় চেষ্টা করে যেত যাতে আমি ওটাই করি – ওটাই তো “নর্মাল”, আর আমি তো ………..

মুখ দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করতাম ছোটবেলায় ,সাথে থুতু ছেটাতাম – সবাই বিশেষ করে বাবা ভীষণ বিরক্ত হত তার জন্য – অনেকবার খুব খারাপ করে বকেছে আমাকে বাবা, মেরেওছে, এরকম চলতে চলতে একদিন হঠাৎ দেখলাম বাবা আর থাকে না আমাদের সাথে , মানে মা আর আমার সাথে – কী করে বোঝাতাম ওদের যে আমি সব সময় প্রচন্ড একটা শব্দের মধ্যে, একটা আওয়াজের মধ্যে থাকি – ওই আওয়াজগুলোকে থেকে বাঁচতে আমি মুখে ওরকম আওয়াজ করতাম যাতে ওই শব্দগুলো আমার কানে না আসে। কাউকে তো বোঝাতে পারতাম না আমার কষ্ট টা, তাই ভাবতাম আমি মুখে আওয়াজ করলে হয়তো একটু শান্তি পাবো। ঘরের মধ্যে নিজেই নিজেকে কেন্দ্র করে গোল গোল ঘুরতাম, অনেকবার পড়ে গেছি, লেগেছে, তাও সেই লাগার ব্যাথাটা যেন আমার শান্ত ভাবে বসে থাকার চেয়ে কম কষ্টের মনে হতো।
এই পৃথিবী আর তার মানুষ দের আমার খুব অদ্ভুত লাগতো, এখনো লাগে, মনে হয় আমি ঠিক এদের মতো নই অথবা এরা আমার মতো নয় – আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম আর মা ক্রমশঃ আরো গুটিয়ে যেতে লাগলো ওই ছোট চার দেয়ালের মধ্যে, দিদার বাড়িতে গিয়ে থাকতাম তখন আমরা, ডাক্তার আসতো মাকে দেখতে – আর প্রত্যেকবার চলে যাওয়ার পরে দিদা একা একা বসে কাঁদতো। এভাবে কয়েক বছর কাটলো , বাবা মনে হয় মাঝে মাঝে ফোন করতো দিদাকে আর দিদা খুব রাগ করে ফোন কেটে দিতো।

আর আমি ঘরের এক কোন বসে ছবি এঁকে যেতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, বিভিন্ন রকম ছবি – যখন যেরকম মনে আসতো, কিন্তু আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেগুলো কোনোভাবেই আমাকে কখনো বিচলিত করতো না – কিছু দেখতে বা বুঝতে পারতাম না আমি যতক্ষণ একটা আঁকা শেষ না হতো , নিজের মনে নিজে কথা বলতাম আর রং তুলি পেন্সিল চালিয়ে যেতাম – মনে হতো আমার ভেতরে যেন আরো কেউ একজন থাকে যে সবসময় আমার পাশে আছে, আমায় চলতে, বুঝতে , আঁকতে সাহায্য করছে – কখনো তার উপস্থিতি আমার খুব অসহ্য হয়ে উঠতো আবার কখনো মনে হতো সে না থাকলে আমি হয়তো আর বাঁচতেই পারতাম না।

২০ মার্চ ২০৩৫, হায়দ্রাবাদ:

সেলস এর কাজে কোয়েম্বাটুর থেকে হায়দ্রাবাদে শিফ্ট করেছে রক্তিম আর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে, সামর্থ্য মতো সব রকম চিকিৎসাকে হারিয়ে দিয়ে পায়েল চলে গেছে আজ এক বছর হলো, ব্রেন-স্ট্রোক হয়ে প্রায় গোটা শরীর টাই অচল হয়ে গেছিলো। রক্তিম পায়েলের একটা ছবি নিজের কাছে বাঁধিয়ে রেখেছে – হাতদুটো পিছমোড়া করে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে ছিল রক্তিম সেই ছবিটার দিকে – কি অদ্ভুত মায়া পায়েলের চোখ দুটোয় , কেমন যেন একটা আর্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে – খুব খুব অপরাধী লাগলো আজ নিজেকে – সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হতে লাগলো, একটু ধৈর্য, একটু মানিয়ে নেওয়া, একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট এগুলোই তো একটা সংসারকে বেঁধে রাখে – শুধু বুবানের আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আচরণ না হওয়া , পায়েল এর সেটা নিয়ে একটা প্যারানয়েড এর মতো জীবনযাপন আর রক্তিম কে সময় দিতে না পারা – এটাই কি যথেষ্ট কারণ ছিল ওর নিজের বৌ আর একটা অসহায় বাচ্চা কে ছেড়ে চলে আসার জন্য ? চশমা টা খুলে চোখটা মুছলো রক্তিম, তখনি কলিং বেল টা বেজে উঠলো – নিজেকে একটু সামলে দরজা খুলতেই দেখে “নিউজ পেপার” ওয়ালা – হায়দ্রাবাদ হলেও এই লোক টা হিন্দি বলতে পারে – “কেয়া সাব কবসে বেল বাজে রাহা হুঁ “, রক্তিম দেঁতো হেসে “নেহি থোৱা আঁখ লাগ্ গায়া থা ” বলে কাগজ টা নিয়ে ভেতরে গেলো – আজ ছুটি ছিল ওর, রান্নাঘরে মাইক্রোওভেনে এক কাপ গরম জল দিয়ে এক মিনিট টাইমার দিয়ে কাগজ টা খুলতেই ভেতর থেকে পড়লো একটা ছোট লিফলেট – “মডার্ন আর্ট এক্সিবিশন বাই ঈশান গাঙ্গুলী।”

পিঠ দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোতের মতো ধারা নেমে এলো উত্তেজনায় রক্তিমের – ঈশান বুবান এর ভালো নাম, তাহলে কি বুবান এর ই এক্সিবিশন ? কিন্তু সেটা কী করে হবে? বুবান তো নর্মাল ছিল না, ওর কি করে ছবির এক্সিবিশন হতে পারে ? আগের ফোন টায় পায়েল এর মায়ের নাম্বার টা ছিল, কিন্তু এই ফোনে তো নেই, কোনোভাবে একবার যদি ফোন করা যেত পায়েলের মা কে। আচ্ছা, জায়গা ডেট কিছুই তো দেখা হলো না – সত্যি যদি এটা বুবান ই হয় ? কি করবে বুঝতে পারছে না রক্তিম, হঠাৎ সম্বিত ফিরলো মাইক্রোওভেনের সেই এক মিনিট হয়ে যাওয়ার আওয়াজে – লিফলেট টা হাতে নিয়েই কফি টা বানাতে বানাতে ভালো করে ডিটেলস টা দেখলো – “কে-আই -আই -টি অডিটোরিয়াম, ওড়িশা ২৫শে মার্চ – সন্ধ্যে ৬ টা”।

খুব খারাপ হলে কী হবে? এটা অন্য কোনো ঈশান গাঙ্গুলী – সে হোক, হতেও তো পারে এটা বুবান , আচ্ছা বুবান ছবি আঁকতে শিখলো কবে ? ও তো কোনো কথা বুঝতে পারতো না, কতবার চেষ্টা করেছে রক্তিম ওকে দিয়ে এ,বি, সি, ডি লেখানোর – পেন্সিল ধরতেই পারতো না।

মনে মনে একটা বিশ্বাস তৈরী হলো রক্তিমের, হাজার হোক বাপের মন বলে কথা – ঠিক করলো যে ও যাবে ওই অডিটোরিয়ামে, মেকমাইট্রিপ খুলে কেটে ফেললো ফ্লাইটের যাওয়া আসার টিকিট – মনটা আস্তে আস্তে একটু ভালো হলো, এবার অপেক্ষা শুধু রবিবার সন্ধ্যে ৬টা বাজার

২৫শে মার্চ ২০৩৫:

দুপুর ২ টো ২০ র ফ্লাইট ধরে ভুবনেশ্বর এয়ারপোর্ট পৌছালো রক্তিম সাড়ে ৪ টে নাগাদ, কোনও লাগেজ না থাকায় সোজা বাইরে এসে একটা ওলা নিয়ে নিলো , গুগল ম্যাপে দেখালো ৪০ মিনিট সময় লাগবে। বুবানের ডেলিভারির দিনটার কথা মনে পড়ছিলো ভীষণভাবে, ঠিক এই রকমই অফিসের বোর্ড মিটিং থেকে বেরিয়ে এসে ওলায় করে বাড়ি এসেছিলো রক্তিম, মা ফোন করে বলেছিলো শিগগিরই আয় পায়েলের “ওয়াটার ব্রেক” হয়েছে – এসে তাড়াতাড়ি নিজের গাড়ি তে তুলে যত টা সম্ভব জোরে চালিয়ে পৌঁছেছিল হসপিটালে, রাত ১০:৩০ টায় ওদের জীবনে এসেছিলো বুবান – তারপর রক্তিম নিজেও ভুলে গেছিলো ওর বাচ্চা নিয়ে সেই এলার্জির কথা, অফিস এর সময়টুকু বাদ দিয়ে পুরো সময়টাই থাকতো বুবানের সাথে – সব খুব সুন্দর চলছিল , হঠাৎ যে কি থেকে কি হয়ে গেলো। …….
“ইউনিভার্সিটি আ গায়া স্যার” – রক্তিম দেখলো ড্রাইভার মোবাইল থেকে ট্রিপ শেষ করছে – ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে দেখলো একটা মাঝারি সাইজের ফেস্টুন টাঙানো যাতে সেই খবরের কাগজে র সেম প্রিন্টে লেখা “ঈশান গাঙ্গুলীস মডার্ন আর্ট” – আশ্চর্য!! এখানেও একটা ছবি দেওয়া নেই – আরে যার এক্সিবিশন, তার একটা ছবি তো থাকে !! যাই হোক এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রক্তিম ঢুকলো গেট দিয়ে – কলেজ মনে হয় সেমিস্টারের ছুটি চলছে সে কারণেই অডিটোরিয়াম টা ফাঁকা পেয়েছে এই ঈশান গাঙ্গুলী। মিনিট পাঁচেক হেঁটেই অডিটোরিয়ামে ঢুকে গেলো রক্তিম – সেরকম খুব একটা ভিড় নেই, আসলে এই নেটফ্লিক্স আর মাল্টিপ্লেক্সের যুগে কজন ই বা আর্ট এক্সিবিশনে আসে – মোটামুটি মাঝারি সাইজের একটা ঘর , একটা সাইড এ গ্যালারি করা কিন্তু সব পেন্টিং গুলো ফ্লোরেই স্ট্যান্ডে রাখা, সাদা কাপড় দিয়ে কভার করে – ঘড়িতে দেখলো বিকেল সাড়ে ৫ টাও বাজেনি – মানে এখনো আধ ঘন্টা দেরি , বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল রক্তিম, দু টান দিতে না দিতেই একটা লাল রঙের ফিগো এসে দাঁড়ালো মেইন গেটের সামনে, গাড়ি থেকে নামলো যে ছেলেটি , দেখেই বোঝা যায় ২১ কি ২২ বছর বয়স, খুব উস্কো-খুস্কো চেহারা , একগাল দাড়ি, একটা জিন্স আর একটা কালো শার্ট, হাতে একটা ইসেল স্ট্যান্ড।

গাড়িটার পেছনের অন্য দিক থেকে নামলো একটা মেয়ে, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুহাতে শক্ত করে ধরলো ছেলেটার কাঁধদুটো – “চিয়ার আপ বুবান, আমি তোর এই এক্সিবিশন টার জন্য কলকাতা থেকে ছুটে এসেছি , কত লোক এসেছে তোর আঁকা , তোর ক্রিয়েটিভিটি দেখতে আর তুই এরকম ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছিস কেন? কিছু হবে না বুবান , আমি আছি না – দে ইসেল টা আমাকে দে , তুই একদম ফ্রি থাক – একটা বড় করে নিশ্বাস নে – সব খুব ভালো হবে।”

রক্তিম আর দাঁড়ায়নি ওখানে, তাড়াতাড়ি করে ভেতরে চলে গেলো , এই ১০ মিনিটে বেশ অনেক লোক হয়ে গেছে ভেতরে , অনেকে দরজার সামনে ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছে , অনেকে কিছু ছবি যেগুলোর কভার ততক্ষনে সরানো হয়েছে সেগুলো দেখছে – কি অসাধারণ এক একটা কাজ, ষ্টীল-লাইফ, ল্যান্ডস্কেপ, পোর্ট্রেট ; এক একটা ছবি যেন এক একটা গল্প কে তুলে ধরেছে সবার চোখের সামনে।

ইতিমধ্যে অনেক হাততালির মধ্যে দিয়ে হলে ঢুকলো বুবান, মানে ঈশান গাঙ্গুলী – কানে দু হাত চাপা, এতো হাততালির আওয়াজে কষ্ট হয় যে বুবানের – রক্তিম দেখলো মাথা নিচু করে ভীত চোখে একটা কোনা, একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছে ছেলেটা – এক ঝটকায় মনে পড়ে গেলো ১৭ বছর আগের সেই ঘরের দৃশ্যটা – রক্তিম প্রচন্ড চিৎকার করছিলো বুবানের ওপরে আর ভয়ে বুবান দু-হাত দিয়ে কান চেপে একটা কোনে দাঁড়িয়ে পায়েল কে খুঁজছিলো – হয়তো আজো খোঁজে।

“লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন – মে আই হ্যাভ ইওর এটেনশন প্লিস ” – সেই গাড়ি থেকে নামা মেয়েটা, সামনে একটা উঁচু স্টেজ টাইপের জায়গায় উঠে দাঁড়িয়েছে – “থ্যাংক ইউ অল ফর জয়েনিং আস দিস ইভিনিং – হোপ ইউ অল এঞ্জয়েড দ্য ওয়ার্ক অফ ঈশান – ঈশান, উড ইউ লাইক টু সে সামথিং ?” – খুব আস্তে আস্তে ইতস্তত একটা ভাব নিয়ে ঈশান হাতে মাইক টা নিলো – রক্তিমের দু চোখ জলে ভোরে উঠেছে তখন –
“হ্যা-হ্যলো , থ্যাংক ইউ, অল ফর কামিং ডাউন হিয়ার, আই আমি নট এ গুড স্পিকার, সো উইদাউট ওয়েস্টিং মাচ টাইম, আই উড লাইক টু কল মাই মাদার – ক্যান আই হ্যাভ দ্য লাইটস অফ ফর এ মোমেন্ট ?” – কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব লাইট নিভে গেলো – ওই উঁচু জায়গাটায় ঈশান আর ঈশান এর পাশে একটা বিরাট ক্যানভাসে পায়েলের একটা প্রাণখোলা হাসির ছবি – একটা ছোট ঠান্ডা সাদা আলো পড়ল ছবি তার ওপরে, স্পষ্ট যেন পায়েল সত্যি হাসছে – ঈশান হাঁটু মুড়ে ছবি টার পায়ের কাছে বসলো, তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো – “দেখো মা, আমি ভালো হয়ে গেছি , আমি ভালো আছি মা, তুমিও ভালো থেকো , আমায় নিয়ে আর চিন্তা করো না মা”
আমি রক্তিমের খুব কাছের বন্ধু – এই পুরো ঘটনা টা রক্তিম ই আমাকে বলেছিলো বছর খানেক আগে – তারপর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ওর সাথে – সেই এক্সিবিশনের দিন রক্তিম দেখাও করতে গেছিলো বুবানের সাথে – নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলো “বুবান আমি তোর বাবা , চিনতে পারছিস না আমায় ? ” বুবান ওই মেয়েটাকে ডেকে বলেছিলো “ওনাকে বলে দে, আমার মা সিঙ্গেল মাদার ছিলেন, আমার কোনো বাবা নেই।”

||

ষাটের দশকে যক্ষা, কলেরা এসব মহামারীর নাম শোনা যেত – এখন আর কেউ জানেই না এসব রোগের নাম – ঠিক তেমন ভাবেই এই অটিসম, এডি-এইচডি, ডিস্লেক্সিয়া, এগুলোও দেখবেন একদিন থাকবে না – কিন্তু তার জন্য আমাদের শিক্ষাটা সঠিক হওয়া দরকার, বুবানের মতো বাচ্চা আজ অনেক ঘরে ই জন্মাচ্ছে – সেই বাচ্চা একটু অন্যরকম হলেই তার মাকে “প্রেগনেন্সি তে ঠিক করে ওষুধ খাওনি? পড়ে-ফড়ে গেছিলে নাকি?” অথবা তার বাবাকে “মদ সিগারেট খেলে বাচ্চা এরকম হবেই ” – এই ধরণের স্ব-ঘোষিত মেডিক্যাল সার্টিফিকেট গুলো দেয়া বন্ধ করুন,
আপনি আমি মনে করি যে বাচ্চারা কিছুই বোঝে না – ওরা সব বোঝে , বরং আমার আপনার থেকে বেশি বোঝে, বাচ্চার সামনে অসভ্যের মতো ঝগড়া, গালিগালাজ করা এগুলো বন্ধ করুন – এই লেখা টার পরেও আরো কিছু রক্তিম-পায়েল তৈরী হলে সত্যি আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগবে।

“এভরি চাইল্ড ইস স্পেশাল” – ওদেরও সমান অধিকার আছে আমার আপনার মতো করে বাঁচার – বুবানের সেই থেরাপির ক্লাসের একটা বই দেখিয়েছিলো রক্তিম, লেখা ছিল ” টুগেদার , উই ক্যান ” – একটা প্রতিজ্ঞা হোক আমাদের নিজেদের কাছে – “ইয়েস উই ক্যান” !!

~~~♥~~~

লেখক ~ ছন্দক চক্রবর্তী