স্বপ্নের দোসর

Anirban & Arijit, Love Story, Short Story, Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

এই রাস্তাতে আগেও অনেক বার এসেছেন সঞ্জয়। কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে থেকে বোম্বে রোডে ওঠার মুখেই হেয়ারপিন টার্নটা। অভ্যাস বলে দিয়েছিল এখানে সেকেন্ড গিয়ারে নেমে আসতে, সাবধানী পা ছিল ব্রেকের কাছেও। কিন্ত উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা ম্যাটাডোরটার আজকে অন্য প্ল্যান ছিল বোধহয়, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেটা সজোরে ধাক্কা মারল সঞ্জয়ের ইওনের বনেটে। হাল্কা গাড়িটা টাল সামলাতে না পেরে পেছনের চাকার ওপরে ঘুরে গেল প্রায় একশো আশি ডিগ্রি, আর আছড়ে পড়ল রাস্তার ধারের ঢালু জমিতে।এয়ারব্যাগটা ছিটকে বুকে এসে পড়ার সময় ছিন্ন মুহুর্তের জন্য ওর মনে হল তবে কি কাল রাতে স্বপ্নটা…

একজন মানুষ তার গোটা জীবনে ছ’বছর স্বপ্ন দেখেই কাটিয়ে দেয়। তার অনেকটাই তার মনেও থাকে না, স্বপ্নটা মস্তিস্কের কোন অংশে তৈরি হয় তা আজ অবধি কারোর বোধগম্য হয়নি, কেউ ঠিক জানেও না স্বপ্ন মানুষ ঠিক কেন দেখে, অনেকে বলে অন্য মনের ইচ্ছাগুলো থাকে তাতে, বা ভয়, অনেক সময় কামও।

সঞ্জয়ও স্বপ্ন দেখেন আর পাঁচটা লোকের মতোই, কিন্তু সেই দেখার মধ্যে একটু ফারাক আছে। সঞ্জয়ের একটা ডায়রি আছে। রোজনামচা আর কি, কিন্তু সারাদিনে কী করলাম, কী খেলাম তা কিন্তু লেখা থাকে না এতে। সঞ্জয় লেখেন আগের রাতের স্বপ্ন গুলো।

কিভাবে সঞ্জয়ের এই বিদঘুটে হবিটা তৈরি হল সেটাও একটা গল্প বটে।বরাবরের ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটার যখন কলেজ পেরিয়ে চাকরী করতে করতেও কোন বঙ্গললনাকে পছন্দ হল না তখন বাড়িতে রাজু ঘটককে ডাকা হল। মাঝে মধ্যেই অফিস থেকে ফিরে তখন মায়ের সাথে বসতে হত শংখিনী, হস্তিনি,পদ্মিনী দের ছবি দেখতে। কিন্তু নাহ, পছন্দ হচ্ছে না কাউকে, সবাই বাতিলের দলেই ভীড় করছিল।

রোজ না হলেও মাঝে মধ্যে আগের রাতের স্বপ্নটা মনে থেকেই যায়। সেরকমই এক রাতে সঞ্জয় দেখেছিল বিনিকে, বিনতা চৌধুরী। পরের দিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে মায়ের হাতে দেখেছিল বিনির সাদা-কালো ছবি। সেই নাক, সেই চশমার ফ্রেম, এত মিল হয় কি করে! মা মাসি পিসি রা প্রায়ই বলেন ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, তার কি কোন ব্যাখ্যা আছে? না একদম নেই। সঞ্জয়ও এই কাকতালীয় ব্যাপারটার মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে পারেনি, কিন্তু ব্যাপারটাকে মাথা থেকে সরিয়েও দিতে পারেনি। বিনিকে যে ও ঠিক দেখেছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। মায়ের হাতে ছবিটা দেখেই ওর মন বলেছিল এই মেয়েকেই তার চাই সহবাসে, সহ বাসে। ঘটনা টা বলেছিল দুজনকে। সব শুনে অফিসের শেখরদা বলেছিল

“হুঁ হুঁ বাবা, স্বপ্নে দেখা রাজকন্যে, তুমি তো দেখছি উত্তমের পো, লাঞ্চটাইমে ঠান্ডা শিঙাড়া খেলে এই দেখবে।”

আর পাড়ার রকের বিল্টুদা তো হাসি চেপে রাখতে পারেনি,
“বলিস কিরে! হবু বউকে আগেই দেখে ফেললি! ইস আমিও যদি পারতাম রে, তাহলে তোর বৌদিকে আর বিয়েই করতাম না।”

দুবারই তার অলীক স্বপ্নযোগ বিচ্ছিরি ভাবে ক্রিটিসাইজড হওয়ার পরে আর কাউকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি সঞ্জয় সেন, তবে পাড়ার লাইব্রেরী থেকে খুজে পেতে ফ্রয়েডের ইন্টারপ্রিটাশন অফ ড্রিম এর একটা বাংলা অনুবাদ জোগাড় করেছিল। কিন্তু যখন মাথা চুলকে এ মলাট থেকে ও মলাট ঘোরাফেরা করেও স্বপ্ন সত্যি হওয়া নিয়ে কিছু পাওয়া গেল না, তখনি ডায়রিটা শুরু করার সিদ্ধান্তটা নেয় ও, যদিও এর অস্তিত্বর ব্যাপারে কখনো কেউ জানতে পারে নি, এমনকি বিনিও না।

||

স্বপ্নে সঞ্জয় একা থাকে, তাই স্বপ্নগুলো নির্লজ্জ, নগ্ন হয়। যখন লিখতে শুরু করেছিল তখনও নিজেও ভাবতে পারেনি ওর মনের অন্ধকার কোণগুলোতে এত কিছু লুকনো আছে। কি নেই ডায়েরির পাতাগুলো তে; পুরনো বাড়ির গলি, মায়ের হাতের রান্না, অন্ধকার রাস্তায় হটাৎ কুকুরের তাড়া খাওয়া, আরো আরো অনেককিছু। কখনো ভুতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিছানার সাথে মিশে গেছে, কখনো নিজেকে ভোটে দাঁড়াতে দেখে হাসতে হাসতে সকালে বাথরুমে ঢুকেছে। বিনির অবাক চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে সেই কথা বলেওছে, তারপর দুজনেই একসাথে হেসেছে।

কিন্তু সব স্বপ্ন তো বিনিকেও বলা যায় না, এই যেমন একদিন ও মিতুলকে খুন করল, ছেলেবেলায় স্কুলে ওকে খুব পেটাতো ছেলেটা।

কিন্তু যত অদ্ভুত, যত অবাস্তব স্বপ্নই হোক না কেন, সঞ্জয় সেগুলো লেখার সময় কখনও কোন অসততার আশ্রয় নেয় নি। নারীরাও ওর স্বপ্নে এসেছে বহুবার, তাদের উপত্যকাময় শরীর নিয়ে, অনেক সময় সেটা সঙ্গমের ঘামে শেষ হয়েছে। কিন্তু এই কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবনে বিনি এসেছে মাত্র দুবার, আর সঞ্জয়কে চমকে দিয়ে সেই দুটো স্বপ্নই সত্যি হয়েছে!

যেদিন বিনির এস এস সি র ফল বের হল সেদিন সারারাত বিনি না ঘুমলেও সঞ্জয় দেখেছিল র‍্যাঙ্কটা , আর পরের দিন বোর্ডে সেটাই দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। তারও বছর পাঁচেক পরে বিনি যখন সিজারের জন্য থিয়েটারে ঢুকছে তখন সঞ্জয় হাসপাতালেরর বাথরুমে হাউহাউ করে কাঁদছিল। অপারেশনের পরে ডাক্তারের সাথে কথা বলার সময় ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়েছিল। সঞ্জয় যে জানত বাচ্ছাটা বাঁচবে না! অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য বিনির জরায়ুটাও বাদ দিতে হবে। কিন্তু না, বাদ বাকি পনেরো বছরে বিনি আর আসেনি ওর স্বপ্নে।

গতকাল রাতে আবার ও বিনিকে দেখেছিল, তৃতীয় বারের জন্য।

বিনির বোনপো রিজুর বিয়ে বর্ধমানে, কলেজে পড়ার তিনটে বছর ছেলেটা সঞ্জয়দের বাড়িতেই ছিল,সেই বিয়েতে তো যেতেই হবে। কিন্তু বেরোবার আগের দিন রাতেই স্বপ্নটা এল।
হেয়ারপিন টার্ন, সামনে থেকে আসা গাড়ী,অ্যাক্সিডেন্ট আর……

“মাথায় চোট একটা আছে বুঝলেন, তবে বিশাল কিছু না, জাস্ট অবজারভেশনে রাখা ছাড়া আপাতত আর কোন কিছু করতে হবে না”,
ওয়ার্ডের এর বাইরে ডাক্তার মিত্র যখন কথা গুলো বলছিলেন তখন সঞ্জয়ের মনে হচ্ছিল নিজের গালে একটা চড় মারতে। সকালে উঠেই অনেক চেষ্টা করেছিল বিনিকে নিরস্ত করতে। বাসে ট্রেনে গেলে অনেক ধকল, তাই ও গাড়িতেই যাবে, অবুঝের মতো গোঁ ধরে বসেছিল। বাধ্য হয়ে স্বপ্নটার কথা বলাতে এক গাল হেসে বলেছিল তুমি আমাকে ভালবাসো তো তাই এমন স্বপ্ন দেখলে, এ আবার সত্যি হয় না কি? সঞ্জয়ের বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে বলে উঠতে চেয়েছিল হয় বিনি হয়, কিন্তু বিনিকে বিশ্বাস করাবে কি ভাবে! বিনির বন্ধ্যাত্বের আগাম খবর যে তার কাছে ছিল এটা সাহস করে বলে উঠতে পারেনি সেদিন।

||

নিজের খুব একটা বেশি চোট লাগেনি। এয়ারব্যাগের জন্য বুকে বেশ ব্যথা। ফিফথ রিবে নাকি চিড় ধরেছে, ভারী কিছু না তুললে নিজে থেকেই সারবে। বিনিকে একা ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না সঞ্জয়ের, কিন্তু ডাক্তারের কথায় একটু আশ্বস্ত হল। রাতের দিকে ফিরে এল বাড়িতে।

সেই রাতেই বিনি আবার এল স্বপ্নে, পরদিন সকালে সঞ্জয় বুকে একরাশ চিন্তা নিয়ে হাসপাতালে গেল,জানত বিনিকে আই টি ইউ তে দিতে হবে। রাত কাটাবার জন্য হাসপাতালের ডর্মেই একটা ব্যবস্থা করে নিল।

বিনির আসা আর থামছেই না এখন, যেন পনেরো বছরের শুন্য স্থানটা কয়েক রাতেই ভরিয়ে ফেলবে। মাঝ রাতে স্বপ্নটা ঘুম ভাঙিয়ে দিতেই ও ছুটে ছিল আই টি ইউ এর দিকে, কিন্তু অনেক করে বোঝাবার পরেও আর.এম.ও কিছু শুনলেন না। সকালে বিনি কোমাতে চলে গেল, সি টি স্ক্যানে এক দলা রক্ত নাকি চেপে বসেছে ওর মাথার মধ্যে।

সেদিন প্রায় সারারাত সঞ্জয় জেগে বসেছিল, কিন্তু ভোরের দিকে শরীরটা আর দিল না, আর তখনি মাথায় একটা ফুটো নিয়ে বিনি হাজির হয়ে গেল আবার।

সকালে বিনির বার হোল অপারেশান হল, যতটা সম্ভব রক্ত বার করা গেছে, কিন্তু এরপরে কি হবে কেউ বলতে পারবে না।

সেই থেকে সঞ্জয় আর ঘুমতে যায় না , পিঠটা ডর্মের বিছানায় ঠেকাবার রিস্ক ও নেয় না, একটা বড় ফ্লাক্স কিনে কড়া করে কফি বানিয়ে নিয়েছে, সারা রাত ওটাই ভরসা এখন। এমন করে তিন রাত চলল, চোখ গুলো ঘোলাটে হয়ে আসছে, মাথাটা পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে, চতুর্থ দিনে কফির সাথে সিগারেটটাও এল। ৫২ বছরের জীবনে প্রথমবার। শরীর সায় দিচ্ছিল না, কিন্তু সঞ্জয় লড়াই থামায়নি, এমন করে খিদে লোপ পেল, জড়ভরতের মতো ডর্মের এক কোণে বসে থাকে সে, দিনে দুবার বিনিকে দেখতে যায়, একটু বেটার এখন ও, কালই ভেন্টিলেটর থেকে ছাড়া পাবে, আবার নিজের বলে শ্বাস নেবে।

||

আরো একবার রক্তক্ষরণ, এবারে অনেক বেশি। জমাটবাঁধা রক্ত ঘিলু টাকে একপাশে সরিয়ে দিয়েছে, কোন উপায় নেই এবারে আর। ঝট করে নড়ে উঠল সঞ্জয়! দু সেট জামা কাপড় নিয়ে এসেছিল ও, তাই দিয়েই পাঁচ দিন চলেছিল। আজকে শার্টটা বদলাবার জন্য বাড়ি আসছিল, বাসে বসে বসেই কখন চোখ দুটো লেগে গেছে। আর তখনই বিনি আবার উঁকি দিল! চলন্ত বাস থেকে নেমেই উল্টোদিকের ট্যাক্সিতে চেপে বসল ও, হাঁপাতে হাঁপাতে যখন হাসপাতালে ঢুকল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

বিনির মস্তিস্কের মৃত্যু হয়েছে, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সেদিন রাতটা আর হাসপাতালে কাটায় নি সঞ্জয়।

||

-কিগো? হল তোমার?
-এই তো হয়ে এসেছে, একটু ওয়েট কর, ফ্রিজের বাকি আমস্বত্বটা সাবাড় করে দিলাম বুঝলে।
-তোমার নোলা আর কোনদিন কমল না,আমি চললাম।
-হেঁ হেঁ ম্যাডাম, আমি আগে, তবেই না আপনি সুযোগ পাবেন।
-তোমার সাধের হাত ঘড়িটা নিলে না?
-ধুস, ওটা আর কোন কাজে আসবে না।

সেদিন রাতেই একগাদা ঘুমের অসুধ খেয়ে কেটে পড়ে সঞ্জয় সেন, ভোররাত নাগাদ বিনিরও পিউপিল গুলো স্থির হয়ে যায়।

ডায়রি লেখা কিন্তু কোন দিন বন্ধ হয়নি। যদিও দিন দুয়েক পরে পাড়ার ছেলেরা ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে যখন ওর শক্ত মৃতদেহটা পায় তখন মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কালো ছাইয়ের স্তুপের মানে কিছু উদ্ধার করতে পারেনি।

শেষ এন্ট্রিটা শুধু বাকি রয়ে গেল,
ওই স্বপ্নটা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে সঞ্জয়।

© অনির্বাণ ঘোষ