বাঁদরনাচ

Friends, Short Story, আদতে আনাড়ি, বাংলা

ডাউন মেচেদা-হাওড়া লোকাল প্লাটফর্মে এসে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে ভেণ্ডার কামরা থেকে তিন চারটে পোঁটলা পুঁটলি সহ আলুথালু চেহারার একটা লোক নামল। নামল না বলে ধাক্কা মেরে নামানো হ’ল বলাই ভালো। আরও দু’চারটে লোক গুটি গুটি করে প্রায় সবক’টা কামরা থেকেই নামল। ভর দুপুরে প্লাটফর্ম আর ট্রেন দুটোই প্রায় ফাঁকা। আপিসটাইমের দৌড় ঘন্টা তিন চারেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, ফের শুরু হবে আবার বিকেল পাঁচটা থেকে উল্টোদিকের ‘আপ’ গাড়িগুলো যাওয়ার প্লাটফর্মে।

হুড়মুড়িয়ে নামা লোকটা আস্তে আস্তে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের পোঁটলাগুলো সব রাখল সিমেন্টের লাল লম্বা বেঞ্চটায়। আকাশী আর সাদায় চেক-কাটা একটা লুঙ্গি আর লাল রঙের নামী কোম্পানির লোগো দেওয়া একটা রংচটা ববলিং ওঠা গেঞ্জি। গালে খিমচি কেটে ধরা যাবে এমন নুন-মরিচ দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল মাথায়। লোকটা বেঞ্চের ওপর বসতেই একটা বাদামী আর গোলাপী ফুলকাটা ছিটের কাপড়ের পোঁটলা লাফিয়ে লোকটার ঘাড়ে উঠে পড়ল। তাই দেখে, সামনের চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করতে থাকা বাচ্ছা ছেলেটার হাত থেকে জংধরা তালাটা ঠং করে কংক্রিটের প্লাটফর্মে পড়ে গেল। আরও এদিক ওদিকের লোকজন বিস্ময়ে চেয়ে রইল লোকটার দিকে।

এ রামোঃ! পুঁটলি কোথায়? এ তো একটা বাঁদর! ওই তো, আরেকটা বাদামীর ওপর হলুদ চকরাবকরা পুঁটলিও নড়ছে।
দুটো বাঁদর, মানে একটা বাঁদর আর আরেকটা বাঁদরী। অন্তত ওদের বেশভূষা তাই বলছে। একটার পরনে গোলাপী ফুল ফুল ফ্রক, গলায় সস্তা পুঁতির মালা। অন্যটার অঙ্গে বছর তিনেকের কোনও বাচ্ছার হলুদ রঙের পুরনো শার্ট, আর একহাতে একটা প্লাস্টিকের সবুজ খেলনা ঘড়ি। লোকটা তার মানে বাঁদরের খেলা দেখায়। বাঁদরগুলো বড় বাধ্য, চেন বা দড়ি কিছু দিয়েই আটকানো নেই তবুও ওদের মালিকের পাশ ছেড়ে নড়ছেনা। শুধু দুটোতেই লোকটার ঘাড়ে উঠে বসে জুল জুল করে চায়ের দোকানের সামনের নোংরা ঝুড়িতে পড়ে থাকা বাপুজী কেকের মোড়কগুলোকে দেখছে।

-“কা রে জাকি বিটিয়া? কা রে শরফ? ভুক লাগি কা? রুক যা বিটুয়া তনিক। তোহ্ কা হাম লাড্ডু খিলাইবে, নাহি নাহি! কেকওয়া খিলাইবে।” কোলে নামিয়ে নিয়ে পোষ্য দুটোকে আপন মনে বলতে থাকে লোকটা, গায়ের বাদামী লোমে বিলি কাটতে কাটতে। অনেকদিন আগে একটা সিনেমা দেখেছিল বিনি টিকিটে হলে ঢুকে। একটা ভারী প্রভুভক্ত কুকুরের গল্প, ‘তেরি মেহেরবানিয়া’। তারপর কী কান্না কেঁদেছিল ওর পোষা ছোট্ট চুন্নু আর মুন্নুকে জড়িয়ে। নায়কটাকে খুব মনে ধরেছিল, তাই ওদের নাম বদলে সেদিনই রেখেছিল ‘জাকি’ আর ‘শরফ’। খেলা দেখাতে গিয়ে কেউ মজা করলে বলে, “নাম মে কা হ্যায় বাবুজী? যো আচ্ছা লাগা উসি নাম সে পুকারিয়ে, হামার জাকি অউর শরফ বদলেঙ্গে থোড়ে হি!”

“হোয়াটস্ ইন আ নেম” শেক্সপীয়র সাহেব, “হোয়াটস ইন আ নেম”। তোমার বাক্যি এতটা গভীরে ক’জন বোঝে গো।

পাশের সিমেন্টের বেঞ্চে আরেকটি পরিপাটি পরিবার ততক্ষণে এসে বসেছে, পরের ট্রেনের অপেক্ষায়। বিরক্তমুখের গম্ভীর বাবা, সম্ভবত আগের ট্রেনটি টার্গেট করেও মিস করার কারণেই, বারবার ঘড়ি দেখছেন। মা’টি গরমেও ভারী একটা জমকালো শাড়ি পরে গলদঘর্ম, সেইসাথে উটকো সোনার আভরণের উৎপাত তো আছেই। বছর ছয়েকের মেয়েটা ভারী মিষ্টি, পুটুর পুটুর করে একবার চায়ের দোকানের কাপ ডিশ ধোয়ার বাচ্ছা ছেলেটাকে দেখছে, আবার কখনও ‘জাকি’ আর ‘শরফ’ কে দেখছে। ভারী গম্ভীর সেই বাবাটি খানিকটা দূরে প্লাটফর্মের নাম লেখা গোল মত লোহার প্লেটটার নিচে লাগানো টাইমটেবিলটার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।

এদিকে গুটি গুটি পায়ে চায়ের দোকানের ঝাঁপ ফেলে ছেলেটি এসে দাঁড়িয়েছে বাঁদরের মালিকের সামনে।
-“ইকটু বাঁদরলাচ দিখাবেনি চাচা?”
-“বাবুয়া ইকজনের জন্য খিলা দিখাব? লস হো যায়গা বেওসার”
-“আরে ফিরি-তে দেখবনি গো চাচা, এই কেক টা দিব তোমার বাঁদরগুলোকে।”

কী মনে করে হেসে ওঠে লোকটা, তারপর সামনে একটা প্লাস্টিক পাততে শুরু করে, বাঁদুর দুটোকে ওটায় নামিয়ে ঝোলা থেকে একটা ডুগডুগি বাজিয়ে শুরু করে…
-“তেরি মেহেরবানিয়া জনাব… আসুন আসুন খিলা দেখুন হিরো অউর হিরোইনের…জাকি শরফ… “
মণিবের আদেশমত নানা খেলা শুরু করে দুই পোষ্য। অপার বিস্ময়ে দেখে হাফপ্যান্ট পরা বছর আষ্টেকের আরেকটা খেটে খাওয়া মানুষ। খেলার মাঝে হাত বাড়িয়ে কেকটা দেয়, জাকি লাফিয়ে এসে কেকটা নেয় ছোট্ট কড়া পড়া মুঠোটা থেকে।

আরও একজোড়া কাজল পরা চোখও কিন্তু তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে এদিকেই। তার মা ব্যস্ত ফোনে,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ… ভেবোনা… বিকেলের আগেই পৌঁছব… লগ্ন তো সন্ধেয়… পার্লারের লোক এসে গেছে? আমার চুলটা কিন্তু…”
গোধূলী লগ্নে বিয়ে মনে হয়।

মায়ের অন্যমনষ্ক থাকার সুযোগে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে কমলা ফ্রক। তন্ময় হয়ে হাফপ্যান্টওয়ালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে। এমন সময় একটা গ্যালপিং মেদিনীপুর লোকাল তীব্র হর্ণ বাজিয়ে গাঁক গাঁক তেড়ে আসে প্লাটফর্মের পাশে, ‘ডাউন’ লাইন ধরে। আওয়াজে চমকে গিয়ে ‘জাকি’ লাফ মেরে দেয় সামনের কমলা ফ্রকের গায়ে। ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শিশুটি। ইতিমধ্যে টাইমটেবল দেখে তার বাবা এসে গেছে সামনাসামনি। তড়িঘড়ি ছুটে এসে মেয়ের গায়ের ওপর থেকে বাঁদরটাকে তুলে ধরে ছুঁড়ে দেয় অসম্ভব রাগে, প্লাটফর্মের অপরদিকের এক্সপ্রেস ট্রেন যাওয়ার লাইনটায়। প্লাটফর্মের কোনে মাথা ঠুকে নিচের লাইনে পড়ে জাকি। টাইমটেবলের লোকাল ট্রেনের লিস্টের বাইরের একটা দূরপাল্লার নীল দৈত্য ঝমঝম করে তখনই ছুটে চলে যায় ওর ওপর দিয়ে….

দোকানের ছেলেটি আকূল হয়ে দৌড়ে যায়। থ্রু এক্সপ্রেস ট্রেনটার পেরোনোর মিনিটখানেক সময়টুকু অনন্ত লাগে। মেয়েটি আরেকবার চিৎকার করে মুখ লুকোয় দু’হাতের চেটোয়। লোক জমা হয়ে গেছে ততক্ষণে। ছেলেটি এক লাফে লাইনে নেমে খানিকটা এগিয়ে যায়। দুচোখে জল নিয়ে তুলে আনে গোলাপী বাদামী একটা ছিন্নভিন্ন দলাপাকানো শরীর…

স্তম্ভিত সকলে, ফোন রেখে মা ছুটে এসে কোলে তুলে নেয় মেয়েকে, চোখে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টি স্বামীর দিকে। বাকি জনা কয়েক মানুষেরও চোখেও ভৎর্সনা। শুধু ‘জাকি’-র মালিকেরই চোখটা বোজা। কাঠের মত স্থির হয়ে গেছে তখনই, যখন জাকি-কে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল মাঝের লাইনের ট্রেনটার সামনে।
প্লাটফর্মের দুদিকের লাইন দিয়ে দুটো ট্রেনের সবেগে ছুটে যাওয়া, তীব্র আওয়াজ, ঘটনার আকস্মিকতা, কিছুই টলাতে পারেনি আরেকটি ছোটো প্রাণীকে তার পারফর্মেন্স থেকে। “দ্য শো মাষ্ট গো অন”। ময়লা প্লাস্টিকটার ওপর দু’হাত অঞ্জলি করে দাঁড়িয়ে আছে ‘শরফ’, খেলা শেষের অভ্যাসের প্রাপ্যর আশায় বুঝি। চোখ খুলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে সামনের ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে ‘জাকি’ আর ‘শরফ’-এর মালিক বলে ওঠে,
-“বাবুজী, খিলা দিখায়া, মেহেরবানি করকে কুছ…”

—সমাপ্ত—

© সুস্মিতা কুণ্ডু

One thought on “বাঁদরনাচ

Comments are closed.