
৭২ ঘন্টা
এসিটা কমালে হোত কিন্তু রিমোট টা কোথায় রে বাবা!
শীত করছে ভীষণ!
সায়নও কুঁকড়ে শুয়ে আছে। অকাতরে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। হাত বাড়িয়ে এক্সট্রা বেডশীটটা টেনে নিলো জাহ্নবী।আদুর গায়ে যত্ন করে ঢাকা দিয়ে কানের পাশে চুমু খেলো একটা।
তলপেটে চাপ পড়ছে, টয়লেটে যেতে হবে। লিকুইড তো কম যায়নি শরীরে। বিছানার নীচে পা রাখতেই মাথাটা ঘুরে গেলো। টাল সামলাতে না পেরে সায়নের গায়েই পড়লো।
চমকে জেগে উঠলো সায়ন। দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তারপর। কাল রাতের ভদকার এফেক্ট। বেশিই খেয়ে ফেলেছে।
সায়ন ইন্টারকমটা তুলে ব্ল্যাক কফি অর্ডার করলো।
রিসর্টের বারান্দা দিয়ে পরিস্কার সমুদ্র দেখা যায়। আগেও এসেছে এখানে। এবারে প্রায় চারমাস পরে এই ট্রিপ টা ম্যানেজ করা গেলো। দুজনেই বাড়িতে ভুরি ভুরি ঢপ মেরেছে। এম বি এ ফাইনাল ইয়ার দুজনেরই। সামনের বছর চাকরী বাকরী জুটে গেলেই, আহ্ স্বাধীনতা…আর এসব মিথ্যে কথা লুকোচুরি পোষায়না।
জাহ্নবী বেশ জুত করে সবে কফিটায় চুমুক মেরেছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ সায়ন ভূতে পাওয়ার মতো চিৎকার করে উঠলো,
-“শিট্!”
জাহ্নবী সমুদ্রে যাবে ভাবছিলো। আকস্মিক চিৎকারে কফি চলকে মাটিতে পড়লো। চমকে বলল,
– “কিরে“?
– “জিনি সি দ্য প্যাকেট ইজ ইনট্যাক্ট…উই ডিড আ মেস জিনি। তোর সেফ পিরিয়ড চলছে তো?
মুহূর্তে মুখ পাংশু হয়ে যায় জাহ্নবীর।
ঘন্টা দুয়েক পার। দুজনেই মাথায় হাত দিয়ে বসে। একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে সায়ন জাহ্নবীকে টেনে নিলো। চুল সরিয়ে কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
-“বেশি চিন্তা করিস না জিনি। যতদিন না চাকরী পাচ্ছি আমি ঠিক কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেবো দেখিস। যদি তোর পজেটিভ কিছু হয় ভালোই হবে কি বলিস?”
ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে জাহ্নবী।
– আর ইউ ম্যাড সায়ন? আমি বাড়ি গিয়েই আই পিল নিচ্ছি। আমাদের কেরিয়ার পড়ে আছে সামনে। এখন রিস্ক নিতে পারবো না। বাড়িতে কি বলবো?
– না। ইটস আওয়ার ফল্ট। আমরা গান্ডুর মতো কাজ করেছি। ফেস করবো। যা হবে সব ঠিক হবে। আমি তোকে প্রমিস করছি আমি সব ঠিক করে দেবো। ভরসা রাখ…প্লিজ জিনি ভরসা রাখ। আর হ্যাঁ নো আই পিল, তোর এমনিই একগাদা কম্পলিকেসি রয়েছে।
দে হাত টা দে। আমাকে ছুঁয়ে বল আমার সাথে আছিস?
চল্ ওঠ রেডি হ। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি। তোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি বাইক নিয়ে ফিরবো।
২.
ওটির বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো জাহ্নবী। সায়নের দাদা আর বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আত্মীয় বন্ধু হৈতেষীদের ক্রমাগত আগমন ও অনর্গল বাক্যস্রোতে দমবন্ধ লাগছিলো। পৃথিবী টা এক এক বার ফ্রিজ হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আবার স্টার্ট আবার ফ্রিজ…
এর মধ্যে কেউ একজন বলল,
“তুই জানিস জাহ্নবী ও হাওড়ায় কোন বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলো? ট্রাককে পাশ কাটাতে গিয়ে এভাবে ডিভাইডারে ধাক্কা ইসস!…”
ওটির বাইরে বেরিয়ে ডাক্তার বাবু বললেন, -“বাহাত্তর ঘন্টা না কাটলে কিছু বলা যাচ্ছেনা…প্রচুর ব্লাড লস…ভগবানকে ডাকুন..”
হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া পরের কথা গুলো আর কানে এলোনা জাহ্নবীর। সন্তপর্ণে একবার ওটির দরজায় হাত বোলালো। আর থাকতে পারছেনা এখানে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ভীষণ।
বাড়ি এসে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে রইলো বহুক্ষণ। নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নোনা জল, বয়ে যাচ্ছে প্রেম, বয়ে যাচ্ছে ঘন লাল তাজা রক্ত। উফফ, কত রক্ত বয়ে গিয়েছে ওর?
বাথরুমের আয়নায় একটা নগ্ন ভীত মেয়েকে দেখা যাচ্ছে কেবল। মরে যাওয়া আর না যাওয়ার মাঝে কেবল বাহাত্তর ঘন্টা! জীবন এত নগ্ন হয়ে আসেনি তো আগে।
গায়ে রোব টা চড়িয়ে বাইরে আসে জাহ্নবী। সায়ন যদি চলে যায় জাহ্নবী কি করবে? ধরা যাক সায়ন আর নেই। তাহলে প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াতে হবে তো। বাঁচতে হবে তো? অনাগত প্রানকে উপেক্ষা করা যায় কিন্তু আসার পরে যদি তাকে গর্ভে হত্যা করতে হয়! পারবে তো?
আর যদি সায়ন ফিরে আসে? যদি ভুল বোঝে ওকে? যদি ক্ষমা না করে?
জীবন আর মৃত্যু গুলিয়ে যায় জাহ্নবীর। একজন মৃত্যুমুখী আর একজন জীবনের অপেক্ষায়…মাঝখানে দড়ি ছেঁড়া সাঁকোয় দুলতে থাকে সে।
৩.
রাত প্রায় দুটো। জাহ্নবীর হাতে আই পিলের স্ট্রিপ। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে খেয়ে নিলেই…বাহাত্তর ঘন্টা! আবার!
– আমার ওপর তোর একটুও ভরসা নেই জিনি। তুই মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারছিস না আমার জন্য?
ধড়মড় করে উঠে বসে জাহ্নবী। দোলাচলে কেটে যায় বিনিদ্র রাত। আস্তে আস্তে স্ট্রিপ ছিঁড়ে পিল টা বের করে। গ্লাসে জল নেয়। গলা থেকে নেমে যায় সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু আর চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে জল।
সেই মুহূর্তেই হোয়াটস্যাপে মেসেজ ঢোকে রূপসার।
– জিনি…সায়ন ইজ আউট অফ ডেঞ্জার নাও…
ফোনটা ছুঁড়ে বাথরুমে গিয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে জাহ্নবী। খালিপেটের সবজেটে জল উঠে আসে শুধু। কাশির দমকে নাড়িভুঁড়ি উঠে আসে। পাগলের মত সাদাটে গোলাকার ছোট্ট ট্যাবলেট টা খোঁজে। কি করে দাঁড়াবে সায়নের সামনে? কি করে?
~~~~^^^~~~~
©️শিল্পী দত্ত