
ইকবাল
তখন শীত আসতো কালীপুজোয়। শুকপুজোয় বাজি ফাটানোর সময় মারাত্মক রকম হ্যাঁচ্চোপ্রবণ আমাকে মা ইয়াব্বড় একটা চাদরে গুটুলিপুঁটুলি করে ছাদে আনতো। শুকের বরণে প্রদীপের তাপ বেশি বেশি করে লাগাতো গালে পিঠে। বড় হয়ে যাবার অনেক পরেও মনে আছে মনসা পাতায় পাতা ঘিয়ের বিচ্ছিরি একটা কাজল গোটা চোখময় ধেবড়ে দিতো। চোখ নাকি ভালো থাকবে..হুঁহ!
রন্তু, বুকুন দাদা আর ছোটকা মিলে বোতলে ভরে হাউই ছুঁড়তো আকাশে। আমি একছুট্টে মেজকাকিমনির আঁচলের তলায় লুকোতাম। ছোটকা বলতো হাউইটা নাকি আকাশে না গিয়ে আমার পেছনেও ধাওয়া করতে পারে..
ভাইফোঁটা দেবো বলে খাওয়া মানা। মা কাকিমনি নেমে গেলে বুকুন দাদা পকেট থেকে দুটো বাপুজি কেক বের করে বলতো,
“মুর্খ! সূর্য না উঠলে সকাল হয়? সকাল না হলে পরের দিন হয়? গাধা কি গাছে ফলে? মাথায় গোবর…”
আমি আর সোনাদিদি একটানা লেকচার শোনার ভয়ে তড়িঘড়ি কাগজের মোড়ক খুলে কেক খেয়ে নিতাম। আসলে শুধু লেকচারের ভয় নয়, রাত থেকে উঠে বেজায় খিদেও পেতো…
রাঙাদিদি কিন্তু একটুও খেতোনা। মুচকি হেসে “তোরা খা” বলে নীচে নেমে যেতো।
রাতে ঠাকুর দেখতে যেতাম লাল ব্যাগি সোয়েটার আর বৌ টুপি পরে। দুদিন পরে স্কুল খুলেই হাফ ইয়ার্লির রেজাল্ট। মা কালী তো আর সরস্বতী নন! রেজাল্ট টা কতদূর সামলাতে পারবেন সেই নিয়ে সন্দেহ হোত। রাঙাদিদি বলতো যখন যে ঠাকুরের পুজো হয় তখন সেই ঠাকুর পালা করে আমাদের প্রবলেম সলভ করেন। তাই অগত্যা মা কালী, চোখ বুজে ঘুমোনো শিব, রক্তখেকো শেয়াল, মায় খাঁড়া হাতে ডাকিনী যোগিনী ওব্দি সবাইকেই অনুরোধ করে আসতাম। বলা যায়না কার কখন সময় হয়…
মায়ের হাত বাটনা বেটে বেটে ‘সানিদেওয়ালে‘র চেয়ে কম শক্ত নয়। সেই হাতের থেকে রেজাল্ট বেরোলে স্পাইনাল কর্ড টা যে বেঁচে যেতো সেটাও আসলে একপ্রকার মায়েরই দয়া। মায়েরই হাতে বোনা ডাবল উলের ইয়াম্মোটা জাবদা পুলোভার…
বিয়েবাড়িই হোক আর যাই হোক কেনা সোয়েটার পরার লাক্সারী আমাদের হয়নি তখনো। টাকা আছে বলেই শখের জিনিস ছেলেপুলে কে কিনে দিতে হবে এমন আবদারের নাড়ুগোপাল হবার সৌভাগ্য আমাদের ছিলোনা মোটেই। তার উপর বাড়ির ছোট বলে আমার অবস্থা আরোই সঙ্গিন।তিন জনের হাতফেরতা হয়ে আমার সাইজে আসা সোয়েটার গুলো অধিকাংশই রঙজ্বলা আর ববলিনওঠা।
সে বছর শীতে প্রথম রাঙাদিদির জন্য একটা নীল রঙের ফিরান কেনা হল সামনের কাশ্মীরি দোকানটা থেকে। সারাবছর তালা দেওয়া দোকান টা কালীপুজোর আগেই বরাবরের মতো খুলে গেছিলো। বাহারী শাল, কোট, ফারের জ্যাকেট, মেশিনে বোনা কার্ডিগানের পশরা সাজিয়ে মাস চারেকের মতো আবার চলে এলো ‘ইকবাল‘।
টিকালো নাক, আপেলের মতো ফরসা রঙ, সদাহাস্যমুখ ইকবাল।
আমাদের বাড়িতে আরো একজন থাকেন। রাসুদিদা..
রাসুদিদা বম্মার মা। নিজের মা নন। সৎ মা। বম্মার আর কেউ কোত্থাও নেই। একমাত্র ভাই ছিলো সেও নাকি নিরুদ্দেশ। অগত্যা দিদাকে আমাদের বাড়িতেই নিয়ে আসা ছাড়া আর উপায় কি! বম্মা আর জেঠুর বিয়েতে আমাদের বাড়ির কেউ খুশি হয়নি। জেঠু কলকাতায় পড়তে গিয়ে কিভাবে যেন বম্মার সাথে বিয়ে করেছিলো সে বাপু আমরা ঠিক জানিনা।
বম্মারা ওপার বাংলার মানুষ। ‘খাইতাসে যাইতাসে‘ বাঙাল ভাষা বোঝা যায় তবু, কিন্তু রাসুদিদার কথা আমরা একেবারে বুঝিনা।
বম্মা বলে বম্মারা মাস্টারদার দেশের লোক।
মা বম্মাদের খুব প্রয়োজন ছাড়া আমরা বাড়ির বাইরে বেরোতে দেখিনা। বেরোলেও কারোর সাথে। একা নয়। ঠাম্মাতো একেবারেই বেরোয় না। কালীঘাটে পুজো দিতে বছরে একবার কলকাতায় বড় পিসিমনির বাড়ি যান। ডাক্তার বদ্যিও বাড়িতেই আসেন। সব লোকই বাড়িতে আসে আমাদের। মাছওয়ালা, সব্জিওয়ালা, দেশিডিমওয়ালা, মুড়িওয়ালি, দুধ ঘিয়ের গয়লানি, ধোপাকাকা, নাপিতকাকা আরো সব কিসের কিসের লোক সবাই।
আমাদের ছাদের পাঁচিল, বারান্দার পাঁচিল সবই এত উঁচু যে বাইরে থেকে কিছু দেখা যায়না। গায়ে লাগা বাড়িগুলোয় জানালা দিয়ে মা কাকিমাদের কথা হলেও রাস্তায় বেরিয়ে আড্ডা গল্পের চল নেই একদম। ব্যতিক্রম রাসুদিদা। রাসুদিদা সারাটাদিন একতলার রোয়াকে বসে পথচলতি মানুষের খবর নেন। পাড়ার মেয়ে বউদের সাথে বাড়ি গিয়ে গল্প করে আসেন। বাটি করে এটা ওটা নিয়ে আসেন। ছাদের যে মুড়ি ভাজা, পোড়াপুড়ি করা, আমাদের স্নানের জল গরমের মাটির উনুন করা আছে সেখানে বাতিল জিনিস দিয়ে সারাদুপুর নানান রান্না করেন।
সেসব রান্নাঘরে রান্না করতে দেয়না ঠাম্মা। রাগ করে বলে,
“বাঙালের মরণ“
এত সহজ মেলামেশায় ঠাম্মা অভ্যস্ত নন। রাসুদিদাকে ঠাম্মা একেবারে পছন্দ করেনা।
ইকবালের সাথে দিদার খুব দোস্তি। ঢোলা পাজামা আর আফগানী কুর্তার ওপর জব্বর জ্যাকেট চাপিয়ে সন্ধ্যে নাগাদ দোকানের বাইরে ছোট্ট মতো একটা বনফায়ার তৈরী করে ইকবাল। সেই আগুন খানার ধারে বসতে রাসুদিদা ভারী ভালোবাসে বলে ইকবালই আম্মাহোওও বলে হাঁক পাড়ে রোজ। গুটি মেরে আগুনের ধারে বসে ঠাম্মা জিগেস করে, “এগবাল অনের বাড়ি হডে?”
ইকবাল উত্তর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, “আম্মা হামি কশ্মীর আসে…শওল আসে…কশ্মীরিই শওল…”
দুটি ভিন্ন ভাষার মানুষ কি উপায় একে অপরের কথা বুঝে নেয় উপরওয়ালাই জানেন।
দুপুর বেলা আমার ঘুম পায়না। রাসুদিদারও ঘুম নেই। কুল খাওয়া বারণ বলে গুড় তেল লংকা দিয়ে কয়েতবেল মেখে সেই নিয়ে রোয়াকে বসি দুজন। দিদা পথচলতি এরওর সাথে গল্পে ব্যস্ত। এরমধ্যেই ইকবাল দুপুরের খাওয়া সেরে হয়তো আসছে, দিদা পাকরাও করলো..
“অঅ এগবাল দুইজ্জে কিদি ভাত হ?”
ঘাড় নেড়ে ইকবাল বলতো,
“আম্মা বাহত গোস্ত..”
রাসু দিদার প্রশ্নের শেষ নেই। আবার জিগেস করতো, “কুরা খায়স না পাঁইট্যা খায়স?”
কুরা মানে মুরগী। রাসুদিদা মুরগীকে বলতো “কুরা“
প্রায় রোজই ইকবালকে রাসুদিদা একটা প্রশ্ন করতো, “এগবাল তুঁ পড়ালেহা গরস না?”
ইকবাল হো হো করে হাসতো আর পেটের দিকে হাত দিয়ে দেখাতো। দিদা কেন জানিনা খুব দুঃখ পেয়ে আঁচলের খুঁট থেকে দুটাকা বের করে হাতে দিয়ে বলতো “লস্যান কাইস…”
দুপুরবেলা একদিন বাড়ি থেকে বাটি করে চাট্টি মুড়ি নিয়ে ইকবাল কে দিতে গিয়ে ঠাম্মার বকা খেলো রাসুদিদা। কদিন ইকবাল দোকান খোলেনি। তার নাকি খুব জ্বর। ঠাম্মা মুড়ির বাটি কোথায় যাবে বুঝে নিয়ে অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
“হ্যাঁ গা বেয়ান, বলি মোল্লার ব্যাটার সাথে অত কতা কও কেন?”
রাসু দিদা চোখ নামিয়ে চোরের মতো বলল,
“পুয়ায় দুয়ান দিসে..ভালা নাই…গাজ্জর..মায়া লাহে..বড় মায়া লাহে..দ্যাশ সাইরা আইসে…
বুকুনদাদা আর রাঙাদিদির সারাটা দিন খালি যত চুপিচুপি কথা।
আমার একদম ভাল্লাগেনা। আমি গেলেই চুপ করে যায়। কানপেতে শুনে দেখেছি কিছুই বোঝা যায় না।
আমার এরকম চুপি চুপি কথা বলার কেউ নেই। রন্তুর সাথেও আমার পটেনা। আমি বাংলা মিডিয়াম বলে রন্তু আমায় হ্যাটা করে খালি। অথচ ওর আর আমারই পড়ার টেবিল এক। রন্তু আমার চেয়ে একক্লাস নীচে পড়ে। বুকুনদাদা রাঙাদিদি এক টেবিলে পড়তে বসে। পড়ে তো ঘন্টা! খালি যত গুজুর গুজুর…
সোনাদিদির বুদ্ধি খাটো বলে ওকে ছোটকা পড়ায়। বুদ্ধিতে খাটো হলে কী হবে সোনাদিদি ভারী ভালো নাচে।
সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে বসলেও বাড়িতে হ্যারিকেন আর ইমার্জেন্সি লাইট গোনাগুনতি ছিলো বলে লোডশেডিং হলে আমাদের একসাথেই পড়তে বসতে হত। মাদুর পেতে একটাই হ্যারিকেন অথবা ইমার্জেন্সি লাইটের চারিধারে আমরা গোল হয়ে বসতাম। শীতকালে হ্যারিকেনের ওমটা ভারী আরাম দিতো। অনেক পরে যখন ইনভার্টার কেনা হল তখনও এই ওমটা খুব মিস করতাম। আলো জ্বলে গেলেই অন্ধকারের শব্দ গুলো কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
রন্তুর পাশে পড়তে বসলে লোকের রন্তুর পড়াই মুখস্ত হয়, নিজেরটা আর হয়না, কারণ ষাঁড়ের মতো চিল্লিয়ে একটা সেনটেন্স দশবার ব্রেক মেরে মেরে পড়ে রন্তু। ওর জিয়োগ্রাফি বইতে হাউসেস চ্যাপ্টারে অনেক রকম ঘর বাড়ির ছবি দেওয়া ছিলো। স্লোপিং রুফ, ইগলু, ট্রি হাউস, টেন্ট আর হাউসবোট..
আমি জানি কারণ আমি রন্তুর পড়ার আগেই ওর সব বই পড়ে ফেলি।ইংরেজি মিডিয়াম বলে রন্তু আমার চেয়ে বেশি ইংরেজি শিখে নেবে এ আমি একেবারে সহ্য করবোনা।
সেদিন রন্তু যথারীতি বাড়ি মাথায় করে ওই চ্যাপ্টারটাই, “…অ্যাঁ অ্যাঁ উই ক্যান সি… অ্যাঁ উই ক্যান সি… অ্যাঁ অ্যাঁ উই ক্যান সি হাউস বোট… অ্যাঁ হাউস বোট… অ্যাঁ হাউস বোট ইন কাশ্মীর অ্যাঁ ইন কাশ্মীর” করে করে পড়ছিলো। আমি ধাতুরূপ মুখস্থ করার ভান করার সময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক সেই সময়েই বুকুনদাদা রাঙাদিদির হাতে চিমটি কেটে দিলো। রাঙাদিদি আবার মিটিমিটি হাসছিলো। আমার পড়া মাথায় উঠলো।আমি চোখের সামনে ডালমে কুছ কালা কিংবা ডাল লেকে ভাসা কালো কালো শ্যাওলা দেখতে পাচ্ছিলাম।
এই অতিপ্রয়োজনীয় তথ্যটা এক্ষুনি গিয়ে মা কে বলা জরুরী মনে হতেই “যাই জল খেয়ে আসি” বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মা উবু হয়ে মশলা বাটছিলো। আমি পিঠের ওপর থেকে গলা জড়িয়ে মাকে পুটুস পুটুস দিলাম সব বলে।মায়ের হাত আচমকা থেমে গেলো। ব্যস্ত হয়ে চারদিক ভালো করে দেখেনিয়ে আমাকে টেনে বলল আর কাউকে যেন ঘুণাক্ষরেও এসব কথা না বলি।
দূর বাবা! মজাটাই মাটি…
মাকে কিছু বলেই কোনো লাভ হয়না।
ওবাড়ির বড়দিঠাম্মা এসে মুখে জর্দ্দাপান ঠুসে যখন মা বম্মার খুব নিন্দেমন্দ করে আর আমি ভাজা মাছ উলটে খেতে জানিনা মুখ করে সেসব শুনে এসে মাকে বলতে যাই, মা তখনও ” বড়রা ওরম বলেন, শুনতে নেই..” বলে আর কেবল কাজই করে যায়, কেবল কাজই করে যায়।
তাহলে কি ডাল লেকের শ্যাওলার কথা বম্মাকে বলবো? দূর বম্মা তো মায়ের চেয়েও ভীতু। ছোটকাকে বলি বরং। ছোটকাকে বললে লাভ আছে। একমাত্র ছোটকাই ঠিক টা ঠিক বলে ভুলটা ভুল।
সেদিন যখন ছোটকা আমায় দিয়ে রাঙাদিদি বুকুনদাদাকে ডেকে আমাকেই ঘর থেকে বের করে দিলো, আমি বুঝে গেলাম এই বাড়িতে আসলে আমার নিজের বলতে কেউই নেই।
কিন্তু এত দুঃখ খুব বেশিক্ষণ টিকলোনা বলে আর মরলেও স্বভাব যায়না বলে আমি জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, ওমা! বকার বদলে ছোটকা তো রাঙাদিদির মাথায় হাত বোলাচ্ছে। কিন্তু রাঙাদিদি এত কাঁদছে কেন? বুকুনদাদা রাঙাদিদির পিঠে হাত রেখে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এইতো এত হাসিঠাট্টা হচ্ছিলো বাবা। এখন এত গম্ভীর কেন?
যাকগে সেদিন রাত থেকে রাঙাদিদির খুব জ্বর আসাতে আমি কানমূলে মা সরস্বতী কে বলে দিয়েছি আমি আর কাউকে কক্ষনো রাঙাদিদির ডাললেকের কথা বলবো না।
রাঙাদিদির ড্রয়ারে ছোট্ট কাঠের অবিকল ইকবালের ক্যাশবাক্সের মতো বাক্স দেখেও আমি মা কে বলিনি। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ফিরানের ওপর স্কার্ফ টা গলার বদলে সেই শেফালিখানের মায়ের মতো করে মাথায় বাঁধতে দেখেও কিছু বলিনি। ইকবাল শাল টাঙাতে টাঙাতে “সাহিবো ও সাহিবো” বলে গান গাইলে রাঙাদিদি যখন হুড়মুড়িয়ে ছাদে যায় আমি সেসব দেখেও কাউকে বলিনা। আমি রাঙাদিদিকে খুব ভালোবাসি। আর রাঙাদিদিকে শেফালিখানের মায়ের চেয়ে ঢের ভালো লাগে মাথায় স্কার্ফ বাঁধলে।
শীত প্রায় যাই যাই…
রাসুদিদা একগাদা ডালের বড়ি কুমড়োর বড়ি হ্যানের বড়ি ত্যানের বড়ি দিয়ে সারাবছরের কোটা পূরণ করে ফেলেছে। এত্ত বাঁধাকপি কুচিয়ে মশলা মাখিয়ে রোদে ঝামা করে কৌটোয় ভরে রেখেছে অদিনে খাওয়া হবে বলে। সেই দেখে ঠাম্মা, “বেয়ানের কি আক্কেল! অদিনে কপি খেয়ে কি পেটে বায়ু হয়ে মরবে নাকি গা? খবরদার ওসব যেন রান্নাঘরে না ঢোকে..” বলে শ্লেষ হেনেছে।
রাসুদিদা এসব গায়েই মাখেনা। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় রাসুদিদার আনন্দে থাকাটাই জীবনের বীজমন্ত্র ছিলো। প্যাঁকাল মাছের মতো জীবনধর্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে কিছু মানুষ। সংসারের সারটুকু তারা শুধু ফলের আশা ছাড়া কর্ম করে যাওয়াকেই বোঝে। এদের ব্যথা দেওয়াও যা না দেওয়াও তাই। এরা নিজেদের হৃদয়গুণে ধনী। আমাদের মতো হীন দের সাধ্য কি এদের ব্যথা দিই।
রাসুদিদা ফোকলা দাঁতে হেসে বলে,
“দিদি অনে রাগ গরজ? মেলা গরসি…হক্কলে হায়ূম…”
হায়রে দিদা! তোমার মতো সক্কলকে নিয়ে খাবার মতো মন কি আর সবার ছিলো?
দেখতে দেখতে হোলি এসে গেলো। আমাদের চাঁচরের শুকনো নারকোল, সুপুরির পাতা, সরু সরু বাঁশ পাতা, তালপাতা সব বাগানের পাশে বোঝাই করা শেষ। দরকারি কাগজ গেঁথে রাখার আঁক শিটায় রাঙা আলু আর বেগুন ও গাঁথা হয়ে গেছে। মেজকাকিমনি প্যাঁড়াকি বানিয়ে রাখছে কাল পাড়ার ছেলেরা পায়ে আবীর দিতে এলে খেতে দেওয়ার জন্যে। আমি আর রন্তু গোটা দশেক হাওয়া করে দিয়েছি।
সোনাদিদির মাধ্যমিক বলে ঘরবন্দী। রাঙাদিদি কে জানে কেন আমাকে আর রন্তুকে খামোখা দুটো ডেয়ারি মিল্ক দিয়ে খুব আদর করে গেলো।
যাকগে বড়দের ব্যাপারে মাথা ঘামালে বড্ড বকুনি জোটে। তারচেয়ে চকলেটটা খেয়ে নিই তাড়াতাড়ি…
মিষ্টি আলু পোড়া, বেগুন পোড়া খেয়ে আমি আর রন্তু পরেরদিনের রঙ, পিচকিরি, বেলুন গুছিয়ে রেখে ঘুমিয়ে গেছি। সকালে ঘুম ভাঙলো বম্মার কান্নায়..
রাঙাদিদিকে নাকি কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। জেঠুমনি মেজকামনি থানা থানা করছে। বাবা দাবড়িয়ে চুপ করিয়ে দিলো। চোখ কচলে দালানে গিয়ে দেখি মা বম্মা কাঁদছে খুব। ঠাম্মা বলল, “ছোটলোকের রক্ত যাবে কোথায়? পালানোই তো ধম্ম…আমি তখনই জানতুম বংশে চুনকালি দেবার জন্যেই মা মেয়ে আমার সংসারে শনি হয়ে ঢুকেছে…”
ছোটকা শান্ত স্বরে ঠান্ডা চোখে ঠাম্মার দিকে তাকিয়ে বম্মার কাছে গিয়ে বসলো। বুকুন দাদা কই? উফফ রন্তুটা এখনো ঘুমোচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম ইকবালের দোকানে তালা। তাহলে কি…!
মাসতিনেক পরে রাঙাদিদি ফোন করেছিলো বাড়িতে। মেজকামনি তুলেছিলো।
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমাদের বাড়িতে সুদেষ্ণা আঢ্যি বলে কোনো মেয়ে কোনোদিন ছিলোনা” বলে দুম করে ফোন রেখে দিয়েছিলো..”
আর কোনো দিন ফোন আসেনি।
ঠাম্মা বলেছিলো এমন মেয়েকে নাকি জন্মের সময়েই গলায় নুন দিতে হয়। ছোটকা আমাদের বাড়িতে আর থাকেনি। চাকরি নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছিলো। বুকুনদাদা হাউহাউ করে কেঁদেছিলো সেদিন আমাকে জড়িয়ে। বলেছিলো, একদিন দিদিকে আমি ঠিক ফিরিয়ে আনবো দেখিস…কথা রাখতে পারেনি বুকুনদাদা। তার বদলে নিজেই বিদেশে চলে গেলো।
রাসুদিদাই একা বুক চাপড়ে, ” বাঁইসা তাহো রে পরাণ পুত আঁর বাঁইসা তাহো” বলে কেঁদে ওঠার সাহস দেখিয়েছিলো। কারোর তোয়াক্কা করেনি।
~~~~o~~~~
©️ শিল্পী দত্ত
One thought on “ইকবাল”
এত সহজ সুন্দর লেখা এগিয়েছে তরতর গতিতে। পড়তে কোথাও ক্লান্তি বা বিরক্তি আসে নি, বরং যুক্ত হয়ে গেছি কাহিনীর সাথে তার ইঙ্গিত-আভাষের দিকে। পুব্বাংলার কথ্য ভাষাও শিখলাম খানিক।
Comments are closed.