জন্নত

Friends, Short Story, Story, বাংলা

ময়লা চাদরের উপর কতগুলো খুচরো পয়সা, ততোধিক ময়লা জোব্বা গায়ে রাস্তার পাশে বসে ঢুলছিলো রাশিদ। হঠাৎ সামনে কড়কড়ে একটা পাঁচশোর নোট পড়তে ঘোলাটে চোখটা টেরিয়ে দেখে নিয়েই,

লা হোল ওয়ালা কুওয়াত ইল্লা বিলাহসর ঝুঁকা আল্লাহ কে বন্দে সর ঝুঁকাবলে ছোট ঝাঁটা টাইপের কিছু একটা হাতে তুলে নেয়।

ইরশাদ পার্স টা পকেটে গুঁজতে গুঁজতেই মাথাটা দুয়া নেবার জন্য সামনে ঝুঁকিয়ে আনে। তেলচিটে  ছোট্ট মতো একটা সবজেটে কাপড় মাথায় রেখে বিড় বিড় করে রাশিদ,

খবর পক্কি হ্যায় জনাব, আম্মি বিমার হ্যায়, আজাদ পনছি ঘর লওটেগা দের রাত, আল্লাহ্ মালিক..আল্লাহ্ মালিক

শেষের শব্দ দুটো বেশ জোরে। এদিক ওদিক দেখে হাঁটা লাগায় ইরশাদ। হাতে সময় খুব কম। অল্প সময়ের মধ্যেই জনাদশেকের শার্প শ্যুটার টিম রেডি। প্রত্যেকের ই পরনে সাধারণ কুর্তা পাজামা। রাতের রঙের সাথে সামঞ্জস্য রাখা যাতে সহজেই মিশে যাওয়া যায়। অ্যাকর্ডিং টু রাশিদ মাঝরাতে আসার কথা ওদের। সেই অনুযায়ী হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে এখনো।

এই বাড়িটা খুব চেনা ইরশাদের। এক পলক বাইরে থেকে দেখে নিয়েই কার্নিশ বেয়ে জানালার পাশে পজিশন নিয়ে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ালো। হাতের ইশারায় বাকিরাও যে যার জায়গা মতো..

ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। হঠাৎ আলতাফ আজই আসছে কেন? ঘ্রাণেন্দ্রিয় থেকে একটা সুবাস কোষে কোষে ছড়িয়ে পরে ইরশাদেরগোস্তাবা! অকস্মাৎ মনে পড়ে আজ ফেব্রুয়ারীর ষোল। আজ আলতাফের জন্মদিন..

…”ইরশাদ আজ আম্মীজান পুলাও অর গোস্তাবা বনায়া। শাম কো দাওয়ত হ্যায়। আ আ আ না জরুউউউর…”

খুট করে জ্বলে ওঠে ঘরের আলো। ফিকে আলো। মোহন রিভলভারের ক্ল্যাচ টেনে নিলো দ্রুত। গুনগুনিয়ে গান আসছে ঘরের ভেতর থেকে। সুর আর স্বর দুটোই খুব চেনা। বুকের ভেতর স্পষ্ট হাতুড়ির আওয়াজনূরী!

ইরশাদ মেরে লিয়ে নারঙ্গি দুপট্টা লাদোগে?

ইরশাদ আব্বা হুজুরকো আর্মিওয়ালে উঠা লে গয়ে। ইরশাদ কুছ করো। আলতাফ লাপতা হ্যায়। আম্মি মর যায়েগি ইরশাদ..

গোস্তাবার গন্ধ ছাপিয়ে নাকে এসে লাগে বারুদের গন্ধ। আঁশটে রক্তের গন্ধ। আলতাফের আব্বার মৃতদেহ দাফনের আগে দেওয়া আতরে র গন্ধ।

আলতাফ কো লাদো ইরশাদ। আম্মি মর যায়েগি। নূর নিগাহেঁ..আল্লাহ্! দুনিয়া মে মেহজবিন কি অস্ক সে কিমতি কুছভি নহি।

স্যর, আরাহা হ্যায়। চওকন্না রহেনা হ্যায়।মোহন বলে উঠলো। চারজন প্রাচীর টপকে ঢুকছে। রাতের অন্ধকারে। চোরের মতো। অথচ নিজেরই বাড়ি। নিজের দেশ। দরজা ভেজানোই ছিলো, ঢুকেযেতে কারোরই অসুবিধে হবার কথা নয়। হল ও না। সবাই ঢুকেযাবার পর চারপাশে নজরদারি চালিয়ে বাকিদের ইশারায় পজিশন নিতে বলল ইরশাদ।

নূরি বেঁটে কাঠের টেবিলে খাবার বাড়ছে। আম্মি জড়িয়ে আছে আলতাফকে। না ছাড়লে মুশকিল। অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে বাকিরা। চারটে জঙ্গীর সাথে দুটো নির্দোষ মরবেই। তাতে কি!

ইরশাদ ম্যায় অগর চাচাকে সাথ আজাদী কি জঙ্গ পে সামিল হুই তো তুম নূরী অওর আম্মীকা খয়াল রখোগে?”

সময় চলে যাচ্ছে। দুর্মূল্য সময়। আম্মি কাঁদছেন। প্রথমে ফুঁপিয়ে তারপর ফুলে ফুলে..

..”নূর ইরশাদ কো দাওয়াত পে নহী বুলায়া? গোস্তাবা তো উসকা ভি পসন্দ কা হ্যায়। অওর আলতাফ ইয়ে কিন দোস্তোকো ঘর লায়ে হো?  ইয়ে হামারে লোগ তো নহি হ্যায়। ইরশাদ কো কিঁউ নহি বুলায়াকিঁউ

একই কথা বার বার বলতে থাকেন আম্মি। নূরী খাবার ছেড়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় বৃদ্ধাকে শোবার ঘরে রেখে আসতে। মায়েরা গন্ধ চেনে। মায়েরা বন্ধু চেনে। আলতাফকে ঈষৎ উদাস লাগে যেন।

ইরশাদ প্রস্তুত ছিলোনা। মোহন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দেয়। পর পর দুটো বুলেট। মোহনের অব্যর্থ নিশানা। বাকিদেরও। মুহূর্তের বিবশ ভাব কাটিয়ে ইরশাদও ধরাশায়ী করে ফেলেছে একজনকে। কয়েক সেকেন্ডে অপারেশন সেরে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দশজনের টিম। জিপের পেছনে বসে শুকনো ঠোঁট চেটে নেয় দেশকা সিপাহি। মস্তিস্কে দামামা বাজায় নূর নিগাহেঁভাইএর দেহের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতেও যে বলে উঠেছিলো,

ইরশাদ আলতাফ কো ঢুন্ডকে লাও কহিঁসে ভি। আম্মি মর যায়েগিআম্মি মর যায়েগি।

~~~^^^~~~

লেখিকা ~ শিল্পী দত্ত