
স্বৈরিণী
প্রত্যেক মানুষের মনেই ভয়ের একটা আলো আবছায়া গোপন অন্তরাল থাকে, সেই ভয়াল নির্জন ঘরের আগলটুকু খুললে মানুষকে তার সবচেয়ে অপছন্দের কারুর মুখোমুখি হতে হয়, সে ব্যক্তিটি আর কেউ নয়…, সে নিজেই; তাই চট করে শ্যাওলাভিজা চ্যাটালো আঁঠালো ঘরটার জমিতে কেউ পা রাখতে চায়না। পা রাখলেই বুঝি ক্লেদাক্ত সেই মাটি থেকে হাজারো হাজারো কীটপতঙ্গ এসে পা বেয়ে বেয়ে শরীরকে আঁকড়ে ধরবে, শিরা উপশিরায় ছড়াবে বিষাক্ত ক্লেদ। কালকূট স্বেচ্ছায় কেই বা শরীরে ধারণ করে?
*****
“বিজুরী চমকে মোহে অতি–হি ডরাবে,
গরজে গরজে ঘন বরষে মেঘা”
কালবৈশাখী শেষে বর্ষা নেমেছে দহনক্লান্ত কলকাতার বুকে, বারান্দায় বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দিতি। মিঁয়া মল্লারের দমকে বজ্রগর্ভ রাত্রি চপলা রাধিকার মত অভিসারিকা হয়ে উঠেছে।
মুহুর্তের ব্যবধানে বারবার রূপালী ঝলকে কেঁপে কেঁপে উঠছে প্রকৃতির অন্ধকার সিল্যুয়েট। রতিসুখের শীৎকারে যেন মুখরিত ধরিত্রীবক্ষ। বারান্দার রেলিংগুলো পুরোনোদিনের, ফুলেল ডিজাইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জলের ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে দিতির সর্বাঙ্গ। সেদিকে খেয়াল নেই মেয়েটার। বাতাসের গায়ে কান লাগিয়ে বৃষ্টি শুনছে দিতি। হাতের আঙুলগুলোর ডগায় জলের ছিটে লেগে শিরশিরানি অনুভূতি হচ্ছে ওর। পাশের ফাঁকা জমিটায় অতিবৃদ্ধ পাকুড় গাছটার মগডাল নুইয়ে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। যেন কোনো এক কড়া দিদিমণি এসে অবাধ্য ছাত্রের কান মুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দিচ্ছেন বারবার।
এমন কালবৈশাখী বর্ষার দিনে দিতির মন খারাপ করে। ছোটবেলায় আম কুড়ানোর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।পরের দিন সকালবেলা রোদ উঠলে কেমন বিধ্বস্ত আমবাগানের মধ্য দিয়ে ছুটত ফ্রকপরা দুই কিশোরী। চারিদিকে সারি সারি গাছের ভগ্ন শাখাপ্রশাখা টপকে টপকে আম কুড়ানোর সে মজাই ছিল আলাদা। বছরের এই সময়টায় আমে এখনও পাক ধরে না। ফ্রকের ফ্রিলগুলোর কোচড়ে কাঁচা আমগুলোকে লুকিয়ে দৌড় তারপর। দুর্গাপুর এবিএল টাউনশিপের তখনও ঘুম ভাঙেনি। কারখানার প্রথম শিফ্ট শুরুর সাইরেন বাজতে তখনও দেড় দুঘন্টা দেরী। দীপক সমাদ্দারের এল বাই ফিফটিটু কোয়ার্টারের সামনের জমিটায় একটা বাগানবিলাস লাগিয়েছিলেন রজনী। ১৫ বছরের সেই গাছটাকে বেষ্টন করে শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে দীপকের সাইকেল। কাল ঝড় হওয়াতে বারান্দায় তুলে রাখা হয়েছিল। বসার ঘরের দরজা খুলেই বিরক্তিতে মুখ কু্ঁচকে যায় রজনীর। গোটা কলোনীর প্লাস্টিক, রাজ্যের খড়কুটো, কতশত ছেঁড়া কাগজ ভিজে বারান্দায় ছিটিয়ে আছে বেওয়ারিশ লাশের মত। এগুলো ঝাঁটিয়ে পরিষ্কার করা, কত হ্যাপা! কোমর নীচু করে কাজ করতে অসুবিধা হয় রজনীর। বিয়াল্লিশেই বাহাত্তুরেতে ধরেছে রজনীকে। তিথি আর দিতি দুই মেয়ে বিয়োতেই রজনীর শরীরের বাঁধুনী ভেঙে চৌচির। মেয়ে দুটোকে উঁকি দিয়ে এদিক ওদিক খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। নিশ্চয়ই আম কুৃড়াতে বেরিয়েছে। পিছন ফিরতেই লোহার গেটটায় ছিটকিনি খোলার খুট করে একটা আওয়াজ হয়। দিতির গোলাপি ফুলছাপ ফ্রকটায় কাদা লেগেছে, তিথিরটায় তুলনায় কম। বয়েস বাড়ছে দুজনেরই। দিতি ১২ আর তিথি ১৮। দীপক সম্মাদারের কারখানার অবস্থা ভালো নয়। ইতিমধ্যে দুবার সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিশ পড়েছে। সত্তর দশকের প্রতিষ্ঠিত এসিসি ব্যাবকক লিমিটেড মাত্র দশ বছরের ব্যবধানেই ধুঁকছে। স্টিম বয়লারের বাজার দখল করেছে ভেল, ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড। শক্তিমন্ত্রকের লাগাতার হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এবছর এখনও পর্যন্ত মাত্র পাঁচ খানা বয়লারের অর্ডার এসেছে। ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালসের সঙ্গে গাটছড়া বাঁধার একটা কথা চলছে, কিন্তু পর্বতের মুষিক প্রসবই হবে ধরে নেওয়া যায়। এবিএলের কর্মচারীরা ধরেই নিয়েছেন যে চাকরির আয়ু আর মেরেকেটে পাঁচ বছর। অনেকেই ভি আর এস স্কিমের জন্য অপেক্ষা করছেন। রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের আশা খুবই সামান্য।
রজনী স্বভাবতই চিন্তাপ্রবণ। এই বাজারে দুই মেয়ের মা হওয়া যে কি জ্বালা। আগের বার যখন কারখানা বন্ধ ছিল, লোকের কাছে ধারদেনা করে সামলিয়েছেন, কারখানা খোলার পর সে দেনা শোধ করছেন এখনও। দীপকও সেরকম রাশভারী কোনো পদমর্যাদার নন, সামান্য একজন ফিটার। তিথি বিয়ের বয়স ছোঁবে আর চার পাঁচ বছরের মধ্যেই। দিতির এখনও নিশ্চিন্তি।দীপক সমাদ্দার আজকাল একটা কথা রজনীকে প্রায়ই শোনান, ”কাট ইওর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইওর ক্লথ।” রজনী ইংরাজী অতশত বোঝেন না, শুধু বোঝেন কোট বানানোর জন্য অন্ততঃ কাপড়টুকুর প্রয়োজন হয়, সেটুকুও যদি না থাকে! চিন্তার স্রোতগুলো কালো ঘূর্ণির মত ঘিরে ধরে রজনীকে।
“মা”। তিথি ডাকে। ”আজ বিকেলে মৌমিতা বৌদির কাছে পড়া বুঝতে যাব, কাল তোমায় বলতে ভুলে গেছি।”
মৌমিতা, সুপুরুষ অবনী মুখার্জীর বৌ। অবনী মুখার্জী এবিএলের ওর্য়াকস ম্যানেজার। বছর তিরিশ বয়স, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ভারতের দুতিন জায়গায় চাকরি করে অবশেষে দুর্গাপুর এবিএল টাউনশিপে আস্তানা গেঁড়েছেন। তবে দীপক সমাদ্দারের বাড়িতে ওনার একটাই পরিচয়, উনি প্রবীণ দীপকের নবীন বস। মৌমিতা কলকাতার বনেদী বংশের মেয়ে, প্রেসিডেন্সির ইংরেজি অনার্স। তিথি মৌমিতার কাছে পড়া বুঝতে যায়। দীপক আর যাই করুন,মেয়েদুটিকে কনভেন্টে পড়িয়েছেন। কারমেল কনভেন্টের ছাত্রী তিথি আর দিতি দুজনেই। দিতির সামনের বছর আইএসসি, খটমট ইংরাজীর ব্যাকরণ বুঝতে ভরসা তাই মৌমিতা।
বয়সে রজনী অনেকটাই বড় মৌমিতার থেকে, তাকে দিদি বলে ডাকে মৌমিতা। লজ্জায় কুঁকড়ে যেতেন রজনী। প্রভু ভৃত্য সম্পর্কের এই নতুন ঘরানায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন না প্রথম থেকেই। আড় ভাঙিয়েছে মৌমিতা। অবাক লাগে ভাবলে! সচ্ছ্বল পরিবারের দামী ফুলদানীর মত মেয়েটা কেমন সহজ সরল আন্তরিক। যখন রজনীর বৈঠকখানায় এসে বসে, কি দিয়ে কিভাবে ঢাকবেন দৈন্য বুঝতে পারেন না রজনী। ফার্ণিচার বলতে বিয়েতে পাওয়া এক বেতের সোফা। শতচ্ছিন্ন গদি সূঁচের ফোড়ে জোড়া। সেই জোড়াতালি ঢাকতে পুরানো টাওয়েল সযত্নে সিলিয়ে পরিয়ে রেখেছেন গদির গায়ে। মৌমিতা এসে স্বচ্ছন্দে তাতে পা মুড়ে বসে মুড়ি চানাচুর খায়, দিতি আর তিথির সাথে গল্প করে। রজনী জানেন, মৌমিতার উচ্ছ্বল চপল চেহারাটার পেছনে গভীর এক সংকট লুকানো আছে। বিয়ে হয়েছে ওদের বছর পাঁচেক, বয়সেও মৌমিতা অবনীর মাথায় মাথায়, তিরিশ ছুঁই ছুঁই। একটা সন্তানের জন্য মুখিয়ে আছে মৌমিতা। ডাক্তার আশা দিতে পাচ্ছেন না। সেদিন পেপারটা হাতে ধরে থরথর করে কাঁপছিল ও। সুভাষ মুখোপাধ্যায় নামে কোন এক ডাক্তারের অসাধ্য সাধনের গল্প বেরিয়েছিল। টেস্ট টিউব এর বাচ্চা! লুকিয়ে মুখ টিপে হেসেছিলেন রজনী। কালে কালে কত কি দেখবেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন মৌমিতাকে,
“এসব বুজরুকি মৌ,স্বাভাবিক ভাবে চেষ্টা করো।”
“আর কত দিন দিদি?”, অসহায় তাকিয়ে ছিল মেয়েটা।
“অবনীও আজকাল অধৈর্য হয়ে উঠছে। মাসিকের ডেটের আগে কাতরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মাসিক হল? আমার কান্না পায় দিদি। প্রতিরাতে ও যখন আমায় ছোঁয়, আমার মনে হয় আমি পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষায় যদি ফেল করি?! মনটা কাঁটা কাঁটা হয়ে যায়।”
রজনী নিশ্চুপ হয়ে যান। কারুর বাড়ি পালে পালে বাচ্চা আর কারুর বাড়ি এরকম ফাঁকা শূন্যি ঘর! ঠাকুরের এ কেমন বিচার।দিতিকেও তো একপ্রকার চাননি পেটে ধরতে, ওদের বাবার ছেলের শখ ছিল খুব তাই বাচ্চা নেওয়া। পরপর দুই মেয়ে হওয়াতে দীপক সমাদ্দারও হাল ছেড়েছেন। মৌমিতার কষ্টটা বুকে বাজে রজনীর, যদি সত্যিই কোনো উপায় থাকত। বর্দ্ধমানেশ্বর শিবের কাছে মানত করে সোমবার সোমবার উপবাস রাখলে ফল পাওয়া যাবেই, এমনটি কলোনীর বড়োবুড়োরা বলে। ভেবেছেন, এর পরের বার মৌমিতা বাড়ি এলে একবার বর্দ্ধমান ঘুরে আসার কথা বলবেন।
*****
একটা টানা গোঁগোঁ আওয়াজে দিতির ঘোর কাটে, ১৯৮৫ এর সেই আমকুড়ানো ভোরবেলা থেকে একলহমায় ২০১৮ এয় ফিরে আসে দিতি। আওয়াজটা আসছে শোওয়ার ঘর থেকে। কিছু দরকার মনে হয়,বেডের পাশের বেলটা খারাপ হয়েছে কাল থেকে। দরজাটা সন্তর্পণে খুলে উঁকি দেয় ঘরে।
“কিছু লাগবে?”
একটা জরাশীর্ণ শিরা ওঠা হাত ইশারা করে খোলা কাঁচের জানালার দিকে। মুখটায় নিদারুণ আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। নেহাত বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি নেই, নাহলে ঝড় বৃষ্টির আওয়াজেও শুয়ে থাকার মানুষ নন তিনি। দিতি বিনা বাক্যব্যয়ে জানালা বন্ধ করে ভারী পরদা টেনে দেয়। লাইট নিভিয়ে নাইট বাল্বটা অন করে ঘর ছাড়ে।
*****
“এত দেরী হল কেন ফিরতে? রোজ তো সাতটায় ফিরিস! আর বাইরে কে তোকে দিয়ে গেল? আবছা আবছা একটা হলদেটে শার্ট দেখতে পেলাম!”
“কে? ও কেউ না।অবনীদা এসেছিলো।”
“অবনী?! তোকে ছাড়তে এসেছিল?”
“হ্যাঁ, এত অবাক হওয়ার কি আছে? অন্ধকার হয়ে গেছে তাই।”, রজনীর প্রশ্নে বিরক্ত হয় তিথি।
“হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস। তোর বাবার আজ নাইট শিফ্ট, সাড়ে আটটায় তুই আসছিস না দেখে বেরিয়ে গেল। পরেরদিন থেকে সাতটায় ঢুকবি তিথি।”
মার অনুশাসন কানে যায় না তিথির। বাথরুমের ঠান্ডা জল গায়ে ঢালতে ঢালতে দেওয়ালে লাগানো ঝাপসা আয়নাটার দিকে তাকায় ও। চাঁপাকলির মত ফর্সা সরু আঙুলে ধীরে ধীরে ঠোঁটটাকে ছোঁয় ও। আলতো করে, ঠিক যেমন ভাবে অবনীর ঠোঁট দশমিনিট আগে ছুঁয়েছিল ওকে। আঙুল নেমে আসে গলায়, মণিকন্ঠে হাত বুলিয়ে দুই পূর্ণ সুডৌল মালভুমিতে। জলের ধারা শরীর বেয়ে নামে, শিহরিত হয় তিথি। ওর শরীর আজ পূর্ণতা পেতে চায়, কিন্তু অবনী বলেছে অপেক্ষা করো। মৌমিতাকে ডিভোর্স দেওয়া অবধি।
সন্তানহীনতার কারণে ডিভোর্স পাওয়াটা কতটা সহজ, জানে না তিথি। শুধু জানে চুম্বকের মত টানছে ওকে অবনী। শুরুটা হয়েছিল পড়তে গিয়েই। মৌমিতা বিদুষী হতে পারে, তার মত সুন্দরী নয়। খেয়াল করেছিল তিথি, ওকে লিখতে দিয়ে মৌমিতা রান্না ঘরে গেলে একজোড়া অতৃপ্ত চোখ ওকে গিলে খায়। দুএকবার চোখে চোখ মিললে চোখ সরানোর চেষ্টা করেছে তিথি, কিন্তু অসীম মুগ্ধতা ঠেলে সে দৃষ্টিকে অস্বীকার করার মত বুকের পাটা তিথির নেই। হাতে হাত রেখে তারপর কলোনীর বাইরে গাড়িতে ঘোরা শুরু। সাদা কন্টেসাটায় কালো কাঁচ উঠে যায় আজকাল ও উঠলে। তারপর এক আধ ঘন্টা কিভাবে কেটে যায় জানে না তিথি। অবনী জোর করে, বাহুর বেষ্টনে আরও শক্ত করে ধরতে চায় ওকে। কিন্তু স্কুলের পর এই ভাবে মার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে কিভাবে সম্ভব রোজরোজ?
বাথরুমের টিনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রজনী দরজায় ধাক্কা দিয়ে ধাতব শব্দ করেন.. তাড়াতাড়ি বাইরে এসো.. অবেলায় এতক্ষণ নাইলে ঠান্ডা লেগে যাবে, সামনে পরীক্ষা।
সেদিন গভীর রাতে দিতির ঘুম ভেঙে যায়.. ক্ষোভ, বিরক্তি, রাগ মেশানো গলায় তিথি আর মা কথা বলছে।
“যেটা তুমি করছ সেটা ঠিক নয় তিথি। লোকটার সংসার আছে। মৌমিতা আমাদের বাড়িতে আসে, কত সহজ সরল মেয়েটা! তুমি .. তুমি.” .কান্নায় অবরুদ্ধ হয়ে যায় রজনীর গলা।
“অবনীদা আমায় বিয়ে করবে মা। আমিও ওকেই বিয়ে করব। মৌমিতাবৌদি ওকে একটা বাচ্চা দিতে পারেনি, আমি দেব।” ফ্যাঁসফেসে গলায় তিথি বলে ওঠে।
একরাতে দিতির চেনাজানা দিদিভাই থেকে তিথি অন্য নারী হয়ে ওঠে, এ নারীকে দিতি চেনে না। ১২ বছরের দিতির সামনে নিষিদ্ধ এক জগতের দরজা খুলে যায়। দিতির শরীরে নারীত্ব জাগেনি, তবে ক্লাসের কিছু বন্ধুদের যে বর বৌ শব্দযুগল নিয়ে আলোচনার আসর বসে সেটা ওর কানে এসেছে। বিয়ে করার সময়ে বুঝি সবই এরকম পাল্টে যায়? এই তো কদিন আগেও দিদি আর ও শালবনের ভিতর দিয়ে সাইকেল চালিয়েছে একসাথে, এমএ এমসির মোড়টা অবধি রেস করেছে, সুভাষ লাইব্রেরির সামনের আচারয়ালাটার কাছ থেকে ৫০ পয়সার কুলমাখা ভাগাভাগি করে খেয়েছে, মা অসুস্থ হলে দুইবোন ভাতে ভাত বানিয়ে খেয়েছে। তেলে শুকনোলঙ্কা আর রসুন ফোড়ন দিয়ে ভেজে সিদ্ধ আলুমাখা বানিয়েছে, মনে পড়লে এখনও ওর জিভে জল আসে, দিদিরও কি আসে? দিদিকে ছাড়া কি করবে দিতি? বাচ্চার কথা বলছিল দিদিভাই, অন্য একটা বাচ্চা আর অবনীদা মিলে দিদিভাইকে ভাগ করে নেবে? মৌমিতাবৌদি তখন কোথায় থাকবে? ওদের অবশ্য অনেক বড় কোয়ার্টার। কলকাতাতেও অনেক বড় বাড়ি শুনেছে দিতি। বুঝতে পারে না দিতি। মাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস হয় না। রজনী চুপ করে থম মেরে গেছেন। নিয়মমত খাবারদাবার সবই দেন, কিন্তু মুখে কথা বড় কম। এরকম থম মারা দুপুর আগেও দেখেছে দিতি, কালবৈশাখী ঝড়ের ঠিক আগে।
*****
তিনমাস কেটে যায়। কারমেল কনভেন্টের সেদিন অ্যানুয়াল ডে। দিতিদের ক্লাস প্লে করছে, মার্চেন্ট অফ ভেনিস। তিথি স্কুলে আসেনি আজ, সকাল থেকে শরীর খারাপ বলে শুয়ে আছে। রজনী বলেছিলেন নিতে আসবেন। ফাংশন শেষ হতে আর বেশি দেরী নেই, এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে হাজারো গার্জিয়ানের ভিড়ে মাকে খোঁজার চেষ্টা করে দিতি, কোথাও দেখতে পায়না। ফাংশন একসময় শেষ হয়, ক্লাসের বন্ধুরা বাবামার সাথে হাত ধরাধরি করে বাড়ি ফেরে। কিছুক্ষণ স্কুল গেটের সামনে অর্থহীন অপেক্ষা করে দিতি বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
কোয়ার্টারের গেট তালাবন্ধ, অবাক হয় দিতি। আশেপাশেও কাউকে দেখতে পায় না। অবশেষে কর্মকার কাকুর বাড়িতে বেল বাজায় দিতি। দরজা খোলেন কর্মকার।
“মারা কোথায় গেছে জানো কাকু?”
“অবনী মুখার্জির বাড়ি যা দিতি, তাড়াতাড়ি।সবাই ওখানেই গেছে।”
সাইকেলের প্যাডলে চাপ দেয় দিতি। চারটে মোড় পরপর ঘুরতেই অবনী মুখার্জীর বাংলো। বাইরে প্রচুর লোকের ভিড়, পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভিড় ঠেলে বারান্দায় ওঠে দিতি। দূরে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিতি। অবনী মাথা নীচু করে সোফায় বসে আছে, তিথি রজনীর পাশে দাঁড়িয়ে। কারুর অভিব্যক্তি ঠিক বুঝতে পারেনা দিতি। ঘরের ভিতর শুধু সবাই অদ্ভুত নিশ্চুপ।
একটা স্ট্রেচারে করে একটা মুখ ঢাকা শরীর বয়ে নিয়ে বাইরে বেরোয় চারজন উর্দিধারী। অবনী উঠে দাঁড়ায়, একবার স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়ায়, পরক্ষণেই হাত গুটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সোফায় বসে পড়ে। পুলিশ অফিসার একটা লাল কমলা কাপড়ের টুকরো এনে অবনীকে জিজ্ঞাসা করেন, “চেনেন এটা অবনীবাবু?”
মাথা উঁচু করে কাপড়টার দিকে এক ঝলক তাকায় অবনী। মুখে তীব্র ঘৃণা আর অবিশ্বাস ফুটে ওঠে।
“সেই তান্ত্রিকটা। মৌকে বারণ করেছি অনেকবার, কান্নায় রুদ্ধ হয়ে যায় গলা।”
“কোন তান্ত্রিক অবনীবাবু? খুলে বলুন।”
“একজন আসত ওর কাছে। বাচ্চা হওয়ার জন্য টোটকা দিত। সেই লোকটাই..সেই লোকটাই খুন করেছে আমার বৌকে অফিসার।”
“আপাতদৃষ্টিতে এটা হোমিসাইড নয়, সুইসাইড মনে হচ্ছে অবনীবাবু। আমরা পোস্টমর্টেম করব।”
মৌমিতার বডি নিয়ে স্ট্রেচার বেরোয় বারান্দায়। ঠিক তক্ষুণি স্তব্ধ প্রকৃতির বুক চিরে দামাল হাওয়া বইতে শুরু হয়। কালো আকাশটায় চিড়িক দিয়ে বিজলি চমকায়। খড়কুটো, শুকনো শালপাতারা প্রবল আক্রোশে পাক খেতে খেতে এ বাই ফরটিটু বাংলোর সামনে এসে ঢুঁ মারে।
*****
ওই আবার, আবার কোথাও একটা বাজ পড়ল। অন্ধকার ঘরটা ক্ষণিকের আলোতে সচকিত হয়ে উঠল। দিতি বিছানা ছেড়ে আলমারিটার দিকে এগোয়। কপাট খুলে নিস্তব্ধে ড্রয়ার থেকে বার করে গোপনে সঞ্চিত একটা ছবি। ১৯৮৫ এর কোনো এক দুপুর বেলায় পাওয়া সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো এক ভয়ংকরী মূর্তি, লোলজ্বিহা, করালনয়না, ঘোর তামসী। স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিল সেদিন। বাগানবিলাসের পাশে সাইকেল দাঁড় করিয়ে দিতি মার খোঁজে হানা দিয়েছিল ঘরে। শোওয়ার ঘরের পাল্লা ভেজানো, কপাটের ফাঁক দিয়ে হাল্কা আলো আসছে। মা বাবার বিছানায় বসা এক বিকটদর্শন মানুষ। কুঞ্চিত কেশ, লাল টিকায় সজ্জিত মুখটা ভালো করে বোঝা যায় না। উর্দ্ধাঙ্গ অনাবৃত, রুদ্রাক্ষের এক মালা ঝুলছে নাভি অবধি। তার পায়ের কাছে রজনী বসে, গলার সোনার চেন খুলে দিচ্ছেন কাপালিককে।
“কিছু একটা করুন প্রভু। আমার মেয়েটার বড় জ্বালা। মা হয়ে সহ্য করা যায় না।”
“একে পুজো কর, ফল পাবি। কোথায় থাকে,ঠিকানাটা বল।”
সোনালী ফ্রেমের ছবিটাকে সেই প্রথম দেখে দিতি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটায় হোমিসাইডের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, পাওয়া গিয়েছিল ফোর্সড সেস্কুয়াল ইন্টারকোর্সের প্রমাণ, সাদা বাংলায় রেপ। লজ্জায় আত্মঘাতী হয়েছিল মৌমিতা। সেদিন বাড়ি ফিরে মার ড্রয়ার থেকে ছবিটা সরিয়ে ফেলেছিল দিতি। ছবিটাকে আজকাল ভালো লাগতে শুরু করেছে দিতির। করালবদনীর হাসিতে ভয়ের বদলে কি যেন একটা অতলের আহ্বান। নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায় আজকাল দিতি, গত তেত্রিশ বছরে যেটা পারেনি। কিন্তু পাশের ঘরে শয্যাশায়ী ওই বৃদ্ধা পেরেছেন কি? মনে হয় না! এখনও শিশুর মত ঝড় বাদল দেখলে এত ভয় পান কেন?! সেদিনের সেই অভিশপ্ত দিনটার মত! সবার আড়ালে লুকিয়ে মার চোখে আতঙ্ক দেখেছিল দিতি, আর কেউ পায় নি।
আবারও বিদ্যুত চমকায়।তিথি আর অবনীর বিয়ের ছবিটায় আলো পড়ে ঝলসায়। বন্ধ ঘরের আগল খুলে দিতি এগোয় আপন অন্তঃপুরে। একাধার জল আছে সেথায়, তাতে নাইলে ভুলে থাকা যায়। সুইসাইড নয়,ওটা হোমিসাইড ছিল মিঃ অফিসার।সব প্রমাণ কি পোস্টমর্টেমে থাকে???
~~~^^^~~~
লেখিকা ~ পিয়া সরকার