
পাঠকের চোখে – অলাতচক্র
বই ~ #অলাতচক্র
লেখক ~ #তারাদাস_বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক ~ #মিত্র_ও_ঘোষ
এই বইয়ের রিভিউ দেওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। শুধু প্রতিক্রিয়া জানালে আমার মতো অনেক পাঠক, যারা অনেকদিন ধরেই এটা পড়ব পড়ব ভেবেও সময় পাননি, তাদের একটু সাহায্য হতে পারে এই প্রতিক্রিয়া লিখছি।
গতবছর “তারানাথ তান্ত্রিক” সমগ্র পড়ার পর থেকে আমি লেখকের একেবারে জাবরা ফ্যান হয়ে গেছি। বুক ফার্ম থেকে প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “ভয় সমগ্র” তে ওঁর লেখা তারানাথের প্রথম আর দ্বিতীয় গল্প পড়েও মনে হয়েছিল যে পুত্র তারাদাসের হাতে তারানাথ যেন আরও স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। বেশ কয়েকটা গল্প রাতে পড়ার পর লেপমুড়ি দিয়ে শুতে হয়েছিল। প্রায় একদিন ধরে ছিল সেই গল্পের রেশ। গায়ে কাঁটা দেওয়া লেখা যাকে বলে, তারাদাস বাবুর তারানাথ তান্ত্রিক ঠিক সেই গোত্রের আমার মনে হয়। নিখুঁত ডিটেলিং-এর সাথে ভয়ের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করেন যে এত বছর পরে আজকের দিনেও গল্পগুলো সমানভাবে ভয় লাগিয়ে দিতে পারে। বিশ্বাস না হলে একবার পড়ে দেখতে পারেন ওই সমগ্রটা যাঁরা পড়েননি এখনও।
তাই স্বাভাবিকভাবেই তারানাথকে নিয়ে তারাদাস বাবুর লেখা “অলাতচক্র” উপন্যাস নিয়ে লোভ বেড়েই যাচ্ছিল। অবশেষে ধরলাম, এবং একদিনের মধ্যেই শেষ করলাম। অবশ্যই দারুণ লাগল, কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হল আগে পড়া “তারানাথ তান্ত্রিক” সমগ্রটাই সেরা!
মট লেনের বাসিন্দা তারানাথের বাড়িতে আড্ডা মারতে যান লেখক ও তাঁর বন্ধু কিশোরী সেন। সেখানেই জমে ওঠে গল্পের আসর। তারানাথ তাঁর গল্পগুলোকে “গল্প” বলতে চান না, বরং সত্যিকারের অভিজ্ঞতা হিসেবেই এমনভাবে বলেন যে লেখক ও কিশোরীর সাথে আমরাও ঢুকে যাই প্রেক্ষাপটে। বাবার মতোই প্রকৃতির বর্ণনায় তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশ সুদক্ষ। সন্ধে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাঁখের আওয়াজ, ঝিঁঝিঁর ডাক যেন কানে শুনতে পাই ওঁর লেখা পড়ে।
“অলাতচক্র”-কে উপন্যাস বললেও লেখক এখানে আশ্রয় নিয়েছেন কতগুলি ছোট ছোট গল্পের ওপর, যেগুলি উপন্যাসের মূল পটভূমির সাথে জুড়ে থাকলেও নিজেরাই এক একেকটা স্বাধীন গল্প। তাই পড়তে পড়তেই একটা সুন্দর আমেজ চলে আসে। একটার পর একটা অভিজ্ঞতা পড়ে যেতে ইচ্ছে করে, রাখতে মন চায় না।
এই উপন্যাসে তারানাথের শৈশব আর তাঁর তন্ত্রবিদ্যা শিক্ষার গল্প আরেকবার জানতে পারলাম, তবে একটু অন্য দিক দিয়ে। মাতুপাগলী বা মধুসুন্দরী দেবীর দর্শন পাওয়া আর সান্নিধ্যলাভ নিয়ে তারানাথ খুব বেশি গভীরে না ঢুকলেও অপর এক চরিত্রের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, যাকে মূল উপন্যাসের সমস্ত গল্পের যোগসূত্র বলা যায় অনায়াসেই। নাম তাঁর অমরজীবন। কখনও সে মৃত্যুঞ্জয়। হাতে ধরে থাকেন একটা গাছের ভাঙা ডাল। কিন্তু তাঁর অতিলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে। তারানাথের জীবনে অমরজীবন যে কতটা প্রভাব বিস্তার করে আছেন, তার পরিচয় পাবেন এই বইতেই।
জমিদার দেবদর্শন মুখার্জির বিশাল অট্টালিকা, সেখানকার দুর্গাপুজা আর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আড়ম্বর আর জাঁকজমক শুনেই যেন মন চলে যায় সেই জায়গায়। রহস্যও ঘনিয়ে ওঠে একজন অতিথির দেওয়া একটা মন্ত্র বা ধাঁধাকে কেন্দ্র করে। তবে গল্প এখানেই থেমে না থেকে এগিয়ে চলে লেখকের কর্মজীবনের এক অভিজ্ঞতায়, যেখানে পটভূমি কলকাতার মট লেন ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় বিহার-মধ্যপ্রদেশের সীমান্তবর্তী একটা পাহাড়ঘেরা জায়গায়। প্রকৃতির মোহময়ী রূপের আড়ালেও সেখানে লুকিয়ে থাকে এক অমোঘ শক্তি, যা শুভ না অশুভ, আমরা জানতে পারি না। কিন্তু একের পর এক পাখি মারা যাওয়ার ঘটনায় ভয়াবহতা মায়াজাল বিস্তার করে তারাদাস বাবুর অপূর্ব লেখনীতে।
এই বই অবশ্যই একবার পড়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়। এতদিন দেরি করে পড়লাম বলে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছে। তবে যদি পরামর্শ চান, তাহলে বলব আগে “অলাতচক্র” পড়ে নিয়ে তারপর “তারানাথ তান্ত্রিক” সমগ্র পড়ুন। উলটো ক্রমে পড়ে আমি কিছুটা হলেও আশাহত হয়েছি। তার কারণ শুধুমাত্র লেখকের লেখনী থেকে অগাধ প্রত্যাশা।
সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি তারিণীখুড়োর পর যদি কোনও বৈঠকী চালে গল্প-বলিয়ে চরিত্রের প্রেমে পড়ে থাকি, তাহলে তিনি অবশ্যই “তারানাথ তান্ত্রিক”-এর ছদ্মবেশে স্বয়ং তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
?
© #অরিজিৎ_গাঙ্গুলি