
অপেক্ষা
মানুষের জীবনে এক একটা ঘটনা দৈবাৎ এমন ঘটে যায়, যা দুঃস্বপ্নের মতই সারাজীবন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। অভিশাপের মতই তার পিছু ছাড়তে পারে না সেই ঘটনাগুলো, বারেবারেই যেন তাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে তার উচিৎ স্থানটা ঠিক কোথায়।
পাঞ্জাবি মাঠের কাছে এসে পা দুটো আপনা আপনিই থেমে গেল তার। চারিদিকে অন্ধকার তখনও, সূর্য উঠতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি আছে। মাঠের এক ধারে লাগানো গোলপোস্টের ওপর, বড় রাস্তার দুই ধারে চৌকিদার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভেপার ল্যাম্পের আলো এসে পড়ছে, আর সেই আলো ঠিকরে গিয়ে পড়ছে মাঠের ঠিক পাশেই থাকা বড় ডোবাটার ওপর। এক কালে হয়ত পুকুরের মর্যাদাই পেত সে, এখন ক্রমাগত মাটি, বালি, রাস্তার লাগোয়া বাড়িগুলোর দৈনন্দিন ব্যবহারের পর পড়ে থাকা আঁস্তাকুড় জমতে জমতে আজ সেটা ডোবায় পর্যবসিত হয়েছে। হাঁটুজল গভীরতায় গজিয়ে উঠেছে বিভিন্ন রকমের আগাছা আর শ্যাওলা।
কালো, মিশমিশে এই অন্ধকারের মধ্যেও বোঝা যায়, সে তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থানু হয়ে, যেন তার চারপাশের প্রকৃতিকে জরিপ করে নিচ্ছে সে। পরবর্তী সিদ্ধান্তই হোক কি পদক্ষেপ, তার সামনে যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘন অন্ধকার।
আগন্তুক দীর্ঘ, আর কৃশকায়। গাঢ়, জলপাই রঙের জ্যাকেট আর কালো জিন্সের জন্য এই অন্ধকারের মধ্যে থেকে তাকে আলাদা করা দুঃসাধ্য। হয়ত, অন্ধকারের মধ্যে থেকেই সে উঠে এসেছে, তাই সে আর অন্ধকার থেকে আলাদা হতে চায় না।
এখনও মনে পড়ে তার, ঘাড় তুলতেই… সারা শরীর একটা অকল্পনীয় আতঙ্কে হিম হয়ে যাওয়া।
অন্ধকার ঘর। অনভ্যস্ত হাতে দরজাটা সরিয়ে ঘরের মধ্যে খাটটা খোঁজার চেষ্টা। খাটের পাশেই সুইচবোর্ডটা। লাইটটা জ্বালানোর জন্য সুইচবোর্ড খুঁজতে খুঁজতেই মাথায় একটা আলতো ছোঁয়া লাগে। কিসের ছোঁয়া লাগে তার মাথায়, বোঝার আগেই তার হাতটা সুইচবোর্ডের নাগাল পেয়ে যায়। তারপর দুবার ভুল সুইচ টেপার পর লাইটটা জ্বালায় সে।
দুটো বরফের মত ঠাণ্ডা, শক্ত, আলতায় রাঙানো পা তার মাথার ওপরে ঝুলছে। পায়ের মালিক তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে বিস্ফারিত, মৌন এক দৃষ্টিতে। তখনও শাড়ির আঁচলটা পুরো সরে যায়নি। তখনও চোখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে আসা জলের দাগটা শুকিয়ে যায়নি।
এখনও দৃশ্যটা ভাবলে বুকের হৃৎস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তার, মনে হয় ভেতর থেকে একসাথে হাজারটা চিৎকার উঠে আসছে মুখ দিয়ে বেরোবে বলে। পুরো দেহটাই ঝুলছে সিলিং ফ্যান থেকে। গলায় শাড়ির ফাঁসটা শক্ত হয়ে চেপে বসেছে। ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে ঝোলা। জিভটা বেরিয়ে এসেছে অল্প।
সে জানে ঘরটার রং গোলাপি। বহুবার সে ভিডিও কলে দেখেছে সেই ঘরের আসবাবপত্রের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। বহুবার সে দেখেছে তাকে, তার পোষা বেড়ালগুলোর সাথে খেলা করতে।
সে এখনও চোখ বুজলে সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখতে পায়।
এই যে সেই বাড়ি। ঐ সেই দোতলার ঘর। আগে যখনই সে এখানে এসেছে, জানালাগুলো খোলা থাকতে দেখেছে, যেভাবে লালাভ, দুর্দমনীয় বসন্তকে, তার দুগ্ধসফেন অঙ্গে মেখে নেওয়ার জন্য কুয়াশার সাদা শাড়িতে নিজেকে ঢেকে শীত বসে থাকে অপেক্ষায়। ঐ দুই জানালার ওপার থেকে একজোড়া চোখ যে তার জন্যই অপেক্ষা করছে সে জানত।
ভালোবাসায় সব দিন সমান যায় না। কোনোদিন রাগে দুজনেই দুজনের মুখ দেখে না। কোনোদিন অনুরাগে কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। এরকমই একদিন সে, তার সাথে ঝামেলা করেছিল। কি একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে সামান্য মতান্তর থেকেই কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছিল। কিন্তু তুষের আগুন যে দপ করে জ্বলে ওঠে, সেই প্রবাদবাক্যটা সে বোধহয় ভুলে গিয়েছিল। তাই রাগের মাথায় সে যে ভুলটা করেছিল, তার থেকে বড় ভুল হয়ত সে আর জীবনে করেনি।
মতান্তরের মধ্যেই রাগের মাথায় তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, “আমি জীবনে তোর মুখ দেখতে চাই না। তোর মুখ দেখার থেকে না দেখা ভাল।“
বজ্রনির্ঘোষের মত সেই কথা আছড়ে পড়েছিল, তার সামনের মানুষটির কানে। কিন্তু, সে তখন একটি কথাও বলেনি প্রত্যুত্তরে। তার চোখের দৃষ্টি এক মুহূর্তে যেন নিভে গিয়েছিল। সেও খেয়াল করেনি তার এই দ্রুত পরিবর্তনটা। অন্ধ রাগের বহ্নি তার চোখের সামনে সব কিছুকে লাল রঙে রাঙ্গিয়ে দিয়েছিল।
শুধু সে মাথাটা নামিয়ে নিয়েছিল তার সামনে।
পরেরদিন সকালেই সে হাজির হয়েছিল তার বাড়ির দোরগোড়ায়। তার আগের রাতটা সে কোনদিন ভুলতে পারবে না। এক মুহূর্তের জন্যও সে তার দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সারারাত নিজেকে দুষেছে, যে এত বড় কথাটা সে কীভাবে তাকে বলতে পারল? এতটা অমানুষ সে কবে থেকে হয়ে উঠল? সে ঠিক করেছিল, সে পা ধরে ক্ষমা চাইবে মানুষটার।
সেদিন ঘটনাচক্রে ছিল দোলপূর্ণিমা। রঙের উৎসব। ভালোবাসার উৎসব।
তার ঘরে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। তার মা বাবাও তাকে মেনে নিয়েছিলেন। তাই ঘরের দরজায় যখন সে টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিল, সে বিন্দুমাত্র বাধা পায়নি। তার “কাকিমা” তাকে বলেছিলেন, একবার তাঁর মেয়েকে ডেকে দিতে। এত বেলা অবধি তো সে সাধারণত ঘুমোয় না।
সে তাই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিল। অন্ধকার ঘর, অপরিচিত সময়। আর ঠিক তারপরই…
নিঃশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসে তার। তীব্র মোচড়ে তার বুকের ভেতরে একটা চাপা কষ্ট শুরু হয়ে যায়।
কীসে সে তৃপ্তি পেত? যদি সে তার নামে শেষ বেলায় কোনও অনুযোগ রেখে যেত? শেষ কোনও অতৃপ্ত অভিযোগ, কিংবা একটা বাঁধভাঙ্গা অভিমানভরা ছেঁড়া চিরকুট? যার দরুন সারাজীবন তাকে কাটাতে হত চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে, যেখানে শুধুমাত্র দশ বাই দশ বাই বারো একটা কুঠুরিতে অন্ধকার, ইদুরের কিচকিচ শব্দ, পাশের কুঠুরির কয়েদির অশ্রাব্য গালাগালির ভিড় আর চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর এক পরিবেশে তার পাপস্খালন চলত আজীবন ধরে?
হয়ত তাই। কিন্তু, তার ভালোবাসার মানুষটি সেদিক থেকেও তাকে কষ্ট দিতে চায়নি। একটিও অভিযোগ সে রাখেনি তার নামে। একটি বারের জন্যও সে আঙুল তুলে দেখায়নি তাকে।
কিন্তু রাস্তায় পা দিলেই তার মনে হতে থাকে, অদৃশ্য হাজার হাজার আঙুলের দল, তার দিকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। তারা নিস্তব্ধ, নির্বাক, কিন্তু ক্ষমাশীল নয়। মহাকালের দরবারে তারাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবে, তারাই তার ভাগ্যনিয়ন্তা আর হন্তার ভূমিকা নেবে।
তার কীসে মুক্তি, সে এখনও জানে না। জানে না বলেই, এখনও সে এই বাড়িটার সামনে দিনের আলোয় দাঁড়াতে পারে না। যতবারই সে নিজেকে জিজ্ঞেস করতে যায়, ততবারই সে উত্তর পায়, “না , এই ব্যাপারে আর কোনও আলোচনা নয়।“
পাথরের মত প্রাণহীন অথচ দৃঢ় একটা কণ্ঠস্বরে তার বিবেক তাকে উত্তর দেয়। “যে চলে গেছে, তাকে নিয়ে আর আলোচনা করে কি লাভ? সে কি আর ফিরবে?“
তবু সে ফিরে আসে। বারবার। প্রতিবছর। এই বিশেষ দিনটায়। এই বিশেষ সময়টায়।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টে এই সময়টাই সুনীতার চলে যাওয়ার সময় হিসাবে ধার্য করা হয়েছিল। সে ঠিক তার মিনিট দশেক আগেই এই মাঠে এসে দাঁড়ায়। দেরি হওয়াটা সুনীতা কোনও কালেই পছন্দ করত না।
তার বাম হাতটা অজান্তেই তার পকেটে চলে যায়। প্লাস্টিকের প্যাকেটটা তার আঙুলের ফাঁকে স্থান নিয়ে নেয়।
সুনীতার মা, বাবা দুজনেই এখানের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছেন। এখানে থাকতে হলে স্মৃতির তীব্র দহন সহ্য করার মত যে শক্তি দরকার, তা যে ওনাদের নেই।
সে এক এক পা করে এগিয়ে আসে। ক্রমশ বড়, তিনতলা বাড়িটা তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়।
বাড়িটা বহুদিন হল তালাবন্ধ। বাড়ির জানালা, দরজাগুলো যেন বহুদিনের জমা কোনও এক চাপা কান্নাকে প্রবল আবেগে ধরে রেখেছে তার জঠরের মধ্যে। লেটারবক্সের ডালাটার ওপর ধুলোর মোটা প্রলেপ পড়েছে।
সে আর দেরি না করে প্যাকেটটা বার করে। একমাত্র সেই জানে, যে দোতলার জানালাটা এখন খোলা থাকে। বাড়ির আর অন্য জানালাগুলো শক্ত করে আঁটা থাকলেও এই জানালাটা কোন এক অজানা মন্ত্রবলে খুলে যায় এই দিনটাতেই। নাহ, ঘরে কোনও আলো জ্বলছে না। জানালাটার দুটো পাল্লাই হাট করে খোলা।
হাতটা এক পাক ঘুরিয়েই সে প্যাকেটটা ছুঁড়ে দেয় ঘরের মধ্যে। জানালার গ্রিল গলে অব্যর্থ লক্ষ্যে ঢুকে যায় প্যাকেটটা। মৃদু শব্দ হয় একটা। প্যাকেটটা তার মানে ঘরের মেঝেতে গিয়েই পড়েছে।
মৃদু একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় সে চমকে ওঠে একপলকের জন্য। নিয়নের আলো তার মুখে ঐ এক মুহূর্তের জন্যই এসে পড়ে। দেখা যায়, তার চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু টলমল করছে। ঘরের দিকে তাকিয়ে সে বিড়বিড় করে কি বলে ওঠে বোঝা যায় না।
শুধু ঐ অস্পষ্ট কথার ভিড়ে, তার উদাত্ত, গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলা কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যায়, “মন্ত্রস্পর্শস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ আগমাপায়িনি অনিত্যাস্তান্তিতিক্ষ্য ভারত।“
গাল বেয়ে গড়িয়ে আসে সেই অশ্রুবিন্দুগুলো। আগন্তুক আজও নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি।
পিছন ফিরে সে দ্রুত হাঁটতে থাকে। পূর্বাকাশে সূর্যের অরুণ আলো ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে। ভোরের আগের আকাশের অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। আগন্তুককে আবার মিলিয়ে যেতে হবে ছায়ায়।
আগন্তুক বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একবার পিছন ফিরে তাকায়। এত দূর থেকেও তার স্পষ্ট মনে হয়, জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে তার মতই এক দীর্ঘ ছায়ামূর্তি। তার গালে এখনও তার দেওয়া প্যাকেটের লাল আবিরটা শোভা পাচ্ছে। সূর্যের আলোয় সেই ছায়ামূর্তির মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।
আগন্তুক চাপা কণ্ঠস্বরে স্বগতোক্তি করে উঠল, “ভাল থাকিস।“
আজ যে দোল। একটু পরেই রাস্তায় রাস্তায় ভালোবাসার উৎসব শুরু হয়ে যাবে। পিচের রাস্তায় পড়ে থাকবে হলুদ, সবুজ, কমলা, লাল রঙের আবিরের গুঁড়ো। রাগে অনুরাগে ফাগুনের এই দিনটা হয়ে উঠবে মোহময়ী। শিশু থেকে বৃদ্ধ, যুবক থেকে যুবতী, ধর্মবর্ণজাতিনির্বিশেষে কেউ বাদ যাবে না আজকের এই দিনটায়।
শুধু এই দুজনের আবির খেলা শুরু হতে এখনও বহু, বহু দিন বাকি, এখনও তাদের অপেক্ষা করতে হবে অনেকটা সময়ের জন্য।
যতদিন না তাদের মধ্যের আলোকবর্ষের থেকেও দীর্ঘতর দূরত্বটা একটা হৃৎস্পন্দনের থেকেও কমে আসে…
?
✍ স্পন্দন চৌধুরি