দুধের বোতল

Friends, বাংলা

”ধ্যাত ধ্যাত, ওসব ব্রেস্টফিড টিড করাতে পারব না।” হাসতে হাসতে ফোনে কথা বলছে ট্রেনে আমার পাশেই বসা এক তরুণী । কোলে মাস তিনেকের একটা বাচ্চা ।তরুণীর ওপাশে ওনার স্বামী।

”বোতলের দুধ,আবার কী!” আবার হাসলেন ফোনের অপর প্রান্তের কথা শুনে।

”আরে অনেক হ্যাপা। ট্রেনে বাসে বারবার দুধ দেব কী করে লোকের সামনে?আর, এরপর অভ্যাস হয়ে গেলে ছাড়বেও না। আমি তাই প্রথম থেকেই দিচ্ছি না।”

”ডাক্তার? ডাক্তার তো বলেই খালাস। আরে রাতে জেগে থাকব নাকি পুরো! আমার দিদি সেই সারারাত জেগে থাকত,জানিস?”

অপর পারের উত্তর জানা যাচ্ছে না,তবে পাশে বসা তরুণী দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে বাচ্চাকে বুকের দুধ কিছুতেই দেবে না। তাই রয়েছে বোতল, রয়েছে কৃত্রিম দুধের গুড়ো, রয়েছে জল। আর বাচ্চাটা ট্যাঁ ট্যাঁ করলেই, বোতল ধরিয়ে দিচ্ছেন মুখে। বাচ্চাটাও চুপ করে যাচ্ছে। কী এক শান্তির বাতাবরণ!

কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলি, আউটডোরে এসেছেন এক তরুণী। গ্রাম্য এবং দরিদ্র পরিবারের। তরুণীর কোলে একটা মাস পাঁচেকের বাচ্চা। বাচ্চাটার মুখটা তরুণীর স্তনে গোঁজা, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। বাইরের জগত নিয়ে ন্যুনতম বিচলিত নয়।

”বাচ্চার বয়স কত গো?” জিজ্ঞেস করলাম।

”পাঁচ মাস হতে আসল স্যার।” তরুণী বলল।

”শুধু বুকের দুধই খাওয়াচ্ছো তো?”

‘তাছাড়া আর কী পারব স্যার? ভগবান এটাই তো দিয়েছেন, এটাতো খাওয়াবই। আমরা গরীব মানুষ, বোতলের দুধ তো পারিনা কিনতে। ”

”আরে ভাল করছ তো। ছমাস অবধি বুকের দুধই তো খাওয়াবে শুধু। গরীব বড়লোক বলে কিছু নয়,সবার এটাই করা উচিৎ। ”

আমার পাশে বসা তরুণীর কথা শুনে ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল আবার। মাতৃদুগ্ধ! প্রকৃতির আশ্চর্যকর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে এটা একটা। কিন্তু বড্ড ঝামেলা যে! রাতঘুমের দফারফা, বাচ্চার বদভ্যাস, যেখানে সেখানে দুধ খাওয়ানো। তাই নাই বা খেলো বুকের দুধ।পয়সা থাকলে আরো কত ভাল খাবার খাওয়ানো যায়।

সত্যি যায়। অনেক দামী খাবার খাওয়ানোই যায়। কিন্তু, মাতৃদুধের বিকল্প যে পাওয়া যায় না!খোদার উপর কি খবরদারি করা যায়?

ইচ্ছে করছিল বলি, আপনাকে দেখে তো শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। আপনি জানেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাচ্চাকে ছমাস বয়স অবধি শুধু বুকের দুধই খাওয়াতে বলেছে,আর কিছুই নয়?

হ্যাঁ,আমি জানি,আপনি এ সংবাদ জানেন। আপনার মতো আরো অনেকেই এ তথ্য জানে, কিন্তু আপনি যে যে সমস্যার ধুয়ো তুলে বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছেন না,তারাও অনেকে সেই সেই কারণেই দেয় না বুকের দুধ।

হ্যাঁ,কষ্ট হয়।খুব কষ্ট হয়। কোনও পুরুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় এই কষ্ট। কিন্তু বাচ্চাটার তো প্রাপ্য। শুধু নিজের কষ্ট হয় বলে ওকেও বঞ্চিত করব?

ইচ্ছে করছিল, বলে ফেলি,
বুকের দুধে বাচ্চার শুধু পেটই ভরে তাই নয়, মনও যে ভরে। বাচ্চা আর মায়ের দুজনেরই। মায়ের স্পর্শে, মাকে দেখে বাচ্চার যে মানসিক নির্ভরতা তৈরী হয় তার কোনও তুলনা নেই। বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়।

ওনাকে বলতে পারলাম না, কিন্তু আউটডোর টেবিলে বসে ওই তরুনীকে বলেছিলাম।

”কত উপকার জানা আছে? বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে, ঘন ঘন ঠান্ডা লাগবে না, মাঝে মাঝেই পেট খারাপ হবে না, বুদ্ধি বিকাশ বেশি হবে। বুকের দুধের মতো সহজ পাচ্য আর কিছুই নেই বাচ্চার জন্য। ” মন দিয়ে শুনছিল ওই তরুণী।” এই যে মোটা হয়ে যায় বাচ্চারা, সুগারের রোগ হয়, এগুলো হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় যদি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যায়। ” কথা শুনে মাথা নাড়িয়েছিল ওই গ্রাম্য তরুণী।

পাশে বসা তরুণীকে বলতে ইচ্ছে করছিল, ছমাস কী একবছর কী আরো কয়েকমাস বেশি পারবেন না কষ্ট সহ্য করতে?নিজের বাচ্চার ভবিষ্যতের জন্য।

আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, চেম্বারে আসা পরিচিত, এক সদ্য মা হওয়া তরুণীর কথা।

‘আমার তো দুধ হচ্ছে না, কী করব?’

”আরও আরও বুকের দুধ খাওয়াবেন। ভালবেসে খাওয়াবেন, ঘন ঘন। স্তনবৃন্ত বাচ্চার মুখে দিয়ে রাখবেন, আস্তে আস্তে হবে দুধ। আসলে বুকের দুধ হওয়া, দুটো হরমোনের খেলা। প্রোল্যাক্টিন আর অক্সিটোসিন। যত স্নেহের বাঁধনে বাঁধা পড়া যাবে বাচ্চার সাথে,যত মায়াডোরে ধরা পড়বেন, যত স্তন পান করানো যাবে, মাতৃদুগ্ধের পরিমাণ তত বাড়বে!

”বুকের দুধ কি খাওয়াতেই হবে?বদলে অন্যকিছু চলবে না?” তরুনীটির এই প্রশ্নে হেসেছিলাম তাকিয়ে।
”মাথার দিব্যি কেউ দেয় নি। তবে আপনার বাচ্চার জন্য এর চেয়ে ভাল আর কিছুই হয় না। আর, আপনার জন্যও।”

”আমার জন্য?কেন?”

”আমরা ভাবি, বুকের দুধে শুধু বাচ্চারই উপকার। না কেবলি বাচ্চা নয়,মায়েরও উপকার।”

”তাই?” অবাক হয়েছিলেন শুনে।

”ঠিক তাই। প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর যে অতিরিক্ত ওজন বাড়ে,সেটা ব্রেস্টফেড করালে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রসব পরবর্তী রক্তপাতের সম্ভাবনা কমে যায়। আর একটা সম্ভাবনা কমে যায়, শুনলে অবাক হবেন।”

”কী?”

”মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়, বাচ্চাকে নিয়মিত স্তনপান করালে।”

”জানতাম না।”

জানে না। অনেকেই জানে না মাতৃদুগ্ধের এত গুণ! যেমন ওই তরুণী জানতেন না।আবার, আউটডোরে আসা ওই তরুণী না জেনেও পান করান, ভগবানের দান। অথবা, পাশে বসা এই তরুণী অনেক কিছু জেনেও বাচ্চাকে বুকের দুধ দেন না।

কে ঠিক,কে ভুল সে প্রশ্ন থাক। কে ভাল,কে মন্দ সে তর্ক তোলা থাক। শুধু এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক, বাচ্চাকে অন্তত ছমাস বয়স অবধি বুকের দুধ খাওয়াতেই হবে।

©প্রদীপ্ত ঘোষ

One thought on “দুধের বোতল

  • চমৎকার লিখেছেন ডাক্তারবাবু, উপরের লেখাটি পড়তে পড়তে স্ক্যালপেলের সেই লেখাটির কথা মনে পড়ল। ডাঃ সব্যসাচী সেনগুপ্তের।

Comments are closed.