পাঠকের চোখে – জয় গোস্বামীর উপন্যাস “মাধুদি”

Book Review, Reviews, পাঠকের চোখে

♦ উপন্যাস— মাধুদি
♦ লেখক — জয় গোস্বামী
♦ শারদীয় প্রতিদিন(১৪২৬)

রিভিউ লিখলেন তানিয়া সিংহ রায়

সম্প্রতি শেষ করলাম শারদীয় প্রতিদিন(১৪২৬) এ প্রকাশিত প্রখ্যাত কবি জয় গোস্বামী রচিত “মাধুদি” উপন্যাসটি।

জয় গোস্বামীর কিছু কবিতা পড়েছি আর হাতে গোনা কয়েকটি উপন্যাস পড়ে লেখকসত্ত্বা বিচার করার মত আমার ধৃষ্টতা নেই। তবুও এই সামান্য কয়েকটি লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে উনি মফস্বলের কথাকার। চরিত্ররা ভীষণ ভাবে মফস্বলের হাওয়াপুষ্ট। কিন্তু সেই হাওয়ায় যেমন নেই গ্রামজীবনের অপার সরলতা তেমনি নেই নাগরিক ক্রূরতা। চরিত্ররা আলোয়-কালোয় ছায়ারোদ্দুর ফেলে কাহিনিতে।

কোনো এক মফস্বল টাউন এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট যেখানে নদীর মত বয়ে চলে মানুষের রোজকার জীবন। ঔপন্যাসিক টাউনের কোনো নাম পরিচয় দেন নি। অর্থাৎ বুঝে নিতে হয় কোনো স্থাননামের গন্ডীতে কাহিনিকে না আটকে তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইছেন এ কাহিনি সবিশেষ নয়, নির্বিশেষ। মফস্বলের এ জীবন তথা মানুষের এ যাপন যে কোনো স্থানের মানুষের সঙ্গেই মিলে যায়। একটু কাহিনির পরিচয় দিই এই সময়,—

এক আঠাশ বছরের ছেলে সোমনাথ ভাবছে, — ” এই হাওয়াটা যদি নিয়ে যেতে পারতাম মাধুদির জন্য। সকালবেলার এই হাওয়াটা।…” এইভাবে শুরু হয় “মাধুদি” উপন্যাস।

কে এই মাধুদি ? সোমনাথের থেকে আট বছরের বড়, দেখে মনেই হয়না ছত্রিশ চলছে তার, অনায়াসে তাকে চব্বিশ ভাবা যায়, পাতলা চেহারা, খুব হাসলে গজদাঁত দেখা যায় — এমন শারীরিক বৈশিষ্ট্য -এর অধিকারী এক স্কুলটিচার এবং সর্বোপরি একজন গানের দিদিমণি, যার গান শুনে সোমনাথ মুগ্ধ। মাধুদি সোমনাথের সঙ্গে খুব সহজে মন খুলে অসংকোচে মিশতে পারে অথচ সোমনাথ ভারী জড়সড়। সোমনাথের নানা ভাব-অনুভবে পাঠক বুঝে যায় সোমনাথ তার প্রেমে পড়েছে।

আর সোমনাথ ? সে কে? কেমন তার পারিবারিক পরিচয় ? — সোমনাথ মাস্টার্স পাস করে ঘরে বসে থাকা এক কোমলপ্রাণ ছেলে যার আচার-আচরণ, স্বাভাবিক – অস্বাভাবিক সবরকম পরিস্থিতিতেই ভাবনার বাহ্যিক প্রকাশ তাকে আঠাশ বছর বলে ভাবায় না, বরং ভাবায় চোদ্দ বছরের কিশোরই যেন সে। সোমনাথ থাকে তার বিধবা মায়ের সঙ্গে যিনি তাঁর অকালমৃত স্বামীর চাকরি পেয়ে কোনোমতে সংসার টিকিয়ে রেখেছেন এবং উপরি হিসাবে আছে সোমনাথের দুটি টিউশনি যার একজন এগারোমাস বেতন দেয় নি এবং সোমনাথ আশা করে একদিন হয়ত পুরো টাকা তারা একসাথে মেটাবে (এই হল আঠাশের সোমনাথ)।
সোমনাথ চাকরির চেষ্টা করে। কিন্তু পায় না। সে বলে, এই বাজারে চাকরি পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়, নয় পার্টির জোর চাই। অথচ সোমনাথের ব্যবসা করার মানসিকতায় দেখিনা। তার মায়ের সামান্য রোজগারেও যখন চলেনা তখন সোমনাথ বারবার নিজের বয়স অনুযায়ী কর্মজগতে ঢুকতে দেরি হচ্ছে ভাবলেও বিকল্প পথ বাছতে অনাগ্রহীই থেকে যায়। আসলে ঔপনিবেশিক শাসনে তৈরি হওয়া ভ্রান্ত শিক্ষাধারণা কেবল কেরানি তৈরির মানসিকতার বীজই পুঁতে দিয়ে গেছে যার গাছ এই সোমনাথ তথা এই বেকার সমাজ যারা চাকরির আশায় জীবনের অনেকটা বছর হেলায় ক্ষইয়ে ফেলে।

মাধুদির প্রতি অনুরক্ত সোমনাথ মাধুদির নিমন্ত্রণে তার বাড়িতে যায়, দুপুরে খায়,খাওয়া হলে বিছানায় পা ঝুলিয়ে মৌরি চিবোতে চিবোতে গল্প করে। মাধুদি হাসে-কথা বলে অনর্গল আর সোমনাথের প্রেমিকসত্তা বিভোর হয়। পরবর্তী আসার দিন মনের মধ্যে লালন করে চলে। বহন করে মাধুদির গন্ধ।
মাধুদিকে সারপ্রাইজ দিতে সোমনাথা একদিন না জানিয়েই মাধুদির বাড়ি চলে আসে সেই ” সকালের হাওয়াটা যদি মাধুদিকে দিতে পারতাম ” ভেবে। তারপর?

কাহিনি এগোবে মাধুদি – সোমনাথের হাত ধরে।
এগোনোর পাশাপাশি একটা একটা করে পাপড়ি খুলে গোটা ফুলটাকে প্রস্ফুটিত করবে কুঁড়ি থেকে। যার প্রতিটা পাপড়ি এক এক চরিত্রের চারিত্রিক চলন। যার প্রতিটা পাপড়ি আসলে মানুষের জীবনেরই সকল সম্ভাবনাময় সত্তা যে সত্তায় ঘটতে পারে এক নামকরা সুলেখিকার লেখিকা ইমেজ আর বাস্তব পরিচয় আলাদা হওয়া অস্বাভাবিক নয় তার পরিচয় ; যে সত্তায় ঘটতে পারে আপন জেঠতুতো দিদির সঙ্গে প্রেম রচিত হওয়া অস্বাভাবিক হলেও অসম্ভব নয়, যে সত্তায় ঘটতে পারে বিষম প্রেম-যৌনতা যা আপাতদৃষ্টিতে অসহ্য মনে হলেও মানতেই হবে এ পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছুই হয় না। এইভাবে প্রত্যেকটি সত্তা মিলে মিলে ফুটিয়ে তুলবে একটি ফুল যা আসলে মানবজীবন, যে ফুলের সৌরভ আসলে জীবনেরই গন্ধ — জীবন থাকলেই যে গন্ধ থাকে। তাই ঘটনা কী ঘটতে পারে জেনেও অবাক হতে হয় সেই ঘটনাগুলোর নাটকীয় পরিবেশনের জন্য। চরিত্রের সংলাপে সংলাপে তৈরি হওয়া বাতাবরণে পাঠকমন যখন নিজেকে সেই পরিবারের সদস্য ভাবতে শুরু করে তখনই পরিবারে নেমে আসা বিপর্যয় কখন যেন হয়ে যায়
পাঠকের নিজেরও। সাধারণীকরণ হয় তখন। “মমেতি ন, মমেতি চ “— অর্থাৎ আমার না হয়েও আমার। এখানেই ঔপন্যাসিকের মুন্সীয়ানা।

ঘটনা পরিস্থিতির অনুপুঙ্খ বিবরণ উপন্যাসকে সিনেম্যাটিক করে তুলেছে। সংলাপ তারই সহায়ক। মা ও ছেলের এক রসায়ন এ উপন্যাসের আরেক দিক যা এর আগে “ব্রহ্মরাক্ষস” -এ ও দেখি। মনে হয় এ পর্ব কোথাও গিয়ে যেন লেখকের নিজেরও। উপন্যাসের নামকরণ একদম চরিত্রকেন্দ্রিক। অতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনার আশ্রয় নেন নি লেখক। সব মিলিয়েই এই থ্রিলার,ভৌতিক,সায়েন্স ফিকশন জঁরে স্বাদ নেওয়া পাঠক একটি সহজ সরল অথচ আমাদের সমাজেরই যার তার সাথে ঘটে যাওয়া এক আখ্যানে নিবিষ্ট হতে চাইলে পড়তেই পারে এই সামাজিক উপন্যাসটি।

© তানিয়া সিংহ রায়