সখীরি লাজ বৈরন ভঈ

Friends, আদতে আনাড়ি, বাংলা

(এবছর উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কালকণ্ঠের দশম বর্ষীয় উৎসব সংখ্যায় এই লেখাটি স্থান পেয়েছে।)

১.

  • রাজন আমায় মার্জনা করুন। আমি আমার সমগ্র সত্তা শ্যামচরণে অর্পণ করেছি। কায়ায়-মনে পতিত্বে বরণ করেছি তাঁকেই। এক-প্রেমের দীক্ষা নিয়েছি শৈশবেই।
  • তোমার অচলা ভক্তিকে আমি সম্মান করি প্রিয়তমা পত্নী। কিন্তু মানব-জন্ম কেবল ভক্তি ভাবে কাটেনা। সমাজের জীব আমরা। সমাজ সাক্ষী রেখে আমাদের জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু। তুমি আমায় অস্বীকার করে অন্যকাউকে পতিত্বের স্বীকৃতি দিতে পারোনা। আমার পৌরুষ পরাজিত হবে প্রস্তরের দেবতার কাছে সেও কী রাণা সংঘে’র ক্ষাত্রবলীয়ান পুত্রের মেনে নেওয়া সাজে!
  • জগতে তিনি বিনা আর কোনো পুরুষের কাছে আমি আপন গরিমা বিসর্জন দেবোনা হে ভোজ রাজ। আত্মা বিহীন এই জড়দেহ আপনি আপন পৌরুষ চরিতার্থে ব্যবহার করতে পারেন।
    মেরো তো গিরিধর গোপাল, দুসরো না কোয়ে
    যা কো শির মোর মুকুট মেরো পতি সোয়ে

চেতন হারান মেরটার রাজকুমারী। বাহুডোরে তাকে সন্তর্পণে ধরে নেন কুমার। কি অপরূপ মায়া এই মুখে। এই রূপ জাগতিক নয়। চোখ পড়ে বংশীধর কৃষ্ণ মূর্তিটিতে। হঠাৎই ভীষণ ভয় করে কুমারের। ভয় নাকি শ্রদ্ধা! এই মুহূর্তে বাহুডোরে যাকে ধরে রেখেছেন তিনি বীরভোগ্যা নন। তিনি প্রেমসাধিকা।

  • হে কৃষ্ণ আমার প্রেমাস্পদার প্রেম গাথা তোমারই নামে হোক তবে। এত প্রেম তোমার, এত ভক্ত তবু আমার ক্ষুদ্র হৃদ-প্রদীপের আলোটুকুও তোমার চাই!
    তবে তাই হোক। তবে এই কাব্য, এই প্রেম জগৎ জানুক। কন্ঠে যার সরস্বতী, অন্তরে যার তুমি তাকে এই সংকীর্ণ প্রাসাদে মানায় না। সমগ্র পৃথিবী তার নিক্কণ শুনুক। এই অজ্ঞানের সংসারে প্রেমের জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে মীরার প্রয়োজন। সহায় থেকো প্রভু..
    রানাজি ম্যায় গোভিন্দ কে গুন গা সু হুঁ
    রাজা রুঠে, নগরী রুঠে, কানহা রুঠে
    কাঁহা যা সু হুঁ..
    ২.
  • ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন জাঁহাপনা, কিন্তু শত্রু-পত্নীর সাথে সাক্ষাতের অভীপ্সা সাম্রাজ্যের পক্ষে রাজনীতির পক্ষে সমুচিত হবেনা বলেই আমার ধারণা।
  • শুধুমাত্র সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যই দুনিয়ায় এসেছি বীরবল? দিলের দুনিয়ায় সিয়াসতি চাল চলেনা হে।
    ভুলে যেওনা আমার অন্তরের সাম্রাজ্যও স্বশাসিত। হারেমে এত বিবি থাকা সত্ত্বেও রানী যোধা আমার এত প্রিয় কেন বলতে পারো বীরবল?
    কারণ রানী যোধার রিফাকতে আমার মধ্যে যে অধ্যাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে তা আর কারো মধ্যে আমি পাইনা।
    সম্রাটের খিদমতে হারেমে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় জেনানাদের মধ্যে। মুবাসরতের জিসমের অভাব জালালের নেই। রানী যোধা সেসবের ধার ধারেননা, তবু দু-দণ্ড তার কাছে বসলেই এমন সুকুন পাই কেন বলতে পারো! এই পাক জমিন হিন্দুস্থানের সব নারীই কি এমন ঐশ্বরিক প্রেমের আকর? সবাই এমন নায়াব গওহর?
    পাথরের প্রেমে পাগলপারা হয়ে যে নারী প্রাসাদ ছেড়ে পথের ধুলায় নেমে আসতে পারে তাকে একবার প্রত্যক্ষ না করে মরে গেলে শান্তি নেই আমার। শুনেছি তিনি সাধুসঙ্গে কাটান।
    এ কেমন ইবাদত যাতে দোজখের ভয় নেই! কেমন রিয়াজত যাতে জন্নতের লোভ নেই! শুধু আল্লাহ’র প্রতি বেপনাহ্ মোহাব্বতে ফনাহ হয়ে থাকা…
    আমি একবার মুকাবিল হতে চাই সেই নারীর।
  • যথা আজ্ঞা জাঁহাপনা। তানসেন ওঁর ভজন শুনেছেন। শুনেছি সেই সঙ্গীতের মূর্চ্ছনাও অনন্যসাধারণ। তবে প্রস্তুত হওয়া যাক্ শাহেনশাহ’।
  • পাশবানদের কাবিলাহ্ তৈয়ার করতে আজ্ঞা দাও বীরবল। আমি আজই রওয়ানা দেবো।

৩.
প্রাণ হামারা ওঁয়াহা বসত হ্যায়
ইয়াঁহা তো খালি খোড়..

এই খোড়ে গেড়ুয়া বসন পরাই আর রঙিন বসন, কি আর যায় আসে? এই সাজসজ্জা ধনদৌলত সবই এই খোড়ের কাজে আসে। অন্তরে যিনি বসত করেন তাঁকে সাজিয়ে রাখো। নইলে শ্যাম স্বরূপে মৃত্যুর অভিসারে আলুথালু বেশে গেলে তিনি রুষ্ট হবেন যে..

গ্রামের পথপ্রান্তে প্রান্তজনেদের মাঝে বসে তাদেরই একজন হয়ে তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনছিলেন মীরা। সংসার তপ্ত মানুষের অভ্যন্তর শীতল করে তুলছিলেন ভজন কীর্তনে।
আবিষ্টমনে সে-কথা শুনছিলেন জালাল। এমন করে কেউ তো বলেনি আগে! ইনি মানবী না দেবী! কোনো নারীর মুখে এই জীবনদর্শন শুনবেন এ যেন স্বপ্নের অতীত। নারী তো সম্পত্তি পুরুষের। নারী তো হারেমের দাঁড়ে বসা ডানা ছাঁটা তোতা। খাঁচা খুলে দিলেও যে উড়তে পারেনা। আকাশ দেখার বাসনাই যার পাপ সেই নারী খোলা আকাশের নীচে বসে সমবেত জনতাকে মুক্ত জীবনের পাঠ দিচ্ছে!
দু-চোখে অবিরাম বারিধারা সম্রাটের। ছদ্মবেশে এসে কৃষকের মাঝে কৃষক সেজে বসেছেন তিনি। সারা দেহে তাঁর একটাও অলঙ্কার নেই, অঙ্গে মলিন বস্ত্র। দীনহীন হয়ে এলেও কণ্ঠের কিমতি মুক্তামালাটা প্রাণে ধরে খুলতে পারেননি।
বড় প্রিয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হিন্দুস্থানের সম্রাটের কণ্ঠহার। আজ খুললেন।
ভীড়ে মিশে গিয়ে প্রণাম করার ছলে মীরার পায়ের কাছে রেখে এলেন নিজের সব থেকে প্রিয় অলঙ্কার…অহঙ্কার।

৪.
আকবরের সাক্ষাতের খবর গোপন সূত্রে জানার পর মীরার ওপর নেমে আসে রাজপ্রাসাদের দেওয়া শাস্তি। মাথা পেতে সেই শাস্তি নেন মীরা। কয়েক বৎসর অতিবাহিত। মীরার স্থায়ী ঠিকানা বৃন্দাবন। এর মাঝে বারাণসীতে সাক্ষাৎ হয়েছে রামানন্দের শিষ্য কবিরের সুহৃদ রবিদাসের সাথেও। সারা ভারতে ক্রমশ জাগছে ভক্তিবাদ। ব্রাহ্মণ্যবাদের আগ্রাসন কমছে। বর্ণাশ্রম কে তোয়াক্কা না করে প্রেমের রসে মজিয়ে দিচ্ছেন মীরা। এমনই এক সময়ে বৈরাগিনীর সাক্ষাৎ পিয়াসী হয়ে এলেন জীব গোস্বামী। কাছে যাবার সাহস নেই। দূর থেকেই মুখে মুখে বাঁধা পয়ার গুলি শুনছিলেন তিনি।

মীরা শুধুই কি প্রেমিকা! শুধুই হরিচরণদাসী! এই তার পরিচয় জগতে? ইনি যে জাত কবি।
জীব গোঁসাই স্থবির দাঁড়িয়ে দ্বারপ্রান্তে। এভাবে কি রাজকূলবধুর সাথে সাক্ষাত করা যায়? যতই তিনি আজ বৈরাগিনী হোন..
কাঁওয়ারসা আর নেই। যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। রাজবধূর এহেন অবাধ চলন কি মেনে নিতে পারে সমাজ! যে নুপুর অবাধ চলনে লাগাম দিতেই নারীর পায়ে পরানো হয় সেই নুপুরের ধ্বনি আজ চিতোর থেকে বৃন্দাবন মুখরিত করে তুলেছে।
পুরুষতান্ত্রিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই নারী যে প্রেমে মজে প্রাসাদ থেকে পথে নেমে এসেছেন তা কি কেবলই ওই একখণ্ড প্রস্তরের জন্য!
যুদ্ধে হত পতির সঙ্গে সহমৃতা হতে অরাজী এই কন্যা কীসের সাহসে সমাজের কর্তাদের মুখের ওপরে বলতে পারেন তিনি পতিহীনা নন, তাঁর অন্তরে অধিষ্ঠিত আত্মদেবতা অবিনশ্বর। জীবনের আরাধনা বাকী আছে তার। শ্যামের ভজনা বাকী। যাহাই শ্যাম তাহাই জীবন। চক্ষু মুদে কালোত্তীর্ণ প্রেমগাথা গেয়ে যাওয়া অনেক বাকী তাঁর নামে। মৃত্যু অপেক্ষা করুক। শ্যামাঙ্গে অঙ্গীভূত হবার তাড়া নেই তার।
এত দৃঢ় এই নারীর প্রত্যয়!
কাগ কোয়ল সব রঙ এক,
কোয়ে গোরে, কোয়ে কারি
কবহুঁ বোলে তক তিরজ মারে
কবহুঁ বোলে জগ প্যায়ারি,
ফল সব করনি কা চাখে
মানো বাত হমারি..

জীব গোঁসাইয়ের অন্তরের বাসনা তীব্রতর হয়ে উঠলো। যতটুকু অধ্যাত্মবোধ তাঁর আছে সবটুকু দিয়েও তিনি এমন জীবনানন্দ সাজিয়ে তুলতে অক্ষম। সহসা বীণার সুর বাধাপ্রাপ্ত হল। কোমল স্বরে কক্ষ থেকে ভেসে আসলো, “আঙ্গন মে হি গোপিন ঠহেরে, গিরিধারী তোহে প্রেম সে কওন নিহারে..”
লজ্জিত হলেন গোঁসাই।

  • বাঈসা, ক্ষমা করবেন, আমি পুরুষ, সাক্ষাতের ঐকান্তিক বাসনা নিয়ে দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ালেও, প্রবেশে সঙ্কোচ অনুভব করছি।
    স্মিত হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে অঙ্গনে নেমে আসেন সাধিকা। চমকিত হন গোঁসাই। চোখে জ্ঞানাঞ্জন লাগলে চোখের দীপ্তি এমন উজ্জ্বল হয়!
  • কৃষ্ণ প্রেমে কে পুরুষ, কেই বা নারী পথিক! আমরা সবাই যে বৃন্দাবনের গোপি। এখানে উপস্থিত একমাত্র পুরুষ উনি..

বাক্য শেষ করে পূর্ণ চোখে প্রেম ভরে তাকান অধিষ্ঠিত দেবতার দিকে। সঙ্কোচ ত্যাগ করে গোঁসাই ঠাকুর নিজের পরিচয় দিতে করজোরে প্রণাম করেন মীরা।
সাধক জীব গোস্বামী আজ মীরার কুটিরে এসেছেন! তাঁর শিষ্যা হবার সাধ যে মীরার বহুদিনের। শৈশব থেকেই সাধুসঙ্গ বড় ভালো লাগে মীরার। জ্ঞান তৃষ্ণা প্রবল হলে সাধুসঙ্গ দরকার বৈ কি। ভোজরাজের ভ্রাতা ভগিনীর মিলিত চক্রান্তে প্রাসাদ প্রান্তের মন্দির, সাধুসঙ্গ সমস্ত ত্যাগ করতে হয়েছে মীরাকে একদিন, তবু কৃষ্ণবিচ্ছিন্না করতে পারেনি তাকে। বীণাটুকু সম্বল করে তিনি কৃষ্ণাদেশে বেরিয়ে এসেছেন প্রাসাদ ছেড়ে। বৃন্দাবনের সবটুকুতেই গিরিধারী মিশে আছেন। এই তার প্রাসাদ।

৩.
কৃষ্ণকে নিয়ে কবিতা লিখবে স্বল্পবুদ্ধির নারী! এত স্পর্ধা!
চরিত্র হনন কর। বিষাক্ত করে তোলো জীবন। ফুলের মাঝে সাপের মতো আপনজনদের কেই ক্ষেপিয়ে তোলো তার বিরুদ্ধে। জীবনানন্দিনী নারী নিত্য সংসারের উগরে দেওয়া হলাহল পান করুক।
বিষ!

  • হে মুরলীধর কালীদহের বিষাক্ত জলে নেমেও তুমি অগ্নিবাস্পে অচল ছিলে। আমাকেও শক্তি দাও। আমি তোমার বৃহৎ সংসারের গৃহিণী হতে চাই পতি, এ সংকীর্ণতার বিষ হতে আমায় রক্ষা কর। তুমিই জ্ঞান তুমিই মুক্তি। পবিত্রতার বলয়ে যেন অজ্ঞান বিষ আমায় ছুঁতে না পারে।

স্বামী কাকে বলে? তিনবছরের মীরার হাতে পরিব্রাজক সাধুর দেওয়া কৃষ্ণ মুরতিখানি পিতা রতন সিং দেন সেদিনও কি মীরা বুঝেছিলেন এই প্রস্তরখন্ডই তাঁর সবটুকু হয়ে উঠবেন!
জেনেছিলেন যে প্রেমে প্রেমিকের কাছে আত্মনিবেদন হেতু তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন পড়েনা সেই প্রেম স্বর্গীয়!
অভ্যন্তরে কেবল তাঁকে উপলব্ধি মাত্র আদ্র হয় হৃদজমিন। মুখ হতে সে প্রেম উৎসারিত হলে সঙ্গীত আর আঁখি হতে উৎসারিত হলে প্রেমাশ্রু।
গিরিধারী তুমি কবি মীরার উপলক্ষ মাত্র। তোমাকে ভজনা করতে তোমারই প্রয়োজন নেই। কৃষ্ণাদ্র হৃদয়ে কৃষ্ণ নিজেই অতলে তলিয়ে যান।
অ্যায়সো জনম নেহি বারংবার
পিয়া মিলন যামিনী, উৎসব মনায়ে,
ফাগুন কে দিন চার…

ক্ষুদ্র এবং দুর্লভ মানব-জন্ম, তন্মধ্যে আরো ক্ষুদ্র বসন্তদিবস। প্রতিটা দিন শেষ দিনের অনুরাগে যাপিত হোক। অনুরাগের ফাগে রাঙা হোক জীবন। বারে বারে আর আসা হবেনা।

© #শিল্পী_দত্ত