কালান্তর

Friends, আদতে আনাড়ি, বাংলা

 

।।১।।

দিনটা শুরু হয়েছিল অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে। মাসখানেক আগে ভারতসরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রক থেকে অবসর নিয়েছি। প্রতিরক্ষামূলক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার মুখ্য পদার্থবিদ থাকার সুবাদে যদিও এখনো পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করে যেতে হচ্ছে মাঝে মাঝে, কিন্তু সেই কাজের চাপটা অনেকটা হালকা হয়েছে বুঝতে পারি। বেশিরভাগ সময়টাই এখন নিজের মতো বই পড়ে আর এদিক সেদিক ঘুরে কেটে যায়।

আরামকেদারাটায় বসে মহেশের হাতে বানানো চা টায় সবেমাত্র চুমুক দিতে যাব, এমন সময় বেজে উঠেছিল ফোনটা। খুব একটা ব্যস্ত না হয়ে উঠলেও অবাক হয়েছিলাম। ফোন বলতে আমার যা আসে সবই কাজসংক্রান্ত, আর এতো সকালে খুব জরুরী কিছু না থাকলে কাজ নিয়ে তো কেউ ফোন করে না! চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ফোনটা কানে নিতেই ক্ষীণ কণ্ঠটা ভেসে এসেছিল,

-“বিশু বলছিস?”

ভীষণভাবে অবাক হয়েছিলাম। গত বারো বছর আমাকে এই নামে কেউ ডাকে নি। এই নামে ডাকার যে কজন ছিল, হয় তারা পৃথিবীতে নেই, নয়তো সেভাবে যোগাযোগ নেই কারোর সাথে।

গলার অবাক ভাবটা লুকিয়ে গাম্ভীর্য এনে প্রশ্ন করেছিলাম, “কে বলছেন?”

ওপ্রান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর একইরকম দুর্বল গলায় বলেছিল, “আমি খেতু বলছিলাম।”

স্মৃতির অতলে ডুব দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ। খেতু! খেতু! একটা মুখ আবছা ভেসে উঠেও যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। ওপ্রান্তের মানুষটা বোধহয় আমার অসহায়তাটা অনুভব করতে পেরেছিল। বলেছিল, “পরীক্ষিৎ সোমকে মনে আছে?”

পরীক্ষিৎ! খেতু! বিদ্যুৎচমকের মতো পরপর অনেকগুলো স্মৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আই আই এস ই আর-এ আমার ব্যাচমেট ছিল। ফিজিক্সে তুখোড় মাথা, কিন্তু সবসময়ই নতুন কিছু আবিষ্কারের পাগলামো। সিস্টেমের বাইরে কিছু করার চিন্তাভাবনা করত। তাই পড়াশোনা শেষে আমরা সবাই মোটামুটি ভালো জায়গায় পৌঁছে গেলেও পরীক্ষিৎ সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু করে উঠতে পারে নি। শেষ অবধি খবর পেয়েছিলাম কোন একটা কলেজে নাকি পড়াত। তারপর আরো অনেকের মতো খেতুও আমার অতীতের একটা বিবর্ণ পাতা হয়েই রয়ে গিয়েছিল।

উত্তেজনাটা আর চেপে রাখতে পারিনি এবারে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এতোদিন পরে তুই? কী ব্যাপার? কোথায় আছিস? কী করছিস?”

এতোগুলো প্রশ্নের ধাক্কা সামলাতেই বোধহয় একটু চুপ করেছিল খেতু। তারপর অবসন্ন কণ্ঠে বলেছিল, “তুই একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবি? খুব জরুরী প্রয়োজন।”

আমি বলেছিলাম, “তোর বাড়ি তো না হয় যাব, কিন্তু প্রয়োজনটা কী? ফোনে বলা যাবে না?”

এরপরই আচমকা আঘাতটা এসেছিল ওপ্রান্ত থেকে, যার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না আমি। শব্দগুলো যেন বুলেটের মতো এসে বিঁধেছিল আমার কানে।

-“প্রফেসর সেনের হারিয়ে যাওয়ার আসল কারণটা জানতে পেরেছি আমি।”

।।২।।

মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে গাড়িটা নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। জায়গাটা বর্ধমানের কোন একটা গ্রাম হবে। ফোনে আমাকে যেরকম নির্দেশ দিয়েছিল খেতু, ঠিক সেরকমই এসেছি আমি। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে আনতেও গাড়িটা ওই পাঠিয়েছিল। আমি এখন গাড়ির জানলার দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছি।

সেদিনে খেতুর কথা শুনে আমি কয়েকমুহূর্তের জন্য ভাষাহীন হয়ে গিয়েছিলাম। মস্তিষ্ক একটু বেগ পেয়েছিল তথ্যটা হজম করতে। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঈষৎ তিক্ততার স্বরে বলেছিলাম, “তাহলে এতোদিন এতো জলঘোলা হয়ে গেল যখন, তখন তোকে পাওয়া যায়নি কেন?”

খেতুর নির্বিকার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলাম, “কারণ এতোগুলো বছর আমার সেই কারণটা জানতেই কেটে গেছে।”

প্রফেসর নিরঞ্জন সেন ছিলেন পৃথিবীর প্রথম সারির একজন পদার্থবিদ। তার থেকেও বড়ো কথা হল তিনি ছিলেন আমার আর খেতুর শিক্ষাগুরু। তাই তাঁর একদিন হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী যতোটা সাধ্য চেষ্টা করেছিলাম তাঁর খোঁজ করার। কিন্তু মানুষটা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন যেন। একাই থাকতেন, দেখাশোনার জন্য একটা চাকর থাকত শুধু। তারই জবানবন্দী থেকে জানা যায়, একদিন সকালে বাবুর ঘরে চা দিতে গিয়ে দেখতে পায় দরজা হাট করে খোলা, ঘরের ভেতরে বা বাইরে বাবুর কোন চিহ্নই নেই। দেশে, আন্তর্জাতিক মহলে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল এই নিয়ে। অনেক তদন্ত চলেছিল, কিন্তু কোন সমাধান পাওয়া যায়নি এই অত্যাশ্চর্য অন্তর্ধানের। তারপর ধীরে ধীরে সব থিতিয়ে গিয়েছিল। সেই ঘটনার পনেরো বছর পরে খেতুর এই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে চাপা কষ্ট আর ব্যর্থতার ক্ষোভটা আবার একবার জেগে উঠেছিল।

গাড়িটা হঠাৎ করে থামতেই বর্তমানে ফিরে এলাম। মাঝারি ধরনের একটা একতলা পাকাবাড়ির সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়িয়েছে। চারপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটার সামনের জমিটায় একটা ছোট মতো বাগান। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালাম আমি। বাগানের দু একটা ফুলগাছ আর ঝোপঝাড় চোখে পড়ল। খুব একটা যত্ন যে পায় না বোঝাই যাচ্ছে। আশেপাশে দু একটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। চারপাশে বড়ো বড়ো মাঠ, তাদের মধ্যে দিয়ে একটা চওড়া রাস্তা চলে গেছে শুধু। সেই রাস্তার পাশ থেকে একটা পথ বেরিয়ে খেতুর বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। এরকম নির্বান্ধবপুরীতে খেতু কী করছে!

গাড়ির শব্দে সামনের লোহার বড়ো দরজাটা খুলে যে মানুষটা বেরিয়ে এল, অনায়াসে বলে দেওয়া যায় এই মানুষটাই খেতু। হয়তো বাগানেই ছিল। মুখের ভাবটা মোটামুটি একই আছে। বয়সের প্রভাব পড়েছে শরীরে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু এ কী অবস্থা হয়েছে চেহারার! কেমন যেন ক্ষয়ে গেছে মনে হচ্ছে, গালগুলোও কেমন বসা! মাথার অবশিষ্ট যতোগুলো চুল আছে সবই সাদা। চশমার ভেতর দিয়েও চোখের ঘোলাটে ভাবটা বোঝা যাচ্ছে।

আমাকে দেখে বলল, “ভেতরে আয়। আসতে অসুবিধে হয়নি তো?”

আমি বললাম, “না,না। তোর ড্রাইভারের হাত খুবই ভালো।”

খেতু এবার জোরে হাসল একটু। হেসে বলল, “আরে ও আমার ড্রাইভার নয়, নিরঞ্জন স্যারের একমাত্র বোনপো, সুনন্দ। তোকে আগে বলিনি কারণ একটু সারপ্রাইজ দেব ভেবেছিলাম। গাড়িটা যদিও আমারই।”

গাড়িটা একধারে রেখে যুবকটা এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে। খেতুর কথায় একটু লজ্জিত হয়ে তাকালাম তার দিকে। খুব বেশি বয়স নয়। পোশাকআশাক ড্রাইভারের মতো তো নয় একেবারেই, বরঞ্চ চেহারায় একটা স্মার্ট বুদ্ধিদীপ্ত ভাব আছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতে মৃদু হাসল।

খেতু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “যা যা প্রশ্ন উঠছে মনে সব করবি, কিন্তু তার আগে ভেতরে চল।”

বাগানের মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে ঘর অবধি। ঘরের সামনে অর্ধগোলাকৃতির উঠোন রয়েছে একটা, সেটা পেরিয়ে ঘরের ভেতরে যাওয়ার দরজা।

হাঁটতে হাঁটতে সুনন্দ বলল, “স্যার আপনার কথা খুব শুনেছি মামার কাছে। আপনার খুব প্রশংসা করতেন।”

আমি বললাম, “স্যারের কোন ভাগ্নে আছে এটা জানতাম না। স্যারের কোন ভাইবোন আছে এটাও জানা ছিল না। কোথায় থাকতে তোমরা?”

সুনন্দ একটু যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেল। “আসলে স্যার, আমার মায়ের সাথে মামার সম্পর্ক ভালো ছিল না তেমন! আমরা আলাদাই থাকতাম। ইনফ্যাক্ট অনেকবছর আমি এটাই জানতাম না আমার কোন মামা আছে! শেষ কবছর মামার সাথে যোগাযোগটা একটু বেড়েছিল আমার।”

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একটু বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন হয়ে গেল বোধহয়। অস্বস্তি কাটানোর জন্য বললাম, “তুমি কী করছ এখন?”

সুনন্দ কিছু বলার আগেই সামনে থেকে খেতুর গলা ভেসে এল, “তোরা দুজন এসে বোস আগে, তারপর যা গল্প করার করবি।”

খেতুর ঘরের ভেতরটা বাহুল্যবর্জিত। ঘরের মাঝে একটা কাঠের টেবিল, তার সামনে একটা সোফা, আর দুটো কাঠের চেয়ার রাখা আছে। ঘরের দেওয়ালগুলোর তাকে শুধু বই ঠাসা। ঢুকেই ডানদিকে কিচেন আর বেডরুমটা চোখে পড়ল। একটা সিঁড়ি বোধহয় বসার ঘরের ভেতর দিয়ে ছাদে উঠে গেছে। সিঁড়ির ঠিক পাশ দিয়েই একটা বাইরে যাবার দরজা। আমি আর সুনন্দ কাঠের চেয়ার দুটোতে বসলাম। আমাদের উল্টোদিকের সোফাটায় বসল খেতু।

খেতুই কথা শুরু করল প্রথমে, “লক্ষণকে বাইরে পাঠিয়েছি একটু কাজে। ওর আসতে একটু দেরী হবে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা না হয় তারপরেই শুরু করা যাবে।”

আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, “ওসব কথা বাদ দে খেতু। যে জন্য ডেকেছিস সেটা বল। প্রফেসর সেনের ব্যাপারে কী জানিস তুই?”

খেতু বলল, “ আরে এতো তাড়াহুড়ো করছিস কেন? তোকে আর সুনন্দকে তো সব বলব বলেই ডেকেছি।”

একটু থেমে বলল, “হারিয়ে যাওয়ার আগে অবধি প্রফেসর সেন কী নিয়ে কাজ করছিলেন জানিস?”

আমি বললাম, “স্যারের সাথে আমার যতোটুকু কথা হত তাতে জেনেছিলাম উনি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ওপর কী একটা গবেষণা করছেন! কিন্তু এক্সাক্টলি কী করছেন সেটা খোলসা করে বলেননি।”

খেতু কিছুক্ষণ থেমে আমাদের মুখের দিকে তাকাল। যেন কিছুর জন্য অপেক্ষা করল। তারপর থেমে থেমে বলল, “ওই গবেষণাটা একটা কভার ছিল। আসল ব্যাপার হল, সামহাউ, আমি জানি না কীভাবে, কিন্তু প্রফেসর সেন শেষ অবধি টাইম মেশিন আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন।”

ঘরে তখন পিনপতন নৈঃশব্দ্য।

সুনন্দ পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে, তার চোখের পলক পড়ছে না। আমার অবস্থাও তথৈবচ। এই কথার কী প্রতিক্রিয়া হয় খুঁজে পাচ্ছি না। মাথায় তুমুল আলোড়ন শুরু হয়েছে কথাটা শুনে। তিনজনেই অস্বাভাবিক রকম চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।

নীরবতাটা ভাঙলাম আমি। গলাটাকে দু একবার খাঁকারি দিয়ে বললাম, “দেখ, এটা কী ধরনের মজা করছিস আমি জানি না। কিন্তু পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী…”

মাঝখানে থামিয়ে দিল আমাকে খেতু, “জানি জানি। পদার্থবিদ্যার সূত্র মানলে টাইমমেশিন সম্ভব নয়। অপরিমেয় শক্তি লাগবে যন্ত্রটাকে চালাতে, তারপর টাইম প্যারাডক্স আরো অনেক কিছু রেস্ট্রিকশন আছে। কিন্তু প্রকৃতির আসল ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা কতোটাই বা জানি! বিশ্বাস কর বা নাই কর, প্রফেসর কিন্তু সক্ষম হয়েছিলেন ফুল ফাংশনিং একটা টাইম মেশিন বানাতে।”

সুনন্দ চুপ করে ছিল এতোক্ষণ। এবারে ওর গলা শোনা গেল। ঈষৎ কাঁপছে গলাটা, হয়তো খবরটা পুরোপুরি হজম করে উঠতে পারছে না ওর মাথা।

সুনন্দ বলল, “কিন্তু আপনি এসব জানলেন কী করে?”

খেতু  বলল, “প্রফেসর সেন হারিয়ে যাওয়ার ঠিক একসপ্তাহ আগে আমার কাছে একটা পার্সেল আসে ওঁর কাছ থেকে। তাতে একটা ছোট নোট ছিল। তাতে লেখা ছিল, ‘পৃথিবীতে আমার আর বেশিদিন নেই আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু যাওয়ার আগে আমি তোমাকে, সুনন্দ আর বিশ্বরূপকে খুব দরকারী কিছু কথা জানিয়ে যেতে চাই। আমি হয়তো পারব না, তাই এই দায়িত্বটা আমি তোমাকেই দিচ্ছি।  তোমার যা যা লাগবে এই পার্সেলেই পাবে।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “পার্সেলটার ভেতরে আর কী কী ছিল?”

খেতু বলল, “তিনটে চিঠি ছিল আমাদের তিনজনের জন্য। একটা হাতে লেখা ডায়েরি ছিল আর…” খেতু থামল একটু।

উত্তেজনায় আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, “আর কী ছিল?”

খেতু বলল, “আর একটা টাইম মেশিন!”

যুগপৎ অনেকগুলো অনুভূতি মাথার মধ্যে একসাথে খেলে গেল আমার। আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। প্রফেসর সেনের নিরুদ্দেশের খবরটা আপাতত আমার মাথায় আর নেই। তার বদলে হাজারটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের লড়াই শুরু হয়েছে।

সুনন্দর মনে হয় দেখলাম টাইম মেশিনের ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। তার গলায় ঈষৎ ক্ষোভের আঁচ পেলাম, “মামা আপনাকে কেন দিতে গেলেন সব চিঠিগুলো? আমাদেরগুলো তো অন্তত আমাদের পাঠাতে পারতেন।”

খেতুর মুখে একটা অর্থপূর্ণ হাসি ফুটল, “নিশ্চয়ই কোন বিশেষ কারণ ছিল। চিঠিগুলো পড়লে জানতে পারবে আশা করি!”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম, “খেতু, আমি কি একবার জিনিসটা দেখতে পারি? মানে তুই বুঝতে পারছিস, এই জিনিসটা সত্যি হলে তো বিজ্ঞানের মানচিত্রটাই পালটে যাবে পুরো। কীভাবে কাজ করে তুই জানিস কিছু? তুই কি ব্যবহার করেছিস?”

খেতু বলল, “শান্ত হ একটু, তোর অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি। আমারও প্রথমটায় এরকম অবস্থাই হয়েছিল। আয় আমার সাথে।”

সুনন্দ তার জায়গা ছেড়ে নড়ল না। কিন্তু আমার আর তর সইছিল না। আমি খেতুর পেছন পেছন ওর বেডরুমে গেলাম। ঘরের মধ্যে একটা দেয়াল আলমারি খুলে কী একটা বের করল খেতু। তারপর ফিরে এসে আমার হাতে দিল জিনিসটা।

আকারে একটা রিমোটের মতো জিনিসটা। তার ওপর ডিজিটালি অনেকগুলো সংখ্যা ফুটে আছে। তার নীচে শূন্য থেকে নয় অবধি নাম্বারপ্যাড। সেগুলোর নীচে পাঁচ ছটা রঙীন বোতাম। আমি জিনিসটা উলটে পালটে দেখে বললাম, “এইটা তোর টাইম মেশিন? এইটা তোকে নিয়ে যাবে অন্য সময়ে?”

খেতু বলল, “চল বাইরে গিয়ে কথা বলি।”

সোফায় বসতে বসতে খেতু বলল, “আমি জানি এই মুহূর্তে তোর মনে অবিশ্বাসের একটা হালকা রেশ ফুটে উঠছে। কিন্তু এটাই বাস্তব, বিজ্ঞান এতোদিনে খুঁজে পেয়েছে সময়ান্তরে যাওয়ার চাবিকাঠি।”

সুনন্দ একই জায়গায় বসেছিল। তার মুখ ভাবলেশহীন। দেখে বোঝা যাবে না ভেতরে কী চলছে। আমি তার পাশে বসে বললাম, “ঠিক আছে, তুই বলতে থাক।”

খেতু বলল, “আমি যা জেনেছি প্রফেসরের ডায়েরিটা পড়েই। প্রফেসর ওখানে লিখেছিলেন, সময় হল একটা নদীর মতো। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিমুহূর্ত থেকে যে ওর যাত্রা শুরু হয়েছে, তারপর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বয়ে চলেছে অনন্তের দিকে। কিন্তু এই স্রোত একমুখী। তোকে অতীতে যেতে হলে এই স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হবে, আর সেই সাঁতার কাটার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিটাই তোকে দেবে ওই টাইমমেশিন। ”

সুনন্দর গলা পেলাম এবার, “বিপরীতে কেন যাব? চাইলে তো স্রোতের সাথে সামনেও যেতে পারি, ভবিষ্যতে। শক্তিও কম খরচ হবে। তাছাড়া অতীতে গিয়ে লাভটাই বা কী?”

খেতু বেশ জোরে হাসল, “অতীতের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোন ধারণাই নেই, তাই একথা বলছ। সেটা ছাড়াও তোমার প্রশ্নের উত্তর যদি দিতে হয় তাহলে বলব, তুমি ভবিষ্যতে যেতে পারবে না কারণ ভবিষ্যতের কোন অস্তিত্বই নেই। অসংখ্য সম্ভাবনার মধ্যে একটা মাত্র আমাদের ভবিষ্যৎ হিসেবে স্থির হয়। আর সেটাও নির্ভর করে বর্তমানের ওপর, তাই এটা ওয়ান ওয়ে লেন আপাতত। যে জিনিসটা এক্সিস্টই করে না সেখানে তুমি কী করে যেতে পারো?”

আমি বললাম, “সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু এই বিপুল শক্তি যন্ত্রটা পায় কোথা থেকে? মানে টাইমস্ট্রীমের অপোজিটে একটা পুরো মানুষকে নিয়ে যাওয়া…”

খেতু বলল, “ওইখানেই তো মজা। তোরা সবাই ভাববি মানুষটা অতীতে চলে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষটা যায় না, তার বোধটা যায়। ”

আমি একটু অবাক হলাম, “তুই কি বলতে চাইছিস মেশিনটা ফিজিকাল বডির পরিবর্তে কনশাসনেস ট্রান্সফার করে পাস্টে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?”

খেতু বলল, “অনেকটা ঠিকই ধরেছিস। এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রফেসর তেমন ভাবে কিছু লিখে যাননি। আমার মনে হয় উনি পদ্ধতিটা আবিষ্কার করতে পারলেও এর কার্যপ্রণালীটা পুরোপুরি উদ্ধার করে উঠতে পারেন নি, এমনকি আমিও এতোগুলো বছর ওই ব্যাপারে সফল হই নি। আমার থিয়োরিটা বলি, বাটারফ্লাই এফেক্ট তো তুই জানিসই!”

ঘাড় নাড়তে গিয়ে সুনন্দর জিজ্ঞাসু মুখের ওপর চোখ পড়ল। বললাম ,“পৃথিবীর প্রত্যেকটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা একে অপরের সাথে কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত। একটা প্রজাপতির ডানা নাড়ানো একটা দেশে ঘূর্ণিঝড়ের কারণ হতে পারে!”

খেতু বলল, “এবারে ভাব, যদি কেউ অতীতে সশরীরে উপস্থিত হতে পারে, যেখানে তার কোনভাবেই উপস্থিত থাকার কথা নয়, তাহলে ভবিষ্যতের ঘটনাক্রমে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। প্রকৃতি কিছুতেই এলাউ করবে না। এই যন্ত্রটা তাই মানুষের শরীরটা নয়, তার চেতনা, বোধটাকে তরঙ্গাকারে অতীতে নিয়ে যায়। যাকে বলে তোর পারসেপশন, সেটাই শুধু টাইমট্রাভেল করতে পারে, তোর খোলসটা এখানেই থাকবে। তুই শুধু অতীতে দর্শক হিসেবে থাকতে পারবি, ঘটনাক্রমকে প্রভাবিত করতে পারবি না।”

একটু দম নিয়ে খেতু বলল, “আর সেই চেতনাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তিটা শরীর থেকেই নেয়। এর গায়ে কতোগুলো রিসেপটর আছে, তোর চামড়ার সাথে সংযোগ থাকলেই শরীরের মধ্যে সঞ্চিত শক্তি থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ নিয়ে তোর চেতনাকে প্রবল ধাক্কায় পেছনে পাঠাবে, যার জন্য ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যেতে থাকে শরীরটা। ভবিষ্যৎ থেকে কেউ যদি এখন এই বসার ঘরে আমাদের কথোপকথন শোনে তাহলে অবাক হোস না।”

কথাগুলো বলে একটু হাসল খেতু।

আমি বললাম, “প্রফেসর শঙ্কুর গল্পের মতো শোনাচ্ছে যে রে!”

খেতু বলল, “পৃথিবীর অনেক কল্পনাই ভবিষ্যতে সত্যির সাথে মিলে গেছে, তাই এতে তো আশ্চর্যের কিছু নেই। তাছাড়া কল্পবিজ্ঞান তো চিরকালই বিজ্ঞানের জ্বালানি যুগিয়েছে।” সুনন্দর দিকে মুখ ফেরায় খেতু, “মানুষের কল্পনাই মনে হয় একমাত্র ভবিষ্যতে যেতে পারে। ”

সুনন্দ এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিল। বলল, “আপনি টাইমট্রাভেল করেছেন, কোথায় কোথায় গেছেন?”

খেতু একটুখানি মাথা নীচু করে বসল। তারপর বলল, “ব্যাপারটা যতোটা এক্সাইটিং লাগছে ততোটা নয় কিন্তু। হ্যাঁ আমি অতীতের অনেক জায়গায় গেছি, কিন্তু সেগুলো না গেলেই ভালো হত বরং।”

আমি বললাম, “এরকম বলছিস কেন? এই সুযোগটা পেলে ঐতিহাসিকরা জীবন অবধি দিয়ে দিতে প্রস্তুত।”

খেতু ম্লান হাসল, “তোরা জানিস না, তাই বলছিস। আমি বিজ্ঞানের লোক হয়ে বলছি, ইতিহাসের সত্যি জানার মতো অভিশাপ আর কিছুতে নেই। তোরা জানিস, তোরা ইতিহাসে যা পড়িস তার কতোটা সত্যি আর কতোটা বিকৃত, লুক্কায়িত?”

আমাদের প্রত্যুত্তরের তোয়াক্কা না করে খেতু বলে চলল, “ইতিহাসের বহু ঘটনা, অতীতের বহু পরিচ্ছদ সবাই যা জানে সেটা সত্যি নয়, প্রয়োজন অনুসারে সেগুলো ঢাকা দেওয়া হয়েছে, প্রভাবিত করা হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে। আর সেই ধারণা গুলো নিয়েই আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি, নিজেদের মতো অনুভূতি দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি। সেই ধারণাগুলোই আমাদের অস্তিত্বকে বৈধতা দিয়েছে। অতীতে গিয়ে যখন তুই সেই ঘটনাগুলোকে নিরপেক্ষ ভাবে দেখবি, তোর সমস্ত ধারণা ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকবে। তারপর তোর দেহে বোধ ফিরে এলে মস্তিষ্ক সেই নতুন তথ্য, জ্ঞানের ধাক্কা সামলাতে পারবে না। আদর্শ, অনুভূতিরা ধাক্কা খাবে। ভেতরে ভেতরে আরো ভাঙতে থাকবি। এভাবে তুই যতো অতীতে যেতে থাকবি, তোর ততো ধারণা ভাঙতে থাকবে, শরীর ততো ক্ষয়ে যেতে থাকবে, মাথার ওপর ততো বেশি চাপ পড়তে থাকবে। এমনকি তোর নিজের সম্পর্কেও ধারণা পাল্টাতে থাকবে। তারপর যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে শেষ ধারণাটুকুও মিলিয়ে যাবে, তখন এই যন্ত্র তোর শরীর থেকে শেষ শক্তিবিন্দুটা টেনে নিয়ে তোর চেতনাকে পুরোপুরি সময়স্রোতে মিলিয়ে দেবে। অনন্তকালের জন্য চেতনা বিস্তীর্ণ সময়স্রোতে ঘটে চলা ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবে।”

সুনন্দ হাঁ করে শুনছিল। আমার কাছে ব্যাপারটা মোটামুটি পরিষ্কার হলেও কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছিল। মনে মনে ঠিক করলাম, প্রফেসরের ডায়েরিটা পড়তে হবে। নিজে পড়লে হয়তো বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। তার আগে হাতে কলমে দেখা প্রয়োজন।

সুনন্দ বলল, “আমরা ঘটনাগুলো দেখার পরে আমরা যদি সেগুলো এসে জানাই বাকিদের, তাহলে কি বর্তমান ঘটনাক্রমে প্রভাব পড়বে না? ধরুন যে সত্যটা আড়ালে থাকাই ভালো ছিল, সেটা জেনে গেলে ক্যাওস তৈরি হবে না?”

খেতু সুনন্দর কথাটা শুনে আমার দিকে তাকাল, “একটা কথা জানিয়ে রাখি, দেখা শব্দটা ব্যবহার করলে হয়তো ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে তোদের। তোরা তো আর চাক্ষুষ দেখতে পাবি না, তোদের চেতনাটা বা বোধটা অতীতের যে সময়টায় যাবে, সেই সময়ে ঘটে চলা সমস্ত ঘটনাকে সমান্তরাল ভাবে উপলব্ধি করতে পারবে, চেতনায় গেঁথে যাবে। তারপর শরীরে বোধ ফিরে এলে মস্তিষ্ক যখন সেই ঘটনাপ্রবাহ গুলোকে ছবির আকারে সাজাতে যাবে, স্বভাবতই সে চাপ নিতে পারবে না।” সুনন্দর দিকে মুখ ফেরাল খেতু, “তাই অনেক ঘটনাই পরে মাথায় রাখতে পারবে না। এগুলোর ব্যাখ্যা আর টার্মগুলো একটু জটিল, এতো সহজে বোঝানো যাবে না। এটাও হয়তো প্রকৃতিরই কোন ইচ্ছা, সেই তথ্যগুলোই আমাদের মস্তিষ্ক ধরে রাখতে পারবে যেগুলো প্রয়োজন!”

হঠাৎ মাথার মধ্যে বিদ্যুতের মতো একটা কথা ঝিলিক দিয়ে উঠল। আমি বললাম, “তুই বললি খুব বেশি অতীতে যেতে থাকলে আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকবে মানুষটা। তারমানে কি প্রফেসর…”

খেতু ওপর নীচে মাথা নাড়ল দুবার।

আমি বললাম, “কিন্তু তুই জানলি কী করে? তুই তো সাক্ষী ছিলি না এটার!”

খেতু বলল, “কারণ আমি নিজেও ক্ষয়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। আর আমি না দেখলেও এটা নিশ্চিত ভাবে জানি ওটাই প্রফেসরের হারিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ। প্রফেসর ডায়েরিতেও হালকা আভাস দিয়েছিলেন, তাছাড়া আমার এতোদিনের পরীক্ষানিরীক্ষাও সেইদিকেই ঈঙ্গিত করছে। ”

সুনন্দ যন্ত্রটাকে নিয়ে ঘাঁটছিল। জিজ্ঞেস করল, “এটা কাজ করে কীভাবে?”

খেতু সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, “এই জায়গাটায় সাল দেওয়া যায়। তুমি যদি কোন একটা সাল দাও, তাহলে অতীতের সম্পূর্ণ দশকটার প্রতিটা ঘটনাকে সমান্তরাল ভাবে চেতনায় ধরতে পারবে। এই লাল বোতামটা টিপে দিলেই পৌঁছে যাবে, ঠিক দশমিনিটের মাথায় চেতনা ফিরে আসবে আবার।”

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, আগে তোদের চিঠিগুলো দিই।”

আমি উঠতে গিয়ে একবার সুনন্দর দিকে তাকালাম, দেখলাম সে স্থাণু হয়ে বসে আছে নিজের জায়গায়। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে খেতুও তাকাল সুনন্দর দিকে। ওর মুখে উদ্বিগ্ন ভাব ফুটে উঠল।

আমাদের মুহূর্তের অসতর্কতায় সুনন্দ পাড়ি দিয়েছে অতীতে। তার হাতে ধরা টাইমমেশিনে সংখ্যার জায়গায় জ্বলজ্বল করছে ১৯৮১, হয়তো ওর জন্মসাল হবে।

আমি সুনন্দর গায়ে হাত দিতে যাচ্ছিলাম, খেতু বারণ করল আমাকে। বলল, “খুব বড়ো সমস্যা হয়ে গেল!”

আমি বললাম, “কী সমস্যা?”

খেতু বলল, “আমি সাধারণভাবে অতীতে যাওয়ার পদ্ধতিটা বলছিলাম, কিন্তু বাকি বোতামগুলোরও কাজ আছে কিছু। সেফ সুইচ হিসেবে কাজ করে। একটা সামঞ্জস্য রক্ষা করে অতীতভ্রমণের সাথে মস্তিষ্কের বিশ্লেষণপদ্ধতির। নিয়ন্ত্রিত ভাবে অতীতে না গেলে ফিরে আসার পরে মস্তিষ্ক ওই বিপুল পরিমাণ তথ্য ঠিকঠাকভাবে নিতে পারবে না, ফলে বড়োসড়ো অঘটন ঘটতে পারে। আসলে এরকম কিছু করবে ছেলেটা বুঝতে পারিনি।”

দুজন অধীর উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম দশ মিনিট কেটে যাওয়ার।

।।৩।।

বর্তমান থেকে অতীত হতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু দুঃস্বপ্নের কিছু মুহূর্ত বর্তমানকে ছেড়ে সহজে যেতে চায় না কখনো।

খেতুর বাড়ি থেকে এসেছি একমাস হয়ে গেছে। পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর তীব্রতা আমাকেও হজম করতে বেগ পেতে হয়েছে যথেষ্ট।

প্রফেসরের আমাকে লেখা চিঠিটা আমি পড়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই যতোটা অবাক হওয়ার কথা তার থেকেও অবাক হয়েছি। প্রফেসরের বোন, অর্থাৎ মোহরের ছেলে সুনন্দ আসলে আমারই ছেলে!

সেই মোহর! ছাত্রজীবনে পড়াকালীন যার সাথে সারাজীবন ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই মোহর! যার সাথে অন্য আরেকজনকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল। সেই মোহর! যে আমাকে তীব্র ভাষায় অপমান করে সারাজীবন প্রেমের থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

প্রফেসরের চিঠিতে আমি সবই জেনেছি পরে। মোহর ছিল প্রফেসরের সৎ বোন। প্রফেসরের সাথে কোনোদিনই সম্পর্ক ভালো ছিল না মোহরের। তাই একজায়গাতে তিনজনে থেকেও ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি প্রফেসর সেন আর মোহরের সম্পর্কের কথা। বাবা মা দাদা সবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত মোহরের শেষ অবলম্বন বোধহয় আমাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল।

কিন্তু প্রফেসর জেনেছিলেন, আর সব জেনে মোহরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন আমার সাথে বেশি না জড়াতে। মানুষের আবেগগুলো কোন ঘূর্ণাবর্তে যে জটিল হয়ে ওঠে কেউ বলতে পারে নি কোনদিন। আর কার প্রতি কীসের ক্ষোভে জানি না, মোহরও নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সব। তার পেটে আমার সন্তানের কথাটা কারোর কর্ণগোচর হওয়ার আগেই সরে গিয়েছিল অনেক দূরে।

প্রফেসর যখন জানতে পেরেছিলেন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে অনুতপ্ত চিত্তে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ খুঁজেছিলেন, মোহর দেয়নি সে সুযোগ। কোন এক সহৃদয় ব্যক্তি তার ছেলেকে পিতৃপরিচয় দিয়েছিল, তাকে ছেড়ে আসতে পারেনি। পরিবর্তে তার নিজের ছেলেকে পাঠিয়েছিল দাদার কাছে, দাদার বুকের ভার লাঘব করার একটা সুযোগ দিতে।

প্রফেসরের বয়ানে অনেক জায়গায় জিজ্ঞাসা থেকেই গেছে। প্রফেসর স্বীকারও করেছেন। অতীতে থাকাকালীন চেতনায় একসাথে যে তথ্যগুলো ধরা সম্ভব, মস্তিষ্ক তার পুরোটাকে ধরে রাখতে পারে না, খেতু সেদিনই বলেছিল। ফলে অনেক কথাই প্রফেসরের মনে নেই। আমার তাতে আক্ষেপ নেই কোন। আমার যতোটুকু জানার ছিল আমি জেনেছি।

সুনন্দর জন্য বরং বেশি খারাপ লাগে আমার। তার নিজের প্রকৃত পরিচয় নিয়ে কোন কারণে সন্দেহ জন্মেছিল হয়তো বেচারার, তাই খেতুর বাড়িতে সেদিনের সুযোগটা হাতছাড়া করেনি। আমি চিঠিতে যা যা জেনেছি, অতীতভ্রমণ করে তার থেকে বেশি পরিষ্কার ভাবে আরো কিছু জেনেছিল হয়তো। খেতুর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল। দশমিনিট পরে চেতনা ফিরে আসায় সুনন্দর মস্তিষ্ক হঠাৎ করে ওর জীবন নিয়ে নতুন ধারণার বিপুল ধাক্কা নিতে পারেনি। যুক্তি-বুদ্ধি গুলো সব থমকে গিয়েছিল হয়তো মাথায়!

সুনন্দ এখন আমার কাছেই আছে। ও এখন কিছু চিনতে পারে না, এমনকি নিজেকেও না। ওর নিজের পরিচয় ওর নিজের কাছেই অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। দুচোখে সবসময় যেন কিছু খোঁজার আকুতি একটা! খেতু বলেছে ওর মস্তিষ্ককে নতুন করে শেখাতে হবে সব। আমি এখন প্রতিদিন নতুন করে, নিজের মতো করে বিভিন্ন জিনিস শেখাচ্ছি। কয়েকদিন হল আমাকে বাবা বলে ডাকতে শিখেছে।

আমি মোহরের ঠিকানা খুঁজে প্রফেসরের চিঠিটা পাঠিয়েছি, সাথে আমার নিজের লেখা একটা চিঠি। ওরও জানার অধিকার আছে সব। এখনো যদিও কোন উত্তর আসে নি। কিন্তু আমি জানি উত্তর আসবেই, একদিন না একদিন।

সুনন্দর চিঠিটা আমি রেখে দিয়েছি। যেদিন আমার ঘরে টাইমমেশিনটা নিয়ে একটা পার্সেল আসবে, যেদিন জানব খেতুও মিলিয়ে গেছে, সেদিন ওই দুটোই নষ্ট করে দেব।

খেতুকে প্রফেসর ততোটাই জানাতে চেয়েছিলেন যতোটা দরকার ছিল। খেতু কৌতূহল সামলাতে পারে নি। খেতু আমাকে বলেছিল, “ভাই, সত্যিটাকে জানার নেশা খুব মারাত্মক। এ নেশার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। আমি জানি প্রফেসরের মতো আমারও একই পরিণতি হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। তারপরে তোর যেটা ভালো মনে হয় করিস।”

আমি জানি খেতুও চায়, এবং প্রফেসরও চেয়েছিল আমিও আমার অতীতের ঘটনাগুলোর সাক্ষী থাকি অন্তত একবার। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারি আমি আসলে কী চাই। সত্যি জানার লোভটা এখন আর অনুভব করি না নিজের ভেতর।

আমি এখন বই পড়ি, নতুন নতুন রান্না করি, আর সুনন্দকে নিয়ে সময় কাটাই। বাকি সমস্ত রকম কাজ থেকে অব্যহতি নিয়েছি। আমি এতেই খুব ভালো আছি এখন।

এই বর্তমানটুকুতেই এখন বেঁচে থাকা বড়ো দরকার আমার। অতীত আর ভবিষ্যৎকে তাদের মতো পথ খুঁজে নিতে দেওয়া যাক।

~ সমাপ্ত ~

 

 

লেখক ~ দেবায়ন কোলে