আনাড়ি টকিজ : পর্ব ১ – সাউন্ড ডিজাইন

Anari Talkies

একটা ভাল সিনেমা কেন ভাল হয়? আমরা কেন একটা সিনেমা বার বার দেখি, আর যত বার দেখি ততবারই নতুন কিছু খুঁজে পাই। সিনেমা মানেই শুধু ভাল অভিনয় বা ভাল সংলাপ নয়। একটি সিনেমার পিছনে অনেকগুলো মানুষের পরিশ্রম থাকে। সিনেমার কিছু কিছু ভাল অংশ আমরা দেখতে পাই শুনতে পাই, আর কিছু এতটাই ভালভাবে তৈরি করা যে আমরা তার অস্তিত্ব আলাদা করে টের পাই না। আমি স্বয়নে স্বপনে জাগরণে সিনেমা ছাড়া আর কিছু ভাবি না, আমার কাজটাই এই সংক্রান্ত তাই এই সিরিজটা লেখা শুরু করলাম। প্রতি সপ্তাহে সিনেমা তৈরির কোন একটা বিষয়ে জ্ঞান দিতে চলে আসব তাই।

আজকে থাকল ‘সাউন্ড ডিজাইনিং’ এর প্রথম পর্ব।

আমরা আড্ডার সময় সাধারণত সিনেমাকে মোটামুটি কমার্শিয়াল আর প্যারালাল বা আর্টহাউস এই দুটো ঘরানায় ভাগ করি। ধরুন আপনি টিভির চ্যানেল বদলাতে গিয়ে দুম করে একটা সিনেমার মাঝের ৬০ সেকেন্ড দেখে ফেললেন। এবারে এইটুকুতে কী করে বুঝবেন যে সিনেমাটা রিয়ালিস্টিক, নাকি হাইপাররিয়ালিস্টিক? এই সিনেমাতে কি হিরো মারলে ৬ জন ভিলেন ৬ দিকে ছিটকে পরে? নাকি প্রেমিক প্রেমিকা দুজন দুজনকে আদৌ না দেখে শুধু চিঠি লিখে সারাজীবন ভালবেসে যায়?

আমি বলব সাউন্ড ডিজাইনটাই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। এটা আপনি কনশাস ভাবে বুঝতে পারেন অথবা আপনার অবচেতনও আপনাকে বুঝিয়ে দিতে পারে। খেয়াল করে দেখবেন যখন সিনে অভিনেতাকে দেখছেন তখন কেমন আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন? শ্রীময়ী সিরিয়াল জাতীয় ‘ধুম তা না না’ নাকি শুধু সাইকেলের বেলের আওয়াজ বা প্রেশার কুকারের সিটি? এককথায় যে আওয়াজ গুলো আমরা দৈনন্দিন জীবনে শুনে অভ্যস্ত। মারপিটের সিক্যুয়েন্সে শুধু ঢিশ্যুম ঢিশ্যুম আওয়াজ হচ্ছে নাকি এমন একটা আওয়াজ হচ্ছে যেটাতে আপনার একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়।

একটা ফিল্মের ভিজুয়াল, অভিনয়, সংলাপ আপনাকে মোটা দাগে বুঝিয়ে দেবে যে আপনার এখন কী ভাবা উচিত। কিন্তু একটা ভাল সাউন্ড ডিজাইন আপনাকে বুঝিয়ে দেয় যে এখন আপনার কী অনুভব করা উচিত। যেহেতু আমাদের ভিজুয়াল মেমোরির জোর বেশি সেই কারণের সাউন্ডের বিষয়টা আরো বেশি করে অবহেলিত। তার ওপরে ভারতীয় সিনেমাতে অনেকদিন ধরে আমরা শব্দ বলতে মূলত আবহ সঙ্গীত আর গানই বুঝে এসেছি। পশ্চিমে যেহেতু মিউজিকাল সিনেমার ঘরানাটা অনেকটা আলাদা তাই আমার মতে ওদের সাউন্ড ডিজাইন এর কাজ অনেক বেশি মার্জিত এবং যত্নশীল।

সাউন্ড এফেক্টের কথা বলতে গেলে যার কথা বলতেই হয় সে হল জ্যাক ফোলি। ১৮৯১ সালে জন্মানো এই ভদ্রলোক অনেক রকম সাউন্ড এফেক্ট রেকর্ডিং এর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। সেখান থেকে ‘ফোলি’ শব্দের জন্ম। ধরুন সিনেমায় হিরো আর হিরোইন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কথা বলছে। আপনারা তাদের সংলাপ আর বৃষ্টির আওয়াজ দুটোই শুনতে পাচ্ছেন। কিন্তু শ্যুটিং এর সময় তো আর বৃষ্টির মধ্যেই সংলাপের রেকর্ডিং হয়নি। সেটা হলে বৃষ্টির আওয়াজ বাকি সব কিছুকে চেপে দিত। তাই সংলাপ পরে স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয় আর বৃষ্টির আওয়াজ পরে জুড়ে দেওয়া হয়। ফোলি আর্টিস্টটা বৃষ্টির অনেক রকমের আওয়াজ তৈরি করতে পারে। শুনলে অবাক হবেন যে বেকন ফ্রাই করেও এই আওয়াজ তৈরি করা যায়। আবার ঘুষি মারার আওয়াজ বাঁধাকপিতে ছুরি ঢুকিয়ে করা যায়। এই ফোলি যত ভাল হবে তত কম আমরা সেটাকে খেয়াল করব।

ডেভিড ফিনচার পরিচালিত ‘ফাইট ক্লাব’ নিশ্চয়ই অনেকেরই দেখা। এতে থাকা লড়াই এর দৃশ্যগুলো দেখে এত কেন অস্বস্তি হয়? কেন মনে হয় সত্যিই কেউ কারোর হাড় ভাঙছে? সেই একই অনুভূতি কি কোন হিন্দি ফাইট সিন দেখলে হয়? অথবা ‘ডাই হার্ড’ সিনেমার মারপিট দেখে কি এতটা অস্বস্তি হয়েছিল? হয়নি… তার মূল কারণ শব্দ। ভেবে দেখুন, দুজন হাতাহাতি করলে কী ঢিস ঢাস আওয়াজ আসে? নিজেরা যখন ছোটবেলায় মারপিট করেছেন তখন থোড়াই এমন আওয়াজ হত? সাধারণত এগুলো স্টক সাউন্ড, সব ছবিতেই এগুলোকেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ফাইট ক্লাব এর সাউন্ড ডিজাইনার রেন ক্লাইস (Ren Klyce) এর মনে হয় এগুলো একেবারেই আন রিয়ালিস্টিক। তাই বাস্তবের কাছাকাছি শব্দ তৈরির চেষ্টা শুরু করেন তিনি। প্রথমে হাড় ওয়ালা মুর্গির মাংশে ঘুষি মারা শুরু করলেন। তাতে ঠিক ঠাক আওয়াজ পাওয়া গেল না। তখন তার মধ্যে আখরোট ঢুকিয়ে ঘুষি মারা শুরু করলেন। কোন কোন জায়গায় বেসবলের ব্যাট দিয়ে গরু না শুয়োরের মাংসের মধ্যে মারা শুরু করলেন। তার সাথে জুড়ে দিলেন লেটুস, বাঁধাকপি আর সেলেরি ভেঙে তৈরি করা আওয়াজ। সেই জন্যই ফাইট ক্লাবের এই দৃশ্যগুলি দেখার সময় আপনার মনে একটা অন্যরকম অস্বস্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়, যার কোন ব্যখ্যা নেই। ইংরাজীতে এই অনুভূতিটাকে ভিসেরাল (visceral) বলা যায়, এর কোন ভাল বাংলা প্রতিশব্দ আমি জানি না।

নিচে রইল ফাইট ক্লাবের সেই দৃশ্য। প্রথম কমেন্ট ডাই হার্ডের দৃশ্যটিও দিলাম।

আজ এইটুকুই। পড়ে আপনাদেরও মতামত জানাবেন। ভাল থাকবেন সবাই।

https://m.youtube.com/watch?feature=youtu.be&v=NHXXqlcCxPs

© এলজা রয়

One thought on “আনাড়ি টকিজ : পর্ব ১ – সাউন্ড ডিজাইন

Comments are closed.