পুরনো কলকাতার বাজার – পর্ব ১

পুরোনো কলকাতার বাজার

লেখকঃ অনিরুদ্ধ সরকার

কলকাতার বাজার ও কিছু কথা:

কলকাতার কাছে চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ মিলেছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে জনবসতিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী ‘কলিকাতা’ গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিপ্রদাস পিপলাইয়ের ‘মনসাবিজয় কাব্য’, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বা কবিকঙ্কণ চণ্ডীর ‘চণ্ডীমঙ্গল, সৈয়দ আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, কৃষ্ণরাম দাসের ‘কালিকামঙ্গল, সনাতন ঘোষালের ‘ভাষা-ভাগবত’ ও কৃষ্ণদাসের ‘নারদপুরাণ’-এ রয়েছে কলিকাতার কথা। ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা অর্থাৎ ‘প্রদেশ’ জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে উদ্ধৃত এই তালিকাটিতেও ‘কলিকাতা’ গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন নামক একটি ফার্সি গ্রন্থেও ‘কলিকাতা’ গ্রামের উল্লেখ রয়েছে। অতএব কলকাতা কিন্তু কোনভাবেই আজকের অঞ্চল নয়। এর ইতিহাস বেশ প্রাচীন। শহর যত বেড়েছে বেড়েছে তত জনবসতি। বেড়েছে বাজার-ঘাট-দোকান দানি। দেখতে দেখতে শহর কলকাতায় কোথাওবা ঠাকুর দেবতার নাম ধরে গড়ে উঠল বাজার কোথাওবা এলাকার নাম থেকেই গড়ে উঠল বাজার। যেমন বুড়ো শিবের বাজার চলতি কথায় হয়ে উঠল বড় বাজার। আবার লালদীঘি থেকে নাম হয়ে উঠল লালবাজার। কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ব্যবসা পত্র বাড়ার কারণে গোবিন্দপুরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি বাজার বসিয়েছিল গড়ের মাঠের কাছে। ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির ঠিক আগে এই বাজারকে পরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল খিদিরপুরের দিকে, যার নাম ছিল ‘কুলিবাজার’। এছাড়া পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় পূর্ববাংলা থেকে নদীপথে নৌকোয় করে মালপত্র আসত চেতলা হাটের কাছে। কেউ কেউ একেই কলকাতার প্রথম বাজার বলে থাকেন। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক থেকে কোম্পানির জমিদারি দেখাশোনার ভার বর্তায় একজন ইংরেজ কর্মচারীর ওপর। তার একজন এদেশীয় কর্মচারী থাকত যাকে বলা হত ‘ব্ল্যাক ডেপুটি । আর এই ব্ল্যাক ডেপুটিদের হাতেই থাকত বাজারের ভার। তাদের কাজ ছিল বাজারগুলি থেকে ট্যাক্স এবং তোলা আদায় করা। সেকেলে কলকাতার তিনখানি বাজার ছিল সবচেয়ে পুরনো এবং জনপ্রিয়— শ্যামবাজার, লালবাজার আর খাসবাজার। যদিও এই খাস বাজারের বিশেষ কোন ইতিহাস মেলেনি। কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এই তিনটি বাজার ছাড়াও ১৭১১ সাল নাগাদ যে চারটি বাজারের বেশ নামডাক ছিল সেগুলি হল— সন্তোষ বাজার, মন্দির বাজার, লালবাজার আর বাজার কলকাতা। এর কয়েক কাল পর তৈরি হয় বৈঠকখানা বাজার, সুতানুটি বাজার, ধর্মতলা বাজার, জানবাজার, মেছুয়া বাজার এবং বহুবাজার। ১৭৩৮ সাল থেকে ১৭৫২ সালের মধ্যে কলকাতায় প্রায় ২১ থেকে ২২ টি বাজারের অস্তিত্ব মিলেছে। যার মধ্যে ছিল গোবিন্দপুরের বাজার, সুতানুটির হাট, হাটখোলা বাজার, সন্তোষ বাজার, লালবাজার, বরাবাজার, বড়বাজার, শ্যামবাজার, চার্লস বাজার, বেগুম বাজার, পোস্তা বাজার, বারাবাজার, জানবাজার, বটতলা বাজার, ইত্যাদি ইত্যাদি। কোম্পানির পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায় এই সমস্ত বাজারগুলি থেকে কোম্পানির তৎকালীন দিনে রোজকার ছিল ৪৬ লক্ষ ৫৩১৬ টাকা। বোঝাই যায়, এই টাকাটা নিশ্চয়ই খুব একটা কম ছিল না সেযুগে। সবচেয়ে বড় কথা এই বাজারগুলিতে তরিতরকারী ছাড়াও মিলত গাঞ্জা এবং তামাক। শুধু তাই নয় পূজা-পার্বণের আগে এই সকল বাজারগুলিতে আতশবাজিও মিলত। ১৭৬৮ সালের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় কলকাতায় তখন বাজারের অস্তিত্ব ছিল প্রায় ১৮ টির মত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বড়বাজার, সুতানুটি বাজার, জানবাজার, ধর্মতলা বাজার, মেছুয়াবাজার, রাম বাজার, কলুটোলা বাজার, সিমলা বাজার, বৈঠকখানা বাজার, পুলিশ বাজার, শোভাবাজার, কলিঙ্গ বাজার, জয়নগর বাজার, রাজনগর বাজার, বহুবাজার এবং গোলবাজার। ততদিনে অবশ্য আগের বেশ কিছু বাজার যেমন উঠে গেছে তেমনই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু নতুন বাজার। বাজারগুলি থেকে ইজারা বাবদ কোম্পানির তৎকালীন দিনে বাৎসরিক আয় ছিল প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। সবচেয়ে বেশি আয় হত কলকাতার বড়বাজার থেকে। এই বাজারে ইজারাদার হিসেবে যেমন রামসুন্দর মিত্র, নবকিশোর রায়, গোকুল শিরোমনির মত বিখ্যাত বাঙালিরা ছিলেন তেমনই ছিলেন টেরিটি সাহেব। যার নামে গড়ে উঠেছিল ‘টেরিটি বাজার’। ইংরেজ জমিদাররা সরকারি এই ‘বাঙালি ব্ল্যাক ডেপুটিদের’ বিভিন্ন সময়ে হাতে রাখতেন নানান উপঢৌকন দিয়ে। কারণ এই ব্ল্যাক ডেপুটিদের ওপরে ছিল তখন ছোটখাটো মামলা-মোকদ্দমার বিচারেরও ভার। ক্ষমতাশালী এইসব ব্ল্যাক ডেপুটিদের তখন নামই হয়ে গেছিল ‘ব্ল্যাক জমিদার’। ব্ল্যাক জমিদাররা অনেক সময় বেনামে বাজার ইজারা দেওয়ার জন্য এবং অর্থ উপার্জনের জন্য নানান ফন্দি ফিকির বের করত। যার ফলে বাজারের ব্যবসায়ীদের ওপর জুলুমের সেযুগে কোন প্রতিকারের পথ ছিল না। জমিদারদের পাশাপাশি বাজারে তাঁদের কর্মচারী ও পাহারাদারদেরও অত্যাচার ছিল অনেক বেশি।