পুরনো কলকাতার বাজার – পর্ব ২

পুরোনো কলকাতার বাজার

লেখক: অনিরুদ্ধ সরকার

সুতানুটির হাট:

চলে আসি কলকাতায় বাজার তৈরির গল্পে। যদিও সে ইতিহাস বড়ই আবছা। আনুমানিক ১৫৩০ সাল নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়। সেযুগে আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের অন্যতম পথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যে-তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, গোবিন্দপুর ছিল তার অন্যতম। গোবিন্দপুর ছাড়া অন্য দুটি গ্রাম ছিল সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা। কলকাতা মহানগরীর প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা তাদের নিজস্ব পরিচিতি হারায় এবং নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের সময় গোবিন্দপুর গ্রামটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত আছে, ‘গোবিন্দ দত্ত’ নামে এক ব্যক্তি এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে তীর্থে যাচ্ছিলেন। দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দেন এবং আদেশ করেন নদীর তীরবর্তী পরিত্যক্ত ভূভাগ খনন করতে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তিনি কাজ শুরু করেন। গোবিন্দ দত্ত মাটির নিচ থেকে প্রচুর ধনসম্পত্তি উদ্ধার করেন। তিনি সেখানেই থেকে যান। আস্তানা বানান। তাঁর নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয় ‘গোবিন্দপুর’। শোনা যায়, জব চার্নক সুতানুটির নিরাপদ অবস্থানের জন্য সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। সেযুগে সুতানুটি পশ্চিমে হুগলি নদী এবং পূর্বে ও দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমি দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার প্রয়োজন পড়ত। সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর ছিল মুঘল সম্রাটের খাসমহল অর্থাৎ সম্রাটের নিজস্ব জায়গির বা ভূসম্পত্তি। এই অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব ছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উপর। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর জব চার্নকের উত্তরসূরি তথা জামাতা চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের থেকে এই তিনটি গ্রামের জমিদারির অধিকার কিনে নেন। এরপরই কলকাতা মহানগর দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত এই অঞ্চলের রাজস্ব মুঘল সম্রাটকে দিয়ে এসেছিল। বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতায় দুর্গপ্রতিষ্ঠা ও সামরিক আয়োজনে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ ও অধিকার করে নেন। এই সময় ইংরেজরাই গোবিন্দপুরে অগ্নিসংযোগ করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। নদীর চল্লিশ মাইল ভাটিতে ফলতায় তারা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পরই তারা কলকাতার অধিকার পুনরায় ফিরে পেয়েছিল। কলকাতায় ফিরে এসে ব্রিটিশরা যে কাজটি করেছিল তা হল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পুনর্নির্মাণ। ১৭৫৮ সালে এই কাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৭৭৩ সালে। দুর্গনির্মাণের জন্য বেছে নেওয়া হয় বর্ধিষ্ণু গোবিন্দপুর গ্রামের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটিকে।

সুতানুটি-হাটখোলায় সেযুগে বেশ বড় একটা হাট বসত আর পর্তুগীজদের সঙ্গে এই হাটের কেনাবেচা চলত। সারা ইউরোপে বাংলার মসলিন সিল্ক নীল আর মসলার চাহিদা ছিল প্রবল। এখানকার হাট থেকে এসব জিনিস সস্তায় কিনে নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে পারলে প্রচুর লাভ হয় একথা বুঝতে পারল পর্তুগিজরা। আর তারপর থেকেই এই হাটে বিক্রি বাড়তে থাকে। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজদের ব্যবসা বাণিজ্য ধীরেধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগল এই অঞ্চলজুড়ে, আর সপ্তদশ শতক থেকে ডাচ, ডানিস আর ফরাসিদের আনাগোনা শুরু হল এই অঞ্চলে। সবশেষে এল ‘ইংরেজরা’, রাজার জাত বলে কথা তাই শেষ হাসিটা তারাই হাসল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যকুঠি গড়ে তুলল এই অঞ্চলে। তারপর ধীরেধীরে এলেন জব চার্নকের মত লোকেরা। জব চার্নক যখন কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেছেন তখন সুতানুটি গোবিন্দপুর আর কলকাতা নামের তিনটি অঞ্চলই ছিল জলা-জঙ্গল আর সেখানে ছিল জন্তু-জানোয়ারের আধিক্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে ধীরেধীরে ব্যবসা বাড়ানোর ফলে বাড়তে থাকে লোকসংখ্যা। ধীরে ধীরে গ্রামের মোড়ক ছেড়ে সুতানুটি গোবিন্দপুর আর কলকাতা হয়ে ওঠে আস্ত এক শহর। গড়ে উঠতে থাকে ‘প্রাসাদ’। কলকাতার নতুন নাম হয় ‘প্রাসাদ নগরী’। ইংরেজ ছাড়াও এদেশের ধনীরাও নিজেদের মত করে বাজার তৈরি করলেন। কারণ এই সমস্ত বাজার থেকেই তাদের রোজগারের পরিমাণ ছিল প্রচুর।

পরমেশ্বরণ থাঙ্কাপ্পন নায়ারকে বলা হয় ‘কলকাতার খালি পায়ের ঐতিহাসিক’। সেই নায়ারের কথায়, “বড়বাজার এলাকাটা ছিল সুতানুটিতে। এখনকার ডালহৌসি স্কোয়ারও সুতানুটিরই অংশ ছিল। আর গোবিন্দপুর গ্রামটি ছিল এখনকার ময়দান– ফোর্ট উইলিয়াম এলাকা। আর গোবিন্দপুরের পূর্ব দিকে, ছিল কলকাতা গ্রাম। গোবিন্দপুরে প্রচুর ধনী মানুষের বাড়ী ছিল– যাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের বাড়িও ছিল। এখন যেখানে বিড়লা তারামণ্ডল, সেখানেই ছিল ঠাকুরবাড়ি। এইসব পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ হতে হয়েছিল যখন ব্রিটিশ শাসকেরা নতুন করে ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী করেন– সেই সময়ে। বর্তমান উত্তর কলকাতার বাগবাজার, শ্যামবাজার ও তার আশেপাশের এলাকাগুলিই অতীতে সুতানুটি গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। গোবিন্দপুর, সুতানুটি, ও ডিহি কলকাতা এ ছাড়াও কালীঘাট ও চিৎপুর নিয়ে তৈরি হয় অধুনা কলকাতা ও সালকিয়া ও বেতড় হাওড়ার শিবপুরের কাছের অঞ্চল। যা নিয়ে তৈরি হয় হাওড়া । সুতানুটি ও বেতড় দুটি গ্রামই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। সপ্তদশ শতাব্দীতে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যখন নগরায়ণ শুরু হয়, তখন এই দুটি গ্রাম যথাক্রমে কলকাতা ও হাওড়া মহানগরীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।”

কলকাতার প্রথম বাজার:

একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং অথবা আশুতোষ বিল্ডিংয়ের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। শুধুমাত্র ছিল পুরনো সেনেট হাউস। দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের জায়গায় ছিল একটি বস্তি। আশুতোষ বিল্ডিংয়ের জায়গায় ছিল একটি বাজার। বাজারটির নাম ছিল ‘মাধববাবুর বাজার’। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে এই বস্তি আর বাজার ভেঙে ফেলা হয় এবং সেখানে তৈরি হয় দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং। বিল্ডিং তৈরির সময় এটি সরিয়ে দেওয়া হয় কলেজস্ট্রিট সংলগ্ন এলাকায়। কলেজস্ট্রিট এবং বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডে স্থানান্তরিত হয় বাজারটি যা ‘কলেজস্ট্রিট মার্কেট’ নামে পরিচিত।
অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে কলকাতার বুকে শুরু হয় কলকাতা মার্কেট। কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার স্টুয়ার্ট হগ। সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি আবার পুলিশ কমিশনারও ছিলেন। স্যার হগ বিশেষ উদ্যোগ নেন একটি বাজার তৈরির। কলকাতার বুকে প্রথম সরকারিভাবে মার্কেট চালু হয়। পয়লা জানুয়ারি কলকাতার এই বাজারটির উদ্বোধন হয়। যার নাম দেওয়া হয় ‘নিউমার্কেট’। পরে নিউমার্কেটের নাম পালটে হয় হগ মার্কেট। এই হগ মার্কেট নাম রাখা হয় অনেক পরে । এই বাজার উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছিল একাধিক ইতিহাসের। কারণ এটাই ছিল কলকাতার প্রথম মিউনিসিপাল মার্কেট। রূপচাঁদ পক্ষী কলকাতার বাজারের বর্ণনা করতে গিয়ে একটি সুন্দর ছড়া বেঁধেছিলেন , ছড়াটি হল— “বাগবাজার কলিবাজার বাজারে বাজারে একাকার, এত বাজার দোকানদার কোন রাজ্যে নাই কার।”

বাগবাজার:

‘বাগবাজার’ নামটা সম্ভবত ‘বাঁকবাজার’ থেকে এসেছে বলেই অনেকে মনে করেন। গঙ্গার বাঁকে অতীতে একসময় বেশ বড় একটি বাজার বসত। আর সেই বাঁকের বাজার থেকেই বাগবাজার নামটির আবির্ভাব বলে অনেকেরই ধারণা। তবে এই মত মানতে নারাজও অনেকেই। পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে, কলকাতায় ইংরেজদের বসবাসের একেবারে প্রথম দিকে গঙ্গার তীরে চার্লস পেরিন নামে এক সাহেব বড় একটি বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন। এই পেরিন সাহেব ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। পেরিন সাহেবের একটি সুন্দর বাগান ছিল। ইংরেজরা সেযুগে প্রচুর ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেন। বাগানকে ফার্সিতে বলা হয় ‘বাগ’। পেরিন সাহেব এখানে একটি বাজার বসিয়েছিলেন যা ‘পেরিন সাহেবের বাগিচা’ নামে বেশ জনপ্রিয় ছিল। পেরিন সাহেবের সেই ‘বাগিচা’ বা ‘বাগ’ থেকেই বাগবাজার নামটির উৎপত্তি বলে বেশিরভাগ জন মনে করেন।
চার্লস পেরিনের বাগানবাড়িতে কোম্পানির বড় বড় সাহেবরা তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সন্ধেবেলার দিকে শহর কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসতেন। ইংরেজরা সুতানুটি ছেড়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলে চলে গেলে ১৭৪৬ সাল নাগাদ সাহেবদের আনাগোনা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৭৫২ সালে এই বাগানটি নিলামে ওঠে এবং কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট জেফানিয়াহ হলওয়েল মাত্র আড়াই হাজার টাকায় এই বাগানটি কিনে নেন। পরে ১৭৫৫ সালে কর্নেল ফ্রেডরিক স্কটের কাছে বাগানটি তিনি বিক্রি করে দেন। এই কর্নেল ছিলেন পুরানো ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সেনাধ্যক্ষ এবং ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রথম স্ত্রী মেরির বাবা। মেরির স্বামী বুকানন অন্ধকূপ হত্যায় মারা গেলে মেরি হেস্টিংসকে বিয়ে করেন। সিরাজের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর ইংরেজরা পালিয়ে ফলতায় আশ্রয় নিলে সেখানেই হেস্টিংয়ের সঙ্গে মেরির আলাপ হয়। মেরির পিতা কর্ণেল স্কট ফলতায় একটি বারুদ তৈরির কারখানা খুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে যায়। বাগবাজার শুধু বাজারের জন্যই প্রসিদ্ধ এরকমটা নয়। বাগবাজার আরও অনেকগুলি কারণে ইতিহাস প্রসিদ্ধ। কলকাতার শেষ সতী হয়েছিলেন যে হরসুন্দরী, তিনি ছিলেন বাগবাজারের সোম পরিবারের মেয়ে। বেন্টিঙ্কের আইন পাস হওয়ার আগের মুহূর্তে স্বামীর চিতায় তিনি নিজেকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। বাগবাজারের গঙ্গার ঘাট অত্যন্ত মনোরম। কলকাতায় যে কয়েকটি শ্মশান রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো বাগবাজারের কাশী মিত্তিরের শ্মশানঘাট। ঢাকার নায়েব রাজবল্লভ মিত্রর ভাইপো কাশিমপুরের নামেই এই শ্মশান ঘাট। এই ঘাটের কাছেই ছিল তাঁর বাড়ি। ১৭৬১ সাল নাগাদ তিনি এক দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। সেকেলে কলকাতার বাগবাজারের দুটি জিনিস ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। একটি ছিল ষোলোচরকি এবং অন্যটি ছিল মদনমোহন তলার রাস। মদনমোহন তলার বাড়িতে রাস উপলক্ষে সঙ প্রদর্শিত হত। আর সেই ‘সঙ’ সারা কলকাতায় আর কোথাও দেখা যেত না। এই ‘সঙ’ বাগবাজার ছাড়িয়ে নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ত। সেযুগে এই বাগবাজার ঘিরে একটি প্রবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়—

“ ময়রা মুদি কলাকার

তিন নিয়ে বাগবাজার।।”

সারা কলকাতা জুড়ে এই প্রবাদ লোকের মুখেমুখে ফিরত। প্রবাদে ব্যবহৃত তিনজন ময়রা-মুদি-কলাকারের মধ্যে ভোলানাথ দে অর্থাৎ ভোলা ময়রার নাম আজ সারা বিশ্ব চেনে। তাঁর নিজের কথায়,
“আমি ময়রা ভোলা বি আই খোলা
নহি কবি কালিদাস বাগবাজারে করিবার পুজো হলে পুরি মিঠাই ভাজি।” অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সঙ্গে ভোলা ময়রার কবির লড়াই আজ ইতিহাস।
এই ভোলা ময়রার নাতজামাই ছিলেন নবীন চন্দ্র দাস। বাগবাজার রসগোল্লার জন্য চিরপ্রসিদ্ধ। নবীন চন্দ্র দাস রসগোল্লার জন্মদাতা।
বাগবাজারকে কেন্দ্র করে আরও একটি বিখ্যাত প্রবাদ গড়ে উঠেছিল যা ছড়াতে পরিণত হয়েছিল সেযুগে। প্রবাদটি হল,
“বাগবাজারে গাঁজার আড্ডা
গুলির কোন্নগরে
বটতলায় মদের
একটা সুন্দর বউ বাজারে”।
জানা যায় দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায় যিনি হ্যারিসন সাহেবের দেওয়ান ছিলেন এবং যাঁর নামে বাগবাজার অঞ্চলে একটি রাস্তা এবং গঙ্গার তীরের একটি ঘাট রয়েছে, তাঁর ছেলে শিবচন্দ্র ছিলেন বাবুগিরিতে ওস্তাদ। তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন দুই ‘ম-তে’ মাতোয়ারা। ‘মদ আর মেয়ে’, আর সেকারণে যাতে পথে ঘাটে বসে তাঁরা নেশা না করে গাঞ্জা না টানে মেয়েদের সঙ্গে বেলাল্লাপনা না করে এবং পরিবারের সম্মান বজায় থাকে তার জন্য একটি গাঁজার আড্ডা খুলেছিলেন। এখানে প্রত্যেকের নাম ছিল এক একটি পাখির নামে। আর সেই আড্ডায় তাঁদের সেই পাখির নামেই ডাকা হত।

এই বাগবাজার পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলিতে ধন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ দীর্ঘদিন এখানকার বলরাম বসুর বাড়িতে মাঝেমধ্যেই থাকতেন। যে বাড়ি আজ বলরাম মন্দির নামে জনপ্রিয়। বলরাম মন্দির আর হলঘরে ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন নামে যে সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন তাই পরে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সারদামণিও দীর্ঘদিন বাগবাজারে ছিলেন। বাগবাজারে নারী শিক্ষার জন্য নিবেদিতা স্থাপন করেছিলেন রামকৃষ্ণ সারদা মিশন ভগিনী নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়, যা ‘নিবেদিতা স্কুল’ নামে জনপ্রিয়।
বাগবাজারে থাকতেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসুর মত মানুষজন। এই বাগবাজার থেকে গড়ে উঠেছিল বাংলার প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়। বাগবাজারে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে তৈরি হয় প্রথম অ্যামেচার নাটকের দল, বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার। প্রথম পেশাদারী নাট্যসংগঠন ন্যাশনাল থিয়েটারেরও জন্ম হয়েছিল বাগবাজারে।
এখানে রয়েছে নন্দলাল বসুর বাড়ি। ১৯২৪ সালে স্বরাজ পার্টির কনফারেন্স বসে ছিল এই বাড়িতে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ এই বাড়ির উঠোনে সভা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, প্রফুল্ল চন্দ্র, চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে একাধিক দিকপাল ব্যক্তিত্ব এসেছিলেন এই বাড়িতে। শ্রীরামকৃষ্ণ এই বাড়িতে এসেছিলেন নন্দলালের ভাই প্রতিবেশের আগ্রহে। বাগবাজারের আরও একটি বিখ্যাত জায়গা এখানকার ‘বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরী’ যে লাইব্রেরীতে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে অজস্র বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাঁদের গ্রন্থ দান করেছিলেন। শিশির কুমার ঘোষ এবং মতিলাল ঘোষ বাগবাজার থেকে শুরু করেছিলেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র প্রথম প্রকাশ। আখড়াই গানের স্রষ্টা রামনিধি গুপ্ত টপ্পা গানের যে দল করেছিলেন তা ‘বাগবাজার দল’ নামে জনপ্রিয় ছিল। তাঁর শিষ্য মোহন চান বাগবাজারের একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আখড়াই গানকে হাল্কা করে হাফ আখড়াইতে রূপান্তরিত করেছিলেন। বাগবাজারকে কেন্দ্র করে আরও বিখ্যাত দুই ব্যক্তির নাম না বললে অন্যায় করা হয়। এঁদের মধ্যে একজন হলেন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব উত্তম কুমার। এছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল অনাদি বসুও ছিলেন বাগবাজারের বাসিন্দা। বাগবাজারের মাটিতেই মোহনবাগান ক্লাবের বীজ রোপণ করা হয়েছিল আর সবশেষে ১৯১০ সালে শ্রী অরবিন্দ নৌকাযোগে চন্দননগর যাত্রা করেছিলেন এই বাগবাজার ঘাট থেকেই।

শ্যামবাজার:

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক নথি থেকে জানা যায় ১৭৩৮ সাল থেকে ১৭৫২ সালের মধ্যে শহর কলকাতায় যে সমস্ত বাজার এবং হাট ছিল সেই তালিকার মধ্যে সবচেয়ে উপরের দিকে নাম রয়েছে শ্যামবাজারের। কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় কলকাতায় স্থলপথে আসার যে চারটি প্রধান পথ ছিল সেই চারটি পথের প্রবেশদ্বারে চারটি বিশিষ্ট বাজারের অবস্থান ছিল যার মধ্যে শ্যামবাজার ছিল অন্যতম। প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কলকাতার ইতিবৃত্ত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, “শ্যামবাজার বর্তমান শ্যামবাজারের দক্ষিণস্থ রাস্তার দক্ষিণ দিকে ছিল। সার্কুলার রোড প্রস্তুতের সময় আঠারোশো খ্রিস্টাব্দে বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়।” হলওয়েল সাহেব তাঁর এক লেখায় লিখছেন, ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে পুরাতন বাজারগুলির তালিকার মধ্যে শ্যামবাজারকে ‘নতুন বাজার’ বলে বলা হয়েছে। চলে আসি শ্যামবাজার নামটির কথায়, ‘শ্যামসুন্দর ঠাকুরে’র নাম থেকেই খুব সম্ভবত ‘শ্যামবাজার’ নামটি এসেছে আবার অনেকে মনে করেন শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় নামে এক জমিদার বাস করতেন এই অঞ্চলে, শ্যামবাজারে তাঁর একটি বাজার ছিল, সেখান থেকেই এই এলাকার নাম হয় শ্যামবাজার। শ্যামবাজার নামকরণ সম্বন্ধে আরও একটি অভিমত জানা যায় যেখানে বলা হয়েছে পলাশী আমলে শোভারাম বসাকের শ্যামরায় বিগ্রহের নাম থেকেই এর উৎপত্তি। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে একটু এগোলেই এই রাস্তার ওপর মৃন্ময়ী দক্ষিণাকালীর একটি বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় যেটি ‘শ্যামবাজার কালী’ মন্দির নামে জনপ্রিয়। কেউ কেউ বলেন এখান থেকেই নাকি নাম হয়েছে ‘শ্যামবাজার’। শোনা যায় মেদিনীপুর ঘাটাল থেকে এই বিগ্রহটি এখানে এনে স্থাপন করা হয়।
বাগবাজার অঞ্চলে বসবাস করতেন বিখ্যাত কৃষ্ণরাম বসু যিনি লবণের ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন। শোনা যায় দুর্ভিক্ষের সময় তিনি দরিদ্র জনগণকে প্রায় লক্ষাধিক টাকার চাল বিতরণ করেছিলেন। এছাড়া তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি কটক থেকে রাস্তার দু’পাশে বৃক্ষরোপণ করে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই শ্যামবাজারেও তাঁর একটি বিশ্রামাগার ছিল ।

আরও জানা যায় ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় কলকাতায় বর্তমান পুরসভার মত কোনও কিছু ছিল না। তখন পুলিশ কমিশনারের অধীনে একটি ময়লা ফেলার বিভাগ ছিল। কাজের সুবিধার জন্য ১৭৮৫ সালে পুরো শহরকে ৩১টি থানায় বিভক্ত করা হয়। এই থানাগুলির মধ্যে শ্যামবাজার ছিল অন্যতম। মোহনবাগান ক্লাবের প্রথম সভাপতি ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু। ভূপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের প্রাণপুরুষ। তাঁর হাতেই জন্ম নেয় বাংলার প্রথম ফুটবল দল মোহনবাগান।