পুরনো কলকাতার বাজার – পর্ব ৫

পুরোনো কলকাতার বাজার

লেখক: অনিরুদ্ধ সরকার

বালিগঞ্জ:

কিভাবে গড়ে উঠেছিল কলকাতার আজকের সবচেয়ে এলিট এলাকা বালিগঞ্জ তা বড়ই আশ্চর্যের একসময় এই স্থানে বাড়ি নির্মাণের জন্য বালি বিক্রি হতো বলে বালি বিক্রির বাজার বা গঞ্জ থেকে এই এলাকাটির নাম হয়েছিল বালিগঞ্জ। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর লর্ড ক্লাইভের চেষ্টায় মীরজাফর বাংলার নবাব পদে অধিষ্ঠিত হন। মীরজাফরের সঙ্গে সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ইংরেজরা মারহাট্টা খালের সীমার মধ্যে এবং সীমার বাইরে ৬০০ গজ পর্যন্ত জমির দখল স্বত্ব লাভ করে। এই সময় কলকাতার দক্ষিনে কুলপি পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগগুলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমিদারভুক্ত হয়। কলকাতা ও তার আশপাশের কয়েকটি মৌজার জন্য ইতিপূর্বে ইংরেজদের রাজস্ব দিতে হত। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমল থেকেই এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল কিন্তু মীরজাফর নবাব হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কলকাতা ও তার আশপাশের কয়েকটি মৌজা কোম্পানিকে তিনি প্রদান করেন। প্রাচীন কলকাতার প্রথম জমিদার বা কালেক্টর ছিলেন জন জেফনিয়া হলওয়েল। হলওয়েল তার এক রিপোর্টে জানাচ্ছেন, “কোম্পানির প্রথম কাজ হয়েছিল শহরের সীমা বৃদ্ধির জন্য কলকাতা সংলগ্ন বিরাট বিরাট এলাকাগুলিকে এই অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা। সংযোজিত এই সকল এলাকার মধ্যে মারাঠা খালের অপার পারে বাসযোগ্য ৫৫টি গ্রাম মৌজা সমন্বিত ১৫টি ডিহি ছিল। এইজন্য এগুলিকে বলা হতো ৫৫ গ্রাম। এই ৫৫ টি গ্রামের মধ্যে বালিগঞ্জ ছিল একটি অন্যতম মৌজা গ্রাম। দীর্ঘদিন এই বালিগঞ্জ অঞ্চল ছিল অনুন্নত জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইউরোপীয়রা এখানে বড় বড় বাগান বাড়ি তৈরি করে বাস করতে শুরু করলে বালিগঞ্জ উন্নত একটি অঞ্চল হয়ে ওঠে। ১৮৬৩ সালে দক্ষিণ পূর্ব রেলওয়ে ক্যালকাটা এন্ড সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানি ক্যানিং পর্যন্ত রেলপথের সূচনা করলে এবং এখানে বালিগঞ্জ স্টেশন স্থাপন করার পরে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। বালিগঞ্জ অঞ্চলে ট্রাম চলাচল শুরু হয় ১৯৩০ সালে। বন্যা খরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে আর্তের সেবায় যে প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ জনপ্রিয় তার নাম ভারত সেবাশ্রম সংঘ। ১৯২২ সালে এই সংঘের প্রথম কাজ শুরু হয় বাগবাজারের একটি ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে। পরে নানান স্থানে ভাড়া বাড়িতে থেকে কাজ করার পর ১৯৩১ সালে ১২০০০ টাকা ব্যয়ে ৭ কাঠা ১২ ছটাক জমি কিনে বালিগঞ্জে বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যালয় স্থাপিত হয়। সেখান থেকে ভারত সেবাশ্রম সংঘ তার যাত্রা শুরু করে। ১৯৩২ সালে গুরু পূর্ণিমার দিন ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান কার্যালয়ের উদ্বোধন হয়।

লালবাজার:

যে রাস্তায় প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার নিয়ম ছিল, যে রাস্তার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস তার নাম লালবাজার। এক ফরাসি পর্যটক কলকাতার রাস্তায় প্রকাশ্যে ফাঁসির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। তিনি বলছেন, “কলকাতার একটি রাস্তা রয়েছে যেখানে বিভিন্ন সময় নানা অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সেই রাস্তাতে ফাঁসিও দেওয়া হয়। জায়গাটির নাম লালবাজার।” পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, হলওয়েল সে যুগে কলকাতার ওপর একটি জরিপ চালিয়ে ছিলেন এবং সেখানে যিনি তিনি যে তথ্য দিয়েছিলেন তা থেকে জানা যায়, “সে যুগে লালবাজারের আয়তন ছিল ১০ বিঘা ৯ কাঠা।”
১৭৫৩ সালে আর্টিলারি কোম্পানির লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ওয়েলস প্রাচীন এই শহরের যে বিবরণ প্রকাশ করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, “বর্তমান লালবাজার স্ট্রিটের উত্তরে ছিল কাছারিবাড়ি আর দক্ষিণ দিকে ছিল একটি প্রাচীন নাট্যশালা।” প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ১৭৪৫ সালে তৈরি হওয়া এই নাট্যশালাই ছিল কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন থিয়েটার। ১৭৫৬ সালে সিরাজ যখন কলকাতা আক্রমণ করলেন তখন তাঁর বাহিনী এসে এই প্রেক্ষাগৃহটি দখল করে নেয়। সে সময় এর উল্টো দিকে কোন বাড়ি ছিল না এবং রাস্তাটির নাম ছিল ‘রোপ-ওয়াক’। লাল দিঘীর পশ্চিম পড়ে ছিল ইংরেজদের পুরনো কেল্লা। এখনকার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অস্তিত্ব তখন ছিল না। সিরাজ বাহিনী এই থিয়েটার হল থেকেই কামান দেগে ইংরেজদের পুরনো দুর্গ দখল করে নেয় আর তারপর থেকে থিয়েটার হলটি বন্ধ হয়ে যায়। পলাশীর যুদ্ধের ১১ বছর পর ১৭৬৮ সালে প্রাচীন কলকাতার ১৮টি বাজারের যে তালিকা পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, সে সময় লালবাজারে বাৎসরিক জমার পরিমাণ ছিল ২৩১ সিক্কা টাকা এবং জমা গ্রহীতাদের মধ্যে যার নাম ছিল সবার আগে তার নাম হলো ফ্রান্সিস-ডি-মেলো। প্রত্যেক দোকান থেকে তোলাবাজির পরিমাণ নির্ধারিত ছিল যার পরিমাণ ছিল নির্দিষ্ট। এই ১৮টি বাজারে ছিল কোম্পানি বাহাদুরের সম্পত্তি। এবার আসি লালবাজারের নামটির কথায়, “হুগলি থেকে কলকাতায় ব্যবসা করতে এসেছিলেন শেঠ মুকুন্দরামের ছেলে লালমোহন। তিনি বিদেশিদের সঙ্গে বেশ কিছু ব্যবসা শুরু করেন একাধিক ব্যবসায়ী ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। বিদেশীদের সঙ্গে তিনি লালদীঘি খনন করান। লালদীঘির মাটি থেকে ইট বানিয়ে এই দিঘির পশ্চিমে লালমোহন নিজের বসবাসের জন্য ভদ্রাসন তৈরি করেন। তাঁর বাড়িটির নাম হয় লালবাড়ি। আর লালমোহনের স্থাপিত বাজারটি লালবাজার নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।” যদি যদিও এই বিষয়ে আরও একাধিক মতামত রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসবার আগে এই স্থানে ছিল তৎকালীন জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের কাছারিবাড়ি। এখানে একটি বাজার বসত। উৎসবের দিন আবিরে নাকি চারিদিক লাল হয়ে যেত লাল রঙের ছড়াছড়ি থেকেই স্থানটি পরিচিত হয়ে ওঠে লালবাজার নামে ।

কলকাতার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন হলওয়েল সাহেব। তাঁকে সে সময় এই শহরের জমিদার বলা হত। সাহেব তাঁর এক লেখায় উল্লেখ করছেন ১৭৩৬ সালে স্থানে একটি বাজার ছিল। তবে ‘কলিকাতার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের রচয়িতা প্রাণকৃষ্ণ দত্ত বলেছেন, “সে যুগে সমাজের উঁচু তলার মানুষদের বাসস্থান সেভাবে উল্লেখযোগ্যভাবে এদিকে গড়ে ওঠেনি। এখানে যে বাজারটি গড়ে উঠেছে সে বাজারটি তেমন বড় ছিল না। কেবল পথিকদের সুবিধার জন্য এখানে একটি বাজার ছিল। ইংরেজদের আগমনের ফলে এটির শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু টেরিটি সাহেবে এর উত্তরে একটি বড় আকারের বাজার নির্মাণ করেন। যা টেরিটি বাজার নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।” পুরনো কলকাতার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় সে যুগে প্রত্যেক দোকানে তোলাবাজির একটি অলিখিত নিয়ম ছিল । প্রত্যেক দোকান থেকে সেযুগে তোলার পরিমাণ ছিল নির্দিষ্ট যা ছিল ১৩ কড়া। আর বাজার থেকে বাৎসরিক টাকা জমার পরিমাণ ছিল ২৩১ সিক্কা। একসময় এ লালবাজার মানেই ছিল হারমনিক ট্যাভর্ণ। সেসময় ইংরেজদের আমন্ত্রণ করার এক বিখ্যাত জায়গা ছিল হারমনিক ট্যাভর্ণ। হারমনিক ট্যাভর্ণ তখন ছিল অভিজাত ইংরেজদের মিলনক্ষেত্র। জানা যায় ১৭৮০ সালে লালবাজারের হারমনিক ট্যাভর্ণগুলি ছিল কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের স্ট্যাটাস সিম্বল। সে সময় ইংরেজদের আমন্ত্রণ করার জন্য এই বিশেষ জায়গাটি গড়ে উঠেছিল বলেই জানা যায়। পুরনো কলকাতার ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা যায় ১৭৮০ সালে লালবাজারের হারমোনিক ট্যাভর্ণ কলকাতার উচ্চবিত্ত সমাজের সেরা মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। বড় বড় হোটেলের চেয়েও হারমনিক ট্যাভর্ণের মর্যাদা তখনকার কলকাতায় ছিল অনেক অনেক বেশি। মিসেস ওয়ারেন হেস্টিংস হারমনিকের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বহুদিন পর্যন্ত হারমনিক ট্যাভর্ণগুলি কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেছিল। এখানকার খানাপিনা ও আমোদ প্রমোদের ব্যাপার নিয়ে ‘বেঙ্গল গেজেটে’ উইলিয়াম হিকি প্রচুর ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন। দিনের পর দিন পুলিশ অফিসের পাশে গড়ে ওঠা হারমনিক ট্যাভর্ণ উঠে গেলে সেই বাড়িটি হয় নাবিকদের আবাস। পরে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপিত হয়।
লর্ড হেস্টিংসের একান্ত সচিব উইলিয়াম পামারের ছেলে জন পামারের বাড়ি ছিল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পাশেই। ১৮৩৬ সালে তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হলে তার বসতবাটি কোম্পানি দখল করে নেয় এবং পুলিশের সদর দপ্তর সেই বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় কলকাতা পুলিশের নাম ছিল টাউন গার্ড। এসব ছাড়াও রেভারেন্ড লং সাহেবের মতে, এই স্থানের কাছে মিশনারীদের একটি গির্জা ছিল যে গির্জার চূড়ার রং ছিল লাল। তা থেকে জায়গার নাম নাকি হয়েছিল লালবাজার।